বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববীক্ষা নিয়ে মানুষকে আলোকিত করবে, জ্ঞান অন্বেষণ ও সৃষ্টির পথ উম্মোচন করবে- এমন ধারণায় সৃষ্টি । একটা বিশ্ববিদ্যালয় নতুন নতুন জ্ঞানের দ্বার উম্মোচন করবে । উদাহরণ হিসেবে আমরা নালন্দা, আল আ্জহার বা অক্সফোর্ডকে দেখতে পারি। সে হিসেবে বাংলাদেশের কয়টা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃতই বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে পেরেছে তা আলোচনার দাবী রাখে। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, পাবলিক –প্রাইভেট নানা রুপে। কিছুদিন পরপরই দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে দাবী উঠে। আর রাজনৈতিক বিবেচনায় সেগুলো বাস্তবায়িতও হচ্ছে। এখন পর্যন্ত দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৭ টি। আরো কয়েকটি অনুমোদিত এবং বাস্তবায়নাধীন। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় আছে তিনটি (উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও আরবী বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা একশ মতো। আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় দুইটি ( এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন ও ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি)।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বিভাগে ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। যার মধ্যে তিনটি চট্টগ্রামে। প্রাইভেট আছে বেশ কয়েকটি। পাবলিক –প্রাইভেট মিলিয়ে এগুলোর একটাও মোটামুটি মানের পড়ালেখা করায় কি না সেই বিতর্কে নাইবা গেলাম। দেশে আরো বিশ্ববিদ্যালয় দরকার আছে নাকি, যেগুলো আছে সেগুলোর উন্নয়ন জরুরী- এটাও এখন বিদ্ব্যৎমহলে আলোচিত হচ্ছে বেশ জোরেশোরেই ।
বাঁশখালীতে বিশ্ববিদ্যালয় হলে কি লাভ হবে? কেউ বলছেন এলাকার পরিচিতি বাড়বে। বাঁশখালী পুরো বাংলাদেশেই পরিচিত। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় দরকার নাই। আর, পরিচিত হওয়ার আরো অনেক পথ আছে।
কেউ বলছেন এলাকার ছেলেমেয়েরা বাড়িতে থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করবে। এই তথাকথিত উচ্চশিক্ষা চট্টগ্রাম শহরে থেকেই সম্ভব। এটা তেমন দুরেও নয়। আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই স্থানীয় কোটা রাখে না, রাখা উচিতও না।
কেউ বলছেন এলাকার অবকাঠামোগত উন্নতি হবে। হাটহাজারীর জোবরা গ্রাম সেই আগের মতোই আছে। অথচ সেখানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে ১৯৬৬ সালে। আহামরি কোন উন্নয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে জোবরার হয়নি। অন্য কোথাওযে হয়েছে তেমন নয়।
কেউ বলছেন এলাকার সংস্কৃতি, কৃষ্টি’র উন্নয়ন হবে। যারা এটা বলছেন বা ভাবছেন তাঁরা জেনে রাখুন উন্নত সংস্কৃতি বা কৃষ্টি বলতে কিছু নাই। এই ধারণাটা পশ্চিমারা আপনার-আমার মতো তৃতীয় বিশ্বের মানুষকে অসম্মান করে তৈরী করেছে। প্যান্ট-শার্ট পড়াটা উন্নত সংস্কৃতি, লুঙ্গি বা ধুতি অনুন্নত…এই ধারণাটাই ভুল। উদাহরণ দিতে গিয়ে বললাম। কাউকে ছোট করতে নয়।
বাঁশখালীর ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে-এমনও কেউ কেউ মনে করছেন। এটাও ভুল ধারণা। একটা বিশ্ববিদ্যালয় আগামী ২০ বছরেও বড়জোর ৫০০০ শিক্ষার্থী ভর্তি করাবে। আর এরা বাঁশখালীতেই থাকবে বা কেনাকাটা করবে এমন ভেবে লাভ নেই। খুব কাছেই চট্টগ্রাম শহর রয়েছে। বড়জোর নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা যেমন চাল, সব্জি, মাছ এসব কিনতে পারে। এটা বাঁশখালীর অর্থনীতিতে বলার মত তেমন প্রভাব ফেলবে না। উল্টা এই বিশ্ববিদ্যালয় করতে গিয়ে আমাদের বেশকিছু ফসলী জমি দখল হবে, যা আর কোনদিন ফিরে পাওয়া যাবে না। এভাবে হিসেব করলে যেসব যুক্তি সবাই সাধারণত আবেগের বশবর্তী হয়ে সবাই দিচ্ছেন সেসব নাই হয়ে যাবে।
তবে কি আমরা বিশ্ববিদ্যালয় চাই না?…
হ্যাঁ, আমরা একটা পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বাঁশখালীতে চাই। কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই, কেন চাই, কিভাবে চাই? আসুন ভাবনা আর যুক্তিগুলো সাজাই।
এক. এটা হবে পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। কোনো বিশেষায়িত বা নামে পাবলিক কিন্তু আসলে ব্যায়বহুল প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান নয়।
দুই. এটা একটা পুরোপুরি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে। আবাসন ও খাওয়ার সমস্যা নিয়ে কোনো শিক্ষার্থীকে যাতে ভূগতে না হয়। মেসেও যাতে থাকতে না হয়। এটা প্রকৃত অর্থে পড়ালেখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তিন. রাষ্ট্র এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভর্তুকি দিয়ে পড়াবে। মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য এটা তেমন ব্যাপার হওয়ার কথা না।
চার. এটাতে বিবিএ, কম্পিউটার বিজ্ঞান এসবের মতো টেকনিক্যাল বিষয় পড়ানো হবে না। এসব বিষয় পড়ানোর প্রতিষ্ঠান যথেষ্ঠ আছে। এগুলো টেকনিক্যাল বা বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোই সাধারণতঃ পড়ায়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা, মৌলিক বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, কৃষি, মৎস্য, সমুদ্রবিজ্ঞান, ফরেষ্ট্রি এধরণের বিষয়গুলো থাকবে। কারণ, বাঁশখালী তথা পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রাম পাহাড়, বন, সমুদ্রবেষ্টিত। আর কৃষি এবং মৎস্য চাষ ও আহরণ আমাদের প্রধান জীবিকা। বাংলাদেশের জন্যও এগুলো সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আর একটা বিশ্ববিদ্যালয় তার স্থাপিত এলাকার সার্বিক বিষয়াদির সাথে বৈশ্বিকরুপের মেলবন্ধন ঘটায়। তাই এই বিষয়গুলেোকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব।
পাঁচ. এই বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান এর প্রায়োগিক দিকের উপর গুরুত্বারোপ করবে। অর্থাৎ, শিক্ষার্থীরা যা শিখবে তা তাকে সাথে সাথে হাতে কলমে প্রয়োগ করতে পারতে হবে। সোজা কথায়, প্রতি সেমিষ্টারেই মাঠ শিক্ষণ বলে কমপক্ষে একমাসের কোর্স থাকতে হবে। গণবিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে এটা কিছুটা চর্চা করছে। উদাহরণস্বরুপ, মৎস্যবিজ্ঞান যারা পড়বে তাদের সরাসরি জেলেদের সাথে সমুদ্রে ও মাছ চাষীদের সাথে কাজ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাজানো ক্লাসরুম বা ল্যাবরেটরী প্রকৃত অভিজ্ঞতা কখনোই দিতে পারে না।
ছয়. বাঁশখালী দক্ষিণ চট্টগ্রামে ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক দিয়ে দারুণ অবস্থানে রয়েছে। বিস্তীর্ণ পাহাড়, অবারিত সমুদ্র, বিপুল কৃষি জমি ; পার্শ্ববর্তী অন্যান্য উপজেলাগুলোসহ কক্সবাজার, বান্দরবান এবং চট্টগ্রাম শহরের সাথে কম সময়ে যোগাযোগ ও বিভিন্ন যানবাহন সুবিধা; নাগরিক কোলাহল ও ঝঞ্জাটমুক্ত পরিবেশ রয়েছে বাঁশখালীতে যা এধরণের প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয়।
সাত. দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্যান্য উপজেলাগুলোর মধ্যে পটিয়া- আনোয়ারা-চন্দনাইশ এখন শিল্পায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী করে বিশাল জায়গা বন্ধ করে না ফেলে, তাদের উচিত শিল্প –কারখানা তৈরী করা। চট্টগ্রাম শহরের বিকল্প শহর চন্দনাইশ, পটিয়া বা আনোয়ারাই হতে পারে । আর বড় শহরের পাশে এরকম বিকল্প ব্যবস্থা রাখা জরুরীও বটে। আর সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ায় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সাতকানিয়া সরকারি কলেজকে আরো বড় পরিসরে , আরো বেশী বিষয়ে সম্মান শ্রেণীর পাঠদান উপযোগী করাটাই দরকারি । লোহাগাড়াতে একটা কলেজ জাতীয়করণ করা দরকার।মূলতঃ সাতকানিয়া-লোহাগাড়া নানাপ্রকার ব্যবসায়িক কর্মকান্ডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বোয়ালখালীর যোগাযোগ এই উপজেলাগুলোর চাইতে চট্টগ্রাম শহরের সাথেই বেশী। কিছুটা পটিয়া ছাড়া অন্যদের জন্য তেমন সুবিধাজনক নয়। আর তাছাড়া, বোয়ালখালীতে রয়েছে ঐতিহাসিক স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজ। তাই তুলনামূলকভাবে স্বাধীনতা পরবর্তী আজ অবধি কম সুবিধাপ্রাপ্ত বাঁশখালীতে এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হতে পারে যা দেশ ও অঞ্চলের সম-উন্নয়নকে নিশ্চিত করবে।
আট. বাঁশখালী স্বাধীনতা পূর্ব বা পরবর্তী কোন সরকারের কাছ হতেই তেমন কোন বিশেষ সুবিধা পায়নি। কিন্তু, ধান, সামুদ্রিক লবণ, লিচু, সামুদ্রিক মাছ, বিভিন্ন সব্জি চাষ, মৎস্য চাষ, পান চাষ এসবক্ষেত্রে বাঁশখালী জাতীয় ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। অধুনা এর সাথে যুক্ত হয়েছে চা চাষ। উত্তর দক্ষিণ লম্বা বিশাল পাহাড়, ইকোপার্ক, ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত ও বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রসহ সবমিলিয়ে বাঁশখালীর উল্লেখ করার মত সম্পদ ও সম্ভাবনা অনেক। বাঁশখালীতে জন্ম নেওয়া গুণীজনও অনেক। খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী, কমরেড অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন প্রমুখ ব্যক্তিরা ব্রিটিশ আমল হতেই চট্টগ্রাম তথা তৎকালীন পূর্ববঙ্গের উন্নয়নে অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও বাঁশখালীবাসী রক্ত দিয়েছে। মৌলভী ছৈয়দ, সুলতানুল কবির চৌধুরী, এডভোকেট প্রদীপ ভট্টাচার্য্যসহ আরো অনেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তৎপরবর্তী দেশগঠণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বিখ্যাত ইতিহাসবেত্তা, শিক্ষাবিদ ও চট্টগ্রাম বিম্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. আবদুল করিম স্যারের জন্ম ও বেড়ে ওঠায় ধন্য বাঁশখালী। এছাড়া বর্তমানেও বাঁশখালীর অনেকেই জাতীয় ও আঞ্চলিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছেন ধারাবহিকভাবে। কিন্তু সে তুলনায় বাঁশখালী তেমন কোন কিছু পায়নি সরকারের কাছ হতে। তাই এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বাঁশখালীতে স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার একটি যথাযথ প্রতিদান ও সম্মান দিতে পারে।
নয়. এই বিশ্ববিদ্যালয় বাঁশখালীরই কোন মনীষী কমরেড আসহাব উদ্দিন বা ড. আবদুল করিম স্যারের নামে হতে পারে। এইদুজন মানুষই বিশ্ববীক্ষা ও উদার-নৈতিক সর্বজনীন উন্নত ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং সেইভাবে জীবন-যাপন করেছেন। তবে যে নামেই হোক তা নিয়ে কোন্দল কোনোভাবেই কাম্য নয়।
দশ. এই বিশ্ববিদ্যালয় বাঁশখালীতে প্রতিষ্ঠার সবচাইতে বড় ও মূল কারণ হিসেবে বলতে চাই তুলনামূলকভাবে উচ্চ শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া বাঁশখালীর মানুষকে উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তোলা।পার্শ্ববর্তী উপজেলাগুলোর সাথে অহেতুক প্রতিযোগিতা, দ্বন্দ্ব বা ঈর্ষা নয়। উন্নয়নের সামগ্রিকতা ও সার্বিক সুবিধা বিবেচনাতেই আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয় বাঁশখালীতে চাই। এই দাবী আমার জানামতে সর্বপ্রথম উথ্থাপন করে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা সংসদ ২০০৮ সালে তাদের সম্মেলনে। তবে, সেখানে স্থান নির্ধারণ করা ছিল না।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন স্থানীয় মানুষের জীবন-যাপনের সাথে মিথঃস্ত্রিয়ায় যাবে, শিক্ষকেরা যখন আলাপ করবেন, দেশী-বিদেশী গবেষকরা যখন বাকশখালীর মাঠ-ঘাট-পাহাড়-জল-সমুদ্রে গবেষণা করবেন, গবেষণার ফলে নতুন কিছু দিবেন, তখন এই জনপদের মানুষের প্রকৃত উপকার হবে। নয়তো বিশ্ববিদ্যালয় নামের কিছু ভবন, আর তথাকথিত শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নামক নাক উঁচু কিছু মানুষের পদচারণায় বাশঁখালীর পরিবেশটাই নষ্ট হবে। তাই আসুন সবাই এমন বিশ্ববিদ্যালয়ই চাই যা নতুন, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করবে, গবেষক তৈরী করবে, ভালো মানুষ তৈরী করবে, এই এলাকার অনুভূতিকে ধারণ করবে, সম্মান করবে। সার্বিকভাবে তখনই আঞ্চলিকতা দোষের কানাগলি ছাপিয়ে বৈশ্বিক ও জাতীয় পরিমন্ডলে আমরাও গর্ব করতে পারব।
-লেখক: নুর মোহাম্মদ ফেরদৌস, উন্নয়ন পেশাজীবি, এরিয়া কোঅর্ডিনেটর, পিএসটিসি, চট্টগ্রাম।
তথ্যসূত্র: উইকপিডিয়া ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন’র ওয়েব সাইট