মুহাম্মদ মিজান বিন তাহের: বাঁশখালী উপজেলার ইটভাটাগুলো অবৈধভাবে দিন দুপুরে পোড়াচ্ছে কাঠ। পরিবেশ ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া স্বত্বেও সরকারি নিয়ম নীতি না মেনে সম্প্রতি ইটভাটাগুলোতে কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ানোর অভিযোগ করছে স্থানীয় জনগণ। কিন্তু প্রশাসনের কোনও নজরদারি নেই। রয়েছে নীরব। যেন দেখে ও না দেখার ভাব!

নির্দিষ্টভাবে ১২০ ফুট চিমনির মাধ্যমে ইট পোড়ানোর নিয়ম থাকলেও দু’একটা ছাড়া কয়েকটি ইটভাটা সেই নিয়মও মানছে না। ইতোপূর্বে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উপজেলার ইটভাটাগুলোতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে আর্থিক জরিমানা করা হয়। কিন্তু বাঁশখালীতে তেমন কোনও অভিযান পরিচালনা করতে দেখা যায়নি।
পরিবেশ নানাভাবে হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়লেও এই ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের জোরালো কোনও পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বাঁশখালী ১ নং পুকুরিয়া ইউনিয়নের চা-বাগান সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় সরকারী নির্দেশনা অমান্য করে জিকজ্যাগের পরবর্তীতে গড়ে তোলা হয়েছে লম্বা চিমনির মেসার্স চৌধুরী ব্রীক নামের নবনির্মিত ইটভাটা। সে প্রশাসনকে বৃদ্ধা আঙ্গুলি দেখিয়ে বাহারছড়ায় জনলোকালয়ে নবনির্মিত করে গড়ে তুলেছে নতুন আরো একটি ইটভাটা। যা সম্পূর্ণ পরিবেশ সম্মত নয়। পাশাপাশি রয়েছে তার পুরাতন আরো একটি ইটভাটা। তার পাশাপাশি ইলশা গ্রামে নুরুল আবচারের মালিকানাধীন জনসম্মুখে রাস্তার পাশেই কৃষি জমিতে দিন দুপুরে বনের কাঠ ব্যবহার করে চালানো হচ্ছে এই ইটভাটা। এর আরো একটু পূর্বে গড়ে উঠেছে আরো একটি ইটভাটা। একে একে ২ কিলোমিটারের ব্যবধানে গড়ে উঠেছে ৪ টি ইটভাটা। তাছাড়া সাধনপুর ইউনিয়নের লটমনি পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে তোলা হয়েছে ৩ টি ইটভাটা। চাম্বল-বড়ঘোনা সড়কের পাশেই মুন্সীখীল এলাকায় লোকালয়ে কৃষি জামিতে ১টি, শেখেরখীল-ছনুয়া সড়কে ১টি, বাঁশখালী পৌরসভার দক্ষিণ জলদী পাহাড়ের পাদদেশ রয়েছে একটি। তবে বর্তমানে সেটি মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে বাঁশখালী সাতকানিয়া সীমান্তের চূড়ামণি এলাকায় ৪টি ইটভাটা রয়েছে। বাঁশখালীর বাহারছড়ায় ৪ টি ইট ভাটার মধ্যে ১টিতে ১২০ ফুট চিমনি থাকলেও অপরগুলোতে পুরাতন আমলের ড্রাম চিমনির মাধ্যমে ইট পোড়ানো হচ্ছে। ফলে আশেপাশের পরিবেশের চরম বিপর্যয় হচ্ছে বলে স্থানীয়ভাবে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর বা জেলা প্রশাসনের কোনো অনুমোদন ছাড়াই এই ইটভাটাগুলো গড়ে তোলা হচ্ছে।বাহারছড়া ইউনিয়নে ৩ কিলোমিটারের দূরত্বে কৃষি জমিতে রয়েছে ৩ টি ইটভাটা। আর এসব ইটভাটাগুলোর সাথে লাগোয়া রয়েছে কয়েক গ্রামের হাজার মানুষের বাস। স্থানটি কোনোভাবেই ইটভাটা স্থাপনের জন্য উপযুক্ত নয় বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগী স্থানীয়রা। ইট পোড়ানোর ফলে এই এলাকার জনস্বাস্থ্য যেমন হুমকির মুখে পড়ছে, তেমনি আশপাশের বনাঞ্চলও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
একবার ইট পোড়াতে প্রায় চার হাজার মণ কাঠ পোড়াতে হয়। এসব কাঠ জোগাড় হচ্ছে আশপাশের সংরক্ষিত বন থেকেই। ফলে উজাড় হয়ে যাচ্ছে গাছপালা। কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়ছে। পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন ইটভাটাগুলো গড়ে উঠলেও তা নিয়ে কারও যেন কোনো মাথাব্যথা নেই।
শুধু বাহারছড়ায় নয়, চাম্বল, জলদী, শেখেরখীল, পুকুরিয়াতেও এভাবে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে লোকালয় ও ফসলিজমিতে অনেক ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এসব অবৈধ ইটভাটায় কয়লার পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ। একটা সময় এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। পরিবেশ দূষণ করে ও জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলে যারা এভাবে ইটভাটা গড়ে তুলছে, তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরিবেশ আইন, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন আরও কঠোর করা ও তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
অবৈধ ইটভাটার মালিকরা দাবি করেছেন, তাঁদের পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উৎকোচ দিয়ে ইটভাটা চালু রাখতে হয়েছে। অবৈধ ইটভাটা চালু রাখার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তাঁরা বলেন, শুরুতে তাঁরা ড্রাম চিমনি পদ্ধতির ভাটায় ইট পোড়াতেন। পরে সরকার ১২০ ফুট উঁচু চিমনি দিয়ে ইটভাটা তৈরির নির্দেশনা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বেশির ভাগ ইটভাটা ১২০ ফুট উঁচু চিমনিতে রূপান্তরিত করা হয়। সর্বশেষ সরকার নতুন এক নির্দেশনায় জিগজ্যাগ কিলন, হাইব্রিড কিলন, ভারটিক্যাল স্যাফট কিলন, টানেল কিলন পদ্ধতিতে ইটভাটা প্রস্তুতের নির্দেশনা জারি করে। তবে তারা সেই নীতিমালা মানছে না। কারণ, এরইমধ্যে সব ভাটায় ইট পোড়ানো শুরু হয়ে গেছে। আগামী মার্চ পর্যন্ত চলবে ইট পোড়ানো। এরপর মাত্র তিন মাসে কোনো অবস্থায়ই ইটভাটা রূপান্তরিত করা যাবে না।
কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ানোর ফলে দিন দিন বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে পরিবেশ ও বনাঞ্চল। একটি গ্রুপ পাহাড়ি মাটি কেটে ইটভাটাগুলোতে সরবরাহ করছে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে। এদিকে পাহাড় থেকে মাটি কেটে ইটভাটা গুলোতে নিয়ে আসার ফলে দিন দিন বিনষ্ট হচ্ছে পাহাড়ি ভূমি।
ইটভাটাগুলোতে কয়লার পরিবর্তে কাঠ ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে ইটভাটার মালিকগণ কয়লার সংকটের কারণে কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে বলে দাবি করেন। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, কয়লার চেয়ে কাঠের দাম কম হওয়ায় ইটভাটাগুলোতে প্রতিনিয়ত বেপরোয়াভাবে পোড়াচ্ছে অবৈধ কাঠ।
অন্য দিকে নবনির্মিত বাহারছড়ার ইলশা গ্রামে ধানি জমিতে প্রশাসনকে বৃদ্ধা আঙ্গুলি দেখিয়ে তৈরি করেছে অবৈধ ইটভাটা। এ নিয়ে এলাকার সাধারণ জনগনের পাশাপাশি স্থানীয় বারক আলী তালুকদার মসজিদ কমিটিসহ জমির মালিকগণের পক্ষে আব্দুল করিম, নেছার আহমদ, সিরাজ আহমদ, মাওলানা আইয়ুব আলী, নজমুল হক, হাফেজ আহমদ রশিদ, সরোয়ার আলম ও হাফেজ এনামুল হক বাদী হয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইটভাটা তৈরির কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলেও পরবর্তীতে এই আদেশ অমান্য করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ইটভাটার মালিক মর্তুজা আলীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
