বঙ্গবন্ধু শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশের মহান স্থপতি
– কমরুদ্দিন আহমদ
আজ ১৫ আগস্ট ২০২০, বীর বাঙালির হৃদস্পনন্দন, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালি জাতির সার্বিক উন্নয়নের মহান প্রকৌশলী। দেশের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষে তিনি নিজ জীবনের সর্বস্ব উৎসর্গ করেছেন। বাঙালি জাতি সগৌরবে বেঁচে থাকার জন্য রাষ্ট্রের যতগুলো বিভাগে চৌকস ভুৎপত্তি অর্জন প্রয়োজন, তার ভিত্তি স্থাপনের মহা-পরিকল্পকও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
নবগঠিত বাংলাদেশকে বিশ্বের পটভূমিকায় উন্নত মস্তকে দাঁড় করাতে বঙ্গবন্ধু বুনিয়াদি শিক্ষার ভিত্তি মজবুত করতে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন। তিনি মুসলিম ধর্মীয় ঐতিহ্যকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। তার পাশা-পাশি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা ও সুষ্ঠু সংস্কৃতির বিকাশ কল্পে পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিল ভেঙ্গে দিয়ে ১৯৭৪ সালে জাতীয় সংসদের এক বিধিবলে ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ এ “বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ” প্রতিষ্ঠা করেন । রাজধানীর রমনা থানার সেগুন বাগিচায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কেন্দ্রীয় কার্যালয় । সরকারি এই প্রতিষ্ঠান দেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয় দ্বারা পরিচালিত হয়।
বঙ্গবন্ধু শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে ড. মুস্তাফা নুরউল ইসলামকে মহাপরিচালকের দায়িত্ব প্রদান করেন । কবি আল মাহমুদকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে এ মহান নেতা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন । বাংলা ভাষার একজন মৌলিক কবির প্রতি বঙ্গবন্ধুর এ সিদ্ধান্তটি ছিল এক অসাধারণ মূল্যায়ন।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির লক্ষ্য মূলত:
চারুকলা, সঙ্গীত, আবৃত্তি, নৃত্য ও নাট্যকলার চর্চা এবং প্রসার। এসবের বিকাশের স্বার্থে গুণী শিল্পীদের যথাযথ মূল্যায়ন, যেমন প্রতিভাবান শিল্পীদের সক্রিয় সহায়তা ও স্বীকৃতি প্রদান, সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে অনুদান প্রদান, অতীত ঐতিহ্য ও সমকালীন সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা এবং সঙ্গীত, নাট্য ও চারুকলা বিষয়ে আন্তর্দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উৎসবাদির আয়োজন এই প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে করা হয়ে থাকে। এখানে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অঙ্গ হিসেবে সঙ্গীত-উৎসব, সম্মেলন, সেমিনার, নাট্যানুষ্ঠান, ওয়ার্কশপ, বিতর্কানুষ্ঠান, স্টাডি গ্রুপ পরিচালনা ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চিত্রকলা প্রদর্শনী, বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন ও পুরস্কার প্রদান, বিদেশে সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশের শিল্প ও সাংস্কৃতিক দল প্রেরণ ও বিদেশী সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জ্ঞাপন, দেশের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে তাদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কৃত করা এবং শিল্প ও সংস্কৃতিবিষয়ক বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গ্রন্থ, সাময়িকী ও পরিচিতি-জ্ঞাপক স্মরণিকা প্রকাশ ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে।
পাঁচটি বিভাগের মাধ্যমে একাডেমীর যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বিভাগগুলি হচ্ছে: ১. গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগ; ২. অর্থ, হিসাব ও পরিকল্পনা বিভাগ; ৩. চারুকলা বিভাগ; ৪. নাট্যকলা বিভাগ এবং ৫. সঙ্গীত, আবৃত্তি ও নৃত্য বিভাগ। এই পাঁচটি বিভাগ পরিচালিত হয় পাঁচ জন পরিচালকের দায়িত্বে। একাডেমীর সর্বোচ্চ নির্বাহী কর্মকর্তা হচ্ছেন মহাপরিচালক। সরকার কর্তৃক নিযুক্ত এই মহাপরিচালকই সার্বিক প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর বিশাল চত্বরে প্রশাসনিক ভবনের পাশাপাশি রয়েছে একটি নবনির্মিত অত্যাধুনিক জাতীয় নাট্যশালা। এটি ২০০১ সালের জুন মাসে উদ্বোধন করা হয়। এখানকার মঞ্চে নাট্যপ্রদর্শনসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। চিত্রকর্ম প্রদর্শনের জন্য রয়েছে একটি গ্যালারি এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য রয়েছে তৎসংলগ্ন বিভিন্ন বিভাগীয় কক্ষ। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই এর শাখা রয়েছে এবং সেগুলির কর্মতৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রীয় ইউনিট হিসেবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ।
জেলা ছাড়িয়ে বর্তমানে উপজেলা পর্যায়েও শিল্পকলা একাডেমির শাখা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ড. আমিনুর রহমানের নেতৃত্বে বাঁশখালী শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। যা ২০১২ সালে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাব্বির ইকবালের নেতৃত্বে ” উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি ” নামে চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির অনুমোদন প্রাপ্ত হয়। বর্তমানে সৎ ও চৌকস উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোমেনা আক্তারের সভাপতিত্বে উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি বাঁশখালী, সমগ্র উপজেলার শিল্প -সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে বেগবান করার লক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। তারই ধারাবহিকতায় ২০১৯ সালে বাঁশখালীতে উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে একটি পৌরসভা ও চৌদ্দটি ইউনিয়নে, ১০টি বিষয় ঠিক করে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন সম্পন্ন করা হয়। এ উপলক্ষে একটি স্মারকও প্রকাশ করা হয়, যা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ উৎসর্গ করা হয়।
বাঁশাখালী একটি প্রাচীন জনপদ। বাঁশখালী থানার প্রতিষ্ঠা ১৫ জুলাই ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দ। প্রতিষ্ঠালগ্নে বৃহত্তর আনোয়ারা থানা ও বাঁশখালী থানা বৃহত্তর বাঁশখালী থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আনোয়ারা থানা এলাকা মূলত বাঁশখালী থানারই অংশ ছিল। দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রাচীন জনপদ বাঁশখালী। বাঁশখালী সমুদ্র-উপকূলে এতদ্-অঞ্চলের প্রথম জনপদ গড়ে ওঠে। ১৮১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার বাঁশখালী থানা প্রতিষ্ঠা করে। এক সময় বাঁশখালী, আনোয়ারা, কুতুবদিয়া একটি অখণ্ড নির্বাচনী এলাকা ছিল। (যে এলাকা হতে ১৯৫৪ সালে অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ এম এল এ নির্বাচিত হয়েছিলেন।) প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ৫৯ বছর পর ১৮৭৬ খ্রিস্টব্দে ইংরেজরা প্রশাসনিক সুবিধার জন্য আনোয়ারা এলাকাকে বাঁশখালী থানা হতে আলাদা করে আনোয়ারাকে থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। বাঁশখালী থানার প্রথম হেডকোয়ার্টার ছিল রায়ছটার চৌধুরী হাটের পূর্বপাশে সাধনপুরের রাতা-খোর্দ গ্রাম ঘেঁষে। যা বাঁশখালী উইকিপিডিয়ায় ১৯১৭ সাল লিখা হয়েছে। উইকিপিডিয়ায় বাঁশখালী থানার প্রতিষ্ঠা-সনটি ১০০ বছর কমে গেছে, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও লিপিকার প্রমাদ! ঐতিহাসিক সত্য হলো বাঁশখালীর প্রতিষ্ঠাকাল ১৫ জুলাই ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে। বাঁশখালী হতে আনোয়ারা আলাদা হবার পর যে অংশে বাঁশখালী থানার আয়তন ছিল, উপজেলা প্রতিষ্ঠার পরও তা অক্ষত আছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করতে আমাদের বক্তব্য নির্ভুল প্রমানিত হবে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে বাঁশখালী উইকিপিডিয়ার থানা প্রতিষ্ঠার সনটি সংশোধন করা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি।দেশের বিভিন্ন প্রাচীন থানা উপজেলা প্রতিষ্ঠিত হবার পর ভৌগলিক পরিসীমার পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু বাঁশখালী এখনো অখণ্ড রয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে বাঁশখালীর মানুষ সংস্কৃতিমনষ্ক।
আমরা ৪৫ তম শোক দিবসে জাতির মহান পিতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, আহবায়ক- বাঁশখালী সাহিত্য পরিষদ