প্রফেসর সাহেব স্মরণে
আহমদ জানিবদার
আসহাবউদ্দীন আহমদ, ত্রিভুবনচারী- অধ্যাপক, রাজনীতিক ও সাহিত্যিক।
এলাকায় প্রফেসর সাহেব নামে সমধিক পরিচিত।
চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর গ্রামে এপ্রিল ১৯১৪ খ্রি. তাঁর জন্ম; মৃত্যু- ২৮ মে, ১৯৯৪ খ্রি.
২১ মে ২০২১ তারিখের ‘ঐ মাঝি কই’ শীর্ষক পোস্টে এই বিশিষ্টজনের এক ইচ্ছার কথা আছে, যা তাঁর ‘বাদলের ধারা ঝরে ঝর্ ঝর্’ বইতে বলা
হয়েছে এভাবে-
(পৃথিবীতে) “….. খারাপ মানুষও আছে। ভাল মানুষও আছে। খারাপ বইও আছে। ভাল বই ও আছে। আমার চিঠি যে বই হলো তাও মন্দ কী। দুনিয়াতে ভাল বই বা ভাল মানুষ আর কত? বাজের তুলনায় কাজের বই বা কাজের মানুষ অনেক কম।
কিন্তু আমার বই লেখক হবার কোনো দিনও শখ ছিল না। অনেক সময় মনের খেদে আমি মনে মনে বলেছি, নতুন বই লেখা কিছুদিন বন্ধ রেখে আগে দুনিয়াতে এ পযর্ন্ত যে সব ভাল বই লেখা হয়েছে সেগুলো সব মানুষেরই পড়ার একটা খুব ভাল ব্যবস্থা করা দরকার। রবি ঠাকুর, নজরুল, শরৎ বাবু খুব বড় লেখক। এ কথা সবাই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু অভাগা দেশের শতকরা কয়জন লোক এঁদের লেখা পড়তে পারে? দেশের গুটি কতক লোকই তো এ রসভাণ্ড আগলিয়ে বসে আছে। বাকী সব যে তিমিরে সে তিমিরে। এটা কত বড় অবিচার কোনো সময় ভেবে দেখেছ? কালি, কলম, আর কাগজ যাঁরা তৈরী করলেন তাঁরা জানতেও পারলেন না তাঁদের তৈরি জিনিস দিয়ে কি কথা লেখা হল।
আমার চিঠি যখন বই হয়ে গেল তখন আমিও বদলে গেলাম। আমার ভেতরের চিঠি লেখক এন্তেকাল করল। ইন্না-লিল্লাহ! তার কালি কলম কাগজ পেল এক বই লেখক। আমার লেখা শুরু হয়েছিল চিঠি লেখক হিসেবে শেষ বই লেখক হিসেবে। মানুষ ভাবে এক। হয় আর এক। দুনিয়াতে অহরহ এই খেলাই চলছে।…… আমি ভাবি রোদ উঠবে। উঠে মেঘ। ভাবলাম বাদলা দিনের চিঠির লেখক হব। আর হয়ে গেলাম বাদলা দিনের বই লেখক।”
(সূত্রঃ ‘আসহাব উদ্দীন রচনা-সংগ্রহ’, আসহাব উদ্দীন আহমদ, মুক্তধারা, প্রথম সংস্করণ : জানুয়ারী ১৯৮১; পৃ. ৪৪)
উল্লেখ্য,
“বাদলের ধারা ঝরে ঝর্ ঝর্’ কোন এক শিশুকে লেখা পত্রগুচ্ছ। সে শিশু কাল্পনিকও হতে পারে।…. এ চিঠির আকারে লেখাগুলিতে একটি খাঁটি শিশুর সাথে সাথে লেখকের শৈশব স্মৃতিকেও আমরা পাচ্ছি।….. লেখক নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোয় শিশুমনের উপযোগী ভাষায় ছবির পর ছবি এঁকে গেছেন।…..
আমার দিক থেকে সব কথার সেরা কথা হচ্ছে বইটি আমার ভাল লেগেছে।….
রাজনীতি করেও সাহিত্য করা যায় বিদেশে তেমন নজির বিস্তর। আশা করি আমাদের দেশে অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ তেমন একটি নজির হয়ে উঠবেন। ”
এ অংশটুকু ‘বাদলের ধারা ঝরে ঝর্ ঝর্’ এর ভূমিকা থেকে নেওয়া। লিখেছেন- আবুল ফজল, সাহিত্য নিকেতন, চট্টগ্রাম। (পৃ.১২)
অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ বেলেছেন,
‘মানুষ ভাবে এক। হয় আর এক।’
এটা বাস্তব সত্য।
বাঁশখালী কলেজ কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনায় ছিল না, ৭ জুন ২০১৪ কলেজ মিলনায়তনে ‘ত্রিভুবনচারী অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ এবং তাঁর রম্য রচনা’ শীর্ষক বিষয়ভিত্তিক আলোচনা হবে; প্রধান আলোচক হিসেবে প্রফেসর ড. অনুপম সেন, উপাচার্য, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম, এর উপস্থিতি আলোচনা সভাকে বিশেষ সফলতা দেবে। এক ভিন্নধর্মী উদ্যোগে ‘স্বপ্নিল বাঁশখালী'(একটি অরাজনৈতিক ছাত্র ও সমাজকল্যাণমূলক সংগঠন), বাঁশখালী, চট্টগ্রাম এর সহযোগিতায় ওই আয়োজন সাফল্য লাভ করে।
আলোচ্য বিষয়ের ওপর প্রকাশিত পুস্তিকার ‘প্রসঙ্গকথা’-তে মোঃ আবুল হোসেন চৌধুরী, অধ্যক্ষ, বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ ও আহ্বায়ক অনুষ্ঠান আয়োজক কমিটি, বলেন-
“বিশিষ্টজনের জন্ম ও মৃত্যু দিবসে
স্মরণ সভার আয়োজন হয়। বেশীর
ভাগ ক্ষেত্রে তা আনুষ্ঠানিকতার
মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এতে
গুণিজনের কর্মকীর্তি ও নানা দিক
নিয়ে আলোচনা হয়। এ নিতান্ত
মূল্যহীন। এ প্রসঙ্গে বিশ্বকবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমত অতীব
প্রাসঙ্গিক-
‘বিশেষ দিনে বিশেষ পূজা-অনুষ্ঠান
করে যাঁরা নরোত্তম তাঁদের শ্রদ্ধা
জানানো সুলভে মূল্য চুকিয়ে
দেওয়া। তিন শত চৌষট্টি দিন
অস্বীকার করে তিন শত পয়ষট্টিতম
দিনে তাঁর স্তব দ্বারা আমরা নিজের
জড়ত্বকে শান্তনা দেই। সত্যের
সাধনা এ নয়, দায়িত্বকে অস্বীকার
করা মাত্র। এমনি করে মানুষ
নিজেকে ভোলায়। নাম গ্রহণের
দ্বারা কর্তব্য রক্ষা করি, সত্য গ্রহণের
দূরহ অধ্যবসায় পিছনে পড়ে যায়।
কর্মের মধ্যে তাঁকে স্বীকার করলেম
না, স্তবের মধ্যে সহজ নৈবেদ্য
দিয়েই খালাস। যাঁরা এলেন
বাহ্যিকতা থেকে আমাদের মুক্তি
দিতে তাদেরকে বন্দী করলেম
বাহ্যিক অনুষ্ঠানের পুনরাবৃত্তির
মধ্যে।’
স্রেফ অনুষ্ঠানে স্মৃতি তর্পণের মধ্যে যেন নিঃশেষিত না হয় আয়োজনের আবেদন এ আমাদের অভিষ্ঠ লক্ষ্য।
…. শ্রোতা, পাঠকবৃন্দ ও বর্তমান প্রজন্ম অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদের ‘সৃষ্টি’র সন্ধানে উদ্বুদ্ধ হবেন, এ আমাদের ঐকান্তিক অভিপ্রায়।….”
এমন অভিপ্রায় আরো অনেকের।
মুক্তধারা’র উল্লিখিত ‘আসহাব উদ্দীন রচনা-সংগ্রহ’-এ তাঁর জীবনের শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন আসহাব উদ্দীন
আহমদ-
“আমার জীবনের শেষ ইচ্ছা, শেষ সাধ হল আমার মরদেহ পরলোকে পার্সলের জন্য ‘কাপড়-বাঁধাই’ হবার আগে আমার যা লেখাজোখা আছে (যার কিছুটা বাজারছুট, কিছুটা অর্থাভাবে অপ্রকাশিত) সেগুলোকে একত্রে জড় করে তিন-চার খণ্ডে শোভন কাপড়-বাঁধাই না হোক অন্তত কাগজ বাঁধাই করে আমার প্রিয় বাংলা ভাষাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের হাতে তুলে দিয়ে তাঁদের থেকে শেষ বিদায়টুকু নিয়ে পরপারে পাড়ি জমাই।”
তাঁর এই স্বপন এখনো সফল না হলেও অন্যভাবে স্বার্থক। স্যার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর ‘বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্র’ প্রকাশ করেছে ‘আসহাব উদ্দীন আহমদ সেরা রম্য রচনা’। ওয়াকিবহাল মহল জানেন, প্রফেসর সাহেবের প্রিয় বাংলা ভাষাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য তাঁর ‘সেরা রম্য রচনা’র এই বইটি ‘বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্র’-এর ‘চিরায়ত বাংলা গ্রন্থমালা’ সিরিজের আওতায় প্রকাশিত।
আসহাব উদ্দীন আহমদের লেখাজোকার সম্পূর্ণ সমগ্র প্রকাশের কাজ এখনো বাকী থাকলেও তাঁকে নিয়ে খ্যাত অখ্যাতজনের বিপুল লেখালেখি আছে। প্রামাণ্য দলিল-
‘বিপ্লবী আসহাব উদ্দীন আহমদ
মানব মুক্তির স্বাপ্নিক পুরুষ’
এ হলো তদীয় পুত্র এনতেজারউদ্দীন আহমদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল; মীরা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ৭৩৬ পৃষ্ঠার বড় গ্রন্থ- দুই বাংলার বহু প্রতিষ্ঠত ও অপ্রতিষ্ঠিত লেখকের রচনা সমগ্র।
“…. ‘বাদলের ধারা ঝরে ঝর্ ঝর্’ দ্বারা আসহাব উদ্দীন আহমদের সাহিত্যিক পরিচয়ের প্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু এ জন্য বৃষ্টি নয়, তিনি কৃতজ্ঞতা জানান খেজুর গাছকে, যে খেজুর গাছের রস ছিল তাঁর ‘সের এক আনা মাত্র’ বইটি রচনার উপাদান। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন- দারিদ্রই তাঁকে মহান করেছে, খ্রীষ্টের সম্মান দান করেছে। তাই দারিদ্রকে বন্ধু সম্বোধন করে তিনি ছন্দসুরে প্রকাশ করেন কৃতজ্ঞতা। এর অনুকরণে অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ বলেন-
হে মোর বন্ধু, খেজুর গাছ
তুমি মোরে করেছ মহান,
তুমি মোরে দানিয়াছ
সাহিত্যিকের সম্মান।
(‘ত্রিভুবনচারী অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ এবং তাঁর রম্য রচনা’, পৃ. ০৯)
আসহাব উদ্দীন আহমদ তাঁর ‘বাদলের ধারা ঝর্ ঝর্’ বই শেষ করেছেন এই বলে-
“একটি আদুরে ছেলের কাছে চিঠি লিখতে বসে যে ছোট্ট একটা বইর আকার পেল তা তোমার আদরের ভাই বোন এদেশের কঁচি কাঁচাদের হাতেই তুলে দিলাম। আর দোয়া করি তাদের থেকে রবি ঠাকুর নজরুলের মত লেখক বেরিয়ে আসুক। আর তাদের লেখায় মূঢ়, মূক, মজলুম মানুষের শত শতাব্দীর মরম বেদনা ঝংকৃত হোক।”
রবি ঠাকুর থেকে ধার করে
বলা যায়,
‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা’
প্রফেসরের স্বপ্ন নিয়ে
‘আধমরাদের বাঁচা’!!
২৮ মে ২০২১
১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮
লেখক- অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও সমাজচিন্তক