BanshkhaliTimes

প্যারেন্টিং সিরিজ || মা হওয়া সহজ নয়

BanshkhaliTimes

মা হওয়া সহজ নয়
সালসাবিলা নকি

মা হওয়া মানে কী? মা হওয়া ব্যাপারটা কি খুবই সহজ?

টিভি সিনেমায় যেমন দেখায়, কনসিভ করার পর চোখের পলকে, হাসি আর গানে সময়গুলো দ্রুত চলে যায়, বাচ্চা দুনিয়াতে চলে আসে। বাচ্চাটাও ঝট করে বড় হয়ে যায়। বাস্তবে কিন্তু মোটেও এমন কিছু হয় না। প্রথম তিনটা মাস (নব্বই দিন কখনও তারও বেশি) মেয়েটির একেকটি দিন কাটে অনেক কষ্টে। সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে চলাফেরা করতে হয়। একটু এদিক সেদিক হলেই গর্ভপাতের আশঙ্ক্ষা থাকে। এরমধ্যে খাওয়ার অরুচি, কিছু খেলেই বমি হয়ে যাওয়া, দুর্বলতা এসব তো আছেই। গর্ভে যে বাচ্চাটা একটু একটু বড় হয় সে মায়ের শরীর থেকে পুষ্টি, খাদ্য শোষণ করে। তাহলে ভেবে দেখুন গর্ভধারণ করার সাথে কত কিছু সম্পৃক্ত।

এরমধ্যে আবার হরমোনাল চেঞ্জের কারণে গর্ভবতী মায়ের দিনগুলো বিষাদে কাটে। কিছু ভালো না লাগা, হঠাৎ হঠাৎ শরীর খারাপ লাগা, সামান্য কিছুতেই প্রচণ্ড মন খারাপ হওয়া এগুলো তখন নিত্যসঙ্গী হয়। সাত-আটতম মাস কাটাতে হয় আরও বেশি কষ্টে। পেটের ভেতর বাচ্চাটা আরও বড় হয়। মায়ের হাটতে কষ্ট হয়, পা ফুলে যায়, রাতে ঘুম আসে না। আয়েশ করে সুবিধামতো শোয়া যায় না। অনেক সময় আটমাস পূর্ণ হলেই বাচ্চা ভূমিষ্ট হয়, কখনও নয় মাস পার করে।

বাচ্চা জন্মদানের কষ্টের সাথে পৃথিবীর কোন ব্যথা বা কষ্টের তুলনা চলে না। অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে একজন মা তার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখান। সে নরমাল ডেলিভারি হোক বা সি-সেকশন। মায়ের শরীরে ব্যথা ও দুর্ভোগের বর্ণনা মা ছাড়া আর কেউই দিতে পারবেন না। এখানেই শেষ নয়। বাচ্চার জন্মের পর মা আক্রান্ত হতে পারেন ‘বেবি ব্লু’ নামক একটি মানসিক রোগে।

গর্ভকালীন সময় মেয়েদের হরমোন ইষ্ট্রোজেন, প্রজেসটোরেন উচ্চমাত্রায় থাকে। সন্তান প্রসবের পর ২৪ ঘণ্টায় এই ইষ্ট্রোজেন, প্রজেসটোরেন হঠাৎ করে কমে যায় এবং আগের অবস্থায় ফিরে যায়। এই দ্রুত হরমোনের পরিমাণ পরিবর্তন হওয়ার জন্য বিষন্নতা সৃষ্টি হয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞগণ। এছাড়া মহিলাদের মাসিক ঋতুচক্রের সময়ও হরমোনের পরিমাণের সামান্য তারতম্যের কারণে মেজাজের পরিবর্তন হয়৷ মাঝে মাঝে থাইরয়েড হরমোনও প্রসব পরবর্তী সময়ে কমে যায়। যেটা বিষন্নতার লক্ষণসমূহ যেমন খিটখিটে মেজাজ, দুর্বলতা, মনোযোগহীনতা, ঘুমের সমস্যা এবং ওজন বেড়ে যাওয়ার মতো সমস্যার সৃষ্টি করে।

এ সমস্যাগুলো পৃথিবীর কোনো বিরল ঘটনা নয়। গবেষকরা বলেন, প্রসবের চার থেকে ছয় সপ্তাহের ভেতর প্রায় ৭৫ শতাংশ প্রসূতি আবেগজনিত সমস্যার মুখোমুখি হন। নতুন মা অস্থিরতা বোধ করেন, অকারণেই মন খারাপ হয়ে যায়, বিহ্বলতা জাগে, সবকিছু যেন বিশৃঙ্খল-এলোমেলো মনে হয়, কান্না পায় প্রায়শই, আবার হঠাৎ করেই খানিকটা সময়ের জন্য উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে, প্রসবের তিন থেকে পাঁচ দিনের ভেতরেই এসব লক্ষণ দেখা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রসব ও প্রসব-পরবর্তী সময়ে নারীদেহে হরমোনের তারতম্য, প্রসবজনিত মানসিক চাপ, মাতৃত্বের দায়িত্ববোধের উপলব্ধি সব মিলিয়েই নারীর এই বিশেষ মানসিক অবস্থাটির সৃষ্টি হতে পারে। স্বস্তির সংবাদ হচ্ছে, এর অধিকাংশই হয়ে থাকে ক্ষণস্থায়ী। কয়েক দিন থেকে সপ্তাহ পর্যন্ত এই লক্ষণগুলো স্থায়ী হতে পারে। প্রসব-পরবর্তী সাময়িক এই মানসিক অবস্থাটির নামই চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়- ‘বেবি ব্লু’ বা ‘পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন’।

এত সব বলার কারণ কী? প্রথমে জানালাম গর্ভ ধারণ করা কোন সাধারণ ব্যাপার নয়। এবং বাচ্চা প্রসবের পরও একটা মেয়েকে শারীরিক-মানসিক অনেক জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু এতো কিছুর পরও একজন মা কি সঠিক মূল্যায়ন পান? সবার সব মনোযোগ থাকে বাচ্চার দিকে। যে মা তাকে গর্ভে ধারণ করলেন, অবর্ণনীয় কষ্ট সয়ে পৃথিবীতে আনলেন, বাচ্চা কোলে একেকটা নির্ঘুম রাত পাড়ি দেন সেই নতুন মায়ের কথা কয়জনে ভাবেন?

একে তো নতুন মা হওয়ার অনুভূতি, বাচ্চার কিছু এক্সট্রা কাজ থাকে সেসবে ব্যস্ত থাকা, খাওয়া-দাওয়ার হরেক রকম বিধি নিষেধ, ঘুমহীন রাত কাটানো, এতসবে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত সেই মেয়েটিকে আবার শুনতে আত্মীয়-পরিজনের নানা রকম কথা।

মা হওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি। কিন্তু মা হয়েই অনেক নারী চলে যান মানসিক ভারসাম্যহীনতার দিকে। এসবের কারণ কী? প্রতিকার কী? এসব নিয়ে বলবে আগামী পর্বে। ততদিন পর্যন্ত চলুন নতুন যারা মা হয়েছেন তাদের দিকে একটু বিশেষ খেয়াল রাখি। তাদের সাথে সহানুভূতিশীল আচরণ করি। যে শিশুটি এসেছে তাকে আমরা যতটা ভালোবাসি তেমনি ভালোবাসি তার মাকেও। তার ভালো লাগা, মন্দ লাগার দিকে একটু খেয়াল রাখি। কারণ, মা শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে ভালো থাকলে ভালো থাকবে আপনাদের আদরের শিশুটি।

নতুন যারা মা হয়েছে তাদের বলব, ‘একটা মেয়েকে জন্মের পর থেকেই নানা কথা শুনে শুনে বড় হতে হয়। যার অধিকাংশই অপ্রিয়। মা হতে পারলেও দোষী, মা হতে না পারলেও সে দোষী। সমাজের আঙুল তার দিকেই তাক করা থাকে। জীবন পথে অনেক অনেক কষ্ট ও যন্ত্রণার সম্মুখীন হতে হবে। কারণ তুমি মেয়ে, তুমি মা, সর্বোপরি তুমি নারী। নানাজনে নানা কথা বলবে। সজ্জনে সুন্দর কথা বলবে। মন্দ লোকে মন্দ কথা বলবে। যেসব কথা তোমার মানসিক অস্থিরতার কারণ সেসব তুমি কানে নেবে না। সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার জন্য তোমাকে বিচক্ষণ ও ধৈর্যশীল হতে হবে। এই সমাজে অনেক কুলাঙ্গার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের বিনাস ঘটানোর জন্য সুসন্তানের প্রয়োজন। সেই সুসন্তান গড়ে তুলতে পারি তুমি, আমি আমরা (মায়েরা) মিলেই… (চলবে)

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *