BanshkhaliTimes

পাহাড়ি সৌন্দর্যে হারিয়ে যাওয়া দিন

BanshkhaliTimes

পাহাড়ি সৌন্দর্যে হারিয়ে যাওয়া দিন

– শেখ সাহাব উদ্দিন (আবাদ)

ছাপার অক্ষরে চোখ বুলিয়ে জীবনের প্রায় চারটি যুগ অতিক্রম করতে চলেছি। তবুও জানার ভিতরে কত ফাঁক-ফোকর রয়ে গেল তা চৌদ্দই জানুয়ারি দুই হাজার বাইশে বুঝতে পারলাম। শৈশবের পড়া ‘পরিবেশ পরিচিতি বিজ্ঞান’ কিংবা কৈশোরের ‘সামাজিক বিজ্ঞান’ বছরের পর বছর পড়ে যে জ্ঞান দিতে পারেনি তা যেন একদিনের পথচলায় আহরণ করে নিলাম।

এ ভূখণ্ডের নানান সম্প্রদায় সম্পর্কে চার যুগের পড়া আর একদিনের দেখার মধ্যে অবশ্যই দেখাটাকেই বেশ ফলপ্রসূ এবং বাস্তবতার নিরিখে নির্ভেজাল মনে হচ্ছে। জাতি বৈচিত্র্য রেখে প্রকৃতির কোলে চড়ে যা দেখলাম তার একটু বর্ণনা দিই। শব্দভাণ্ডারের স্বল্পতার কারণে সুখপাঠ্য নাহলেও নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতা স্মরণে রাখার জন্য এই অপচেষ্টা!

BanshkhaliTimes

১৪ জানুয়ারি, ২০২২। শুক্রবার। চট্টগ্রাম শহর থেকে কাকডাকা ভোরে রওনা দিয়ে ৫.৫০ এ আনোয়ারার অন্যতম জংশন চাতরী চৌমুহনী পৌছে যাই। চাতরী হতে বিখ্যাত ফাইকাস প্রেমী এবং সৌখিন উদ্ভিদ গবেষক আবদুল্লাহ আল হারুনকে সাথে নিয়ে পৌণে এক কিলোমিটার গিয়ে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে পরিচিত পেশাজীবি এবং দেশের নেতৃস্থানীয় সংবাদপত্রের আনোয়ারা-বাঁশখালী প্রতিনিধি মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেনকে শীততাড়ানো গান গাওয়া অবস্থায় গাড়িতে তুলে নিই। অতঃপর আনোয়ারা -বরকল রাস্তা ধরে প্রায় দশ কিলোমিটারের গিয়ে অত্র অঞ্চলের বিখ্যাত পর্বতারোহী এবং এডভেঞ্চার প্রিয় নীল জামশেদ আমাদের সাথী হন। চালকের আসনে বসে আমি এবং যাত্রাসঙ্গী অপর তিনজন গান শুনতে শুনতে পৌণে আটটায় বান্দরবান পৌরসভায় পৌঁছে যাই। পথে ছিল সুকুমার বাউল, শাহ আবদুল করিম, লালন শাহ, উকিল মুন্সির রচিত হৃদয়গ্রাহী গান।

বান্দরবান সদরে অনেকটা আটপৌরে সকালের নাস্তা পর্বের পর গাড়ির ফুয়েল ভর্তি করে সামান্য বিশ্রামের কাজটিও সেরে নিয়ে নয়টায় রওনা দিই থানচির উদ্দেশ্যে।

 

কিছদুর গিয়ে শতবছরের পুরনো বটতলায় দাড়িয়ে বৃক্ষপ্রেমী হারুন সাহবের বৃক্ষতলে শয়ন আর আমরা যাত্রী ছাউনিতে ক্ষণিকের তরে জিরিয়ে নিলাম। পথে দেখা হলো পাহাড়ি স্মার্ট তরুণদের স্বপ্নের বাহন মটরসাইকেলে ভ্রমণপিপাসু একজোড়া কপোত-কপোতী, যারা আমাদের গন্তব্যের পানে কিংবা তার জন্মভিটায় যাচ্ছে। বাইকের চালকের আসনে বসা পাহাড়ি ভাইটি আগে থেকেই হারুন সাহেবের পরিচিত। সুতরাং বাইক থামিয়ে হালকা শুভেচ্ছা বিনিময় আর বাইকারোহী অপরূপা, অনন্যা, প্রকৃতি-দুহিতা সেই পাহাড়-পরী সমেত ফটোসেশান।

বিশ মিনিটের বিশ্রাম শেষে আবার যাত্রা শুরু। এখানে বলে রাখা ভাল বান্দরবান টু থানচি সড়কটি পুরোটাই সর্পিলাকৃতির। সামনের পানে তাকালে একসাথে দুইশত গজের বেশী দেখা যায়না বললেই চলে। উঁচু-নিচু পথ বেয়ে চিম্বুক পাহাড়ে গিয়ে সুর্যাস্ত দেখার মজা আমরা উপভোগ না করলেও যারা ওখানকার বিলাসবহুল রিসোর্টে রাত্রি যাপন করেন তাদের সুখানুভব আমাদের মনেও দোলা দিয়ে গেল।

চিম্বুক পাহাড় পেরিয়ে জালিয়া পাড়ায় পাহাড়ের পাদদেশে বাঁশ-কাঠের তৈরি এক পাহাড়ি ভাইয়ের দোকানে পাকা পেঁপে খেয়ে চারজনেরই রসনা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলল। দোকানের মাচা হতে দুর পাহাড়ের মাঝে নিরিবিলি শান্ত ছেলের মত বয়ে চলা সাঙ্গু নদী আমাদেরকে যান্ত্রিক নগর জীবনকে ক্ষনিকের তরে ভুলিয়ে দিল। সঙ্গী হারুনের পছন্দ আমলকি চা, মোরশেদের পছন্দ পুদিনা চা, নীল জামশেদের পছন্দ প্রকৃতির ছবি ধরে রাখা আর আমি তো সৌন্দর্যের আতিশয্যে কিছুক্ষণ স্বরযন্ত্রের নিঃশব্দ অবস্থায়। চার সঙ্গী যেন আস্তে আস্তে ‘প্রকৃতিপুত্র’ হয়ে যেতে লাগলাম।
যাওয়ার পথেই ওয়াই-জংশন। রুমা যাওয়ার রাস্তা। প্রকৃতি যে কিভাবে নিজেকে সাজিয়ে হৃদয় হরণ করে তা পাহাড়ের পরতে পরতেই অনুভব করতে লাগলাম। আরো কিছুদুর গিয়ে ‘নীলগিরি’। নীলগিরি নগরের সৌখিন পর্যটকদের কাছে অনেক চেনাজানা তাই নীলগিরির সৌন্দর্য ফেরার সময়ে উপভোগের জন্য রেখে আমরা এগুতে লাগলাম। তাছাড়া সন্ধ্যার নীলগিরিতে সুর্যাস্ত দর্শনের মনোবাসনাও ছিল বলেই ফিরতি পথে নীলগিরিতে নিজেদেরকে বিলিয়ে দিলাম।

থানচির পথে অকৃত্রিম আদিবাসী নারী-পুরুষের পাহাড়ি পথে জুম ক্ষেতে যাতায়াতের দৃশ্য শহুরে জীবনের যান্ত্রিকতা ভুলিয়ে দিলো।
দেখা মিললো পিঠে বেতের ঝুঁড়ি নিয়ে জীবিকার সন্ধানে বের হওয়া নারীর দল। তাদের পুরুষরা হয়তো ঘরে বাচ্চা সামলাতে ব্যস্ত। আবার কোথাও নারীপুরুষ মাথায় ঝুটা বেধে একসাথে (মুরং সম্প্রদায়) স্বল্প বসনে নিত্যদিনের মতো গহীন অরণ্যে যাত্রা করছে।
বান্দরবান থেকে প্রায় ৬০ কি. মি. গিয়ে বলিপাড়া বিজিবি ক্যাম্প। ওখানে নাম ঠিকানা সহ গন্তব্যের স্থান এবং উদ্দেশ্য জানাতে ব্যস্ত ছিলেন নীল জামশেদ। এদিকে বৃক্ষপ্রেমিক হারুন সাহেব আর সাংবাদিক মোরশেদ সাহেবের সনে আমি ফটোসেশানে ব্যস্ত। ফাঁকে ফাঁকে একের পর এক আমলকি, তেঁতুল, জলপাইয়ের নির্ভেজাল জুস।

পথে পথে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্য পাহাড়ি তেঁতুল, পেঁপে জাম্বুরা প্রভৃতি নিয়ে মোরশেদ সাহেবের গানের সুরে তালে কিংবা বেতালে গলা মিলিয়ে যখন আমরা থানচি পৌঁছাই তখন বেলা ২.২০। থানচি নেমে দেড়শত কিলোমিটার উজানের সাঙ্গুকে দেখে মন ভরে গেল। নদীর ভাঁজে ভাঁজে শীতকালীন সব্জি বুকে নিয়ে সদ্য ভূমিষ্ট শিশুকে দুগ্ধ দানরত মাতৃরুপে কোমলমতি সাঙ্গু। এই সাঙ্গুই বর্ষায় পাগলা গণ্ডারের বেশে ছুটে চলে।
থানচির পাহাড়ি ভাই রেং হাই, সীং মেন ম্রোসহ কয়েকজনের সাথে বিকেলের অনেকটা সময় কাটিয়ে যখন ফেরার পথ ধরি তখন মনে হয় ইচ্ছের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই যেন জীবিকার তাগিদে ইট-পাথরের নগরীতে ফেরা।

লেখক – ব্যাংকার, ভ্রমণপ্রেমি

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *