সোনার দাঁত
-পান্থজন জাহাঙ্গীর
১
বিয়ে করার বড় শখ ছিল সোনা মিয়ার কিন্তু করা হলো না কারণ মেয়ে পছন্দ করতে করতে দিন গেল তার। তার বাপের বড় অাপসোস তাকে বিয়ে করাইতে পারলে না। তিনি এখন রাগ করে শপথ করে ফেলছে তার জন্য আর মেয়ে দেখবে না। কারণ যেই মেয়েই দেখা হোক না কেন সে একটা না একটা খুঁত ধরবেই। তাই তার জন্য মেয়ে দেখা পন্ডশ্রম- তা ভেবেই তিনি দাঁতে দাঁত কামড় দিয়ে রইলেন। অকৃতদার পুত্রের শোকে শোকে এক সময় তিনি মারা গেলেন। এরপর থেকে সোনার মিয়ার কাছে বিয়েটা রূপকথার গল্পে পরিণত হলেও অন্যের কাছে তা রম্য গল্পে পরিণত হল। সোনা মিয়ার বয়স গেল,চুল পাকল,দাঁত পড়ল। চোখ কোটরে ঢুকল,হাতের ও মুখের রেখাগুলো ভেসে উঠল কিন্তু বিয়ে করার শখ তার মিটল না। কারণ বিয়ে সে করবে না একথা সে কখনো বলেনি। আর এখানেই যতসব ঠাট্টা আর রহস্য লুকিয়ে আছে। তাই এখন সে মানুষের ঠাট্টার বস্তু। সবাই এ নিয়ে তাকে ভেঙায়। সোনা মিয়া এক সময় এগুলোতে প্রচন্ড রেগে যাইত। রাগের মাথায় আবার অনেক কে দা কিরিচ নিয়ে তাড়া করতো। এখন কিন্তু তেমন রাগে না। চুপ চুপ নিজ কাজে যায়। আর মনেযোগ দিয়ে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তিতে খামার গড়েছে। মন দিল উজাড় করে নিজের খামারে কাজ করে। তার অায় উন্নতি দেখে অনেকের আবার ঈর্ষাও’ হয়। পাড়ার কৃষক রহিমুদ্দিন ডাক দেয়, “কি হে সোনা মিয়া এত টাকা পয়সা কারে খাওয়াইবা? বউ পোলা তো নেই। ” সোনা উত্তর দেয়,” লাগবো চাচা। আমার অনেক টাকা লাগবো কারণ, আমার সামনের দাঁত দুইটা বাঁধাইতে হইব। শহরে গিয়েছিলাম দাতেঁর ডাক্তারের কাছে খুব যত্ন কইরা দেখছে আমারে চাচা। এসি রোমে বসে ডাক্তার। আমেরিকায় পড়াশুনা। তিনি কইছে সামনের খালি জায়গায় দুইটা একেবারে সোনার দাঁত লাগাইতে। অনেক টেহার দরকার চাচা। ”
-কত নিবে?
– আশি হাজার টাকা।
-এত টাকার দাতঁ নিয়া কি কইরবা?
-কেন চাচা? বিয়া করমু। ডাক্তার কইছে দাঁত লাগানোর সাথে সাথে মাইয়া পামু। মাইয়ারা আমার পিছে নাকি ঘুর ঘুর কইরবো।
-তাই নাকি?
-হ চাচা।
-ঠিক আছে লাগাও।
২
সোনা মিয়ার আশি হাজার টাকা জোগাড় করতেই হবে । খুব শখ ধরেছে তার। সে রাত দিন নিজের খামারে খাটতে লাগল। দুইটা শৌখিন হালের গরু বিক্রি করে দিল। তারপর আরো কিছু শস্য দানা।
সন্ধ্যা এসে চায়ের দোকানে চা সোনা মিয়া চা খায়, আড্ডা দেয়। কেউ কেউ তাকে চ্যাতায়,
– কি মিয়া দাঁত কখন লাগাইবা,বিয়া কখন কইরবা?
সোনা মিয়া চা খায় আর জবাব দেয়,
-আর বেশি দেরি নাই। দাঁত লাগাইয়া দেখামু। বিয়াও কইরা দেখামু।
পরের সপ্তাহ সোনা মিয়া আরেকটি ছাগল বিক্রি করে দিল। এর পরের সপ্তাহে সোনা মিয়া চা দোকানে বসে ক্লোজ আপ মার্কা হাসি দিতে লাগল। সোনা বলল, দেখো মিয়া কইছিলাম না দাঁত বাধাঁবো? এই দেখ, হি হি হি…। সবাই সোনামিয়ার মুখে টর্চের আলো ফেলে বিস্ময়ে দেখতে লাগলো দুটো চকচকে সোনার দাঁত। অনেকে বলতে লাগলো –
মানুষ খাইতে পারছেনা আর তুই সোনার দাঁত বাধাঁলি!
-আর মানুষ খাইতে না পারলে কি অইব? বিয়া তো ঠিকই করছে। ছা পোনা জম্মাইচে। আমি তো তাও করতে পারিনি। হি হি হি…।
-ঠিক আছে উত্তম কইছো। তবে সাবধান থাইকো মিয়া এলাকায়। হুনছি শহরে নাকি হাই জ্যাকারা এই রকম সোনার দাঁতও খুইলা লয়।
-তাই নাকি?
-হ, হ।
-তাইলে আমি আর কহনো শহরে যাইবো না চাচা। -হ সাবধান থাইকো।
পাশে বসে নিরবে শুনছিল মেম্বারের নেশাখোর পোলা সুমন্যা। নেশার টাকা যোগাইতে তাকে কত ফন্দি ফিকির করতে হয়। বাপের পকেট, মায়ের চুড়ি,বোনের ঈদের জামার জন্য বহুদিনের পাই পাই করে জমানো টাকা,অথবা প্রতিবেশি ঘরের চালে ফলানো নিটুল কুমড়াটি অথবা কারো খামারের হাঁস মুরগি ইত্যাদি। কিন্তু এগুলোতে তার বেশিদিন চলে না। ইদানীং ইয়াবাত মজে বুদ হয়ে আছে। সঙ্গে আছে তার একটা বিশাল চক্র। সে মনে মনে ভাবে এইবার যদি সোনারে সে কুপোকাত করতে পারে বহুদিন নেশা করা যাবে। শুধু দরকার একজন সাহসী সঙ্গী এবং একটি প্লায়ার্স। সোনা মিয়ার বিচরণের মানচিত্র সে নিখুঁতভাবে একেঁ ফেলল।
সে সোনা মিয়ার গা ঘেষে বসল এবং অান্তরিকতার সাথে বলল,
– সোনা ভাই, অ সোনা ভাই কি খবর কেমন আছেন?
– কি আর থাকব?
দেখেন না, ই ই করে সোনা মিয়া দাঁত দুটো বের করে দেখাল। সুমন বলল,
-হ ভাই দেখছি তো সোনার দাঁত লাগাইছো। হ খুব সুন্দর লাগছে ভাই। আচ্ছা ভাই বলতো এই দাঁতগুলো কি উঠানো যাইবো?
-না ভাই। এগুলো স্থায়ীভাবে লাগাইছি। এই দেখেন ইহি…..।
-হ ভাই। চল মজা করে এক কাপ চা খাই। এই বাবলু আমাদের দু’ কাপ ভালো করি চা দাও। দুই ভাই আরাম করে খাই।
-আচ্ছা ভাই বলতো তুমি খামারে কখন যাও?
– কেন সকাল সকাল তো যায়। কেন জিজ্ঞেস কইরছো মিয়া?
-না এমনে, কারণ তুমি অনেক পরিশ্রম কইরো তো তোমার জন্য মায়া লাগে ভাই। এই জীবনে তোমার তো আর কেউ নেই। মাকে তো আগেই হারাইছো। গত বছর হারাইলা বাপটাকে। আমরা ভাই বেরাদর তোমার খোঁজ না নিলে কে নিব ভাই? সোনার মিয়ার ভিতরটা যেন হঠাৎ ধপ করে জ্বলে উঠল। বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে।
৩
সোনা মিয়া সোনার বাধাঁই করা দাঁত নিয়ে সপ্তাহ খানেক রোমাঞ্চেই কাটালো। কিন্তু গোল পাকালো পরের সপ্তাহে। রাতে খুব বেশি বেশি দু: স্বপ্ন দেখল সে। কিছুক্ষণ পর পর গা কাঁটা দিয়ে ঘুম ভাঙে সোনা মিয়ার। সে স্বপ্ন দেখলো তার বাবা তাকে লাঠি দিয়ে দৌঁড়াচ্ছে। খামারে যাওয়ার জন্য। তাই সে দোয়া পড়ে পড়ে সিনায় ফু দিল আর ভাবলো তার খামারটির কথা। আগেও বেশ কয়েকটা গরু চুরি হয়েছে। তার মনে কু ডাকতে লাগলো। সব ঠিক আছে তো? গরু ছাগল সহ অনেক ধন সম্পত্তি রয়েছে তার। মানসিক দুশ্চিন্তা তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল। আর বেশি ঘুমাইতে পারল না। তাই খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে খামারের দিকে রওয়ানা দেয় সে। কিন্তু বেশিদূর এগুতে পারেনি । দুই পাহাড়ের মাঝে একটা সুড়ঙ্গ পথ এবং উপরে লতা পাতা ঝোপঝাড়ের ঘন চাঁদোয়া। এই পথ অতিক্রম করে তাকে তার খামারে যেতে হয়। যখন এ পথে সে পৌঁছলো তখনই পেছন থেকে এসে ঝাপটে ধরল তাকে আর বলল, “শালার পুত একদম চিল্লাচিল্লি করবিনা। বেশি দাপাদাপি করলে ছুরি ঢোকামু পেটে। ” সোনামিয়ার দেহে বন্যশক্তি। সে এক ধাক্কায় দু জন কে দু দিকে ফেলে দিয়ে দৌঁড় দিল কিন্তু দৌঁড়ে পালাতে গিয়ে নিজের লুঙ্গিতেই নিজে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। এ সুযোগে সুমন্যা এবং বাবলু এসে তার বুকের উপর বসে পড়ল এবং আর ছুরি হাকিঁয়ে বলল, “মাদারের বাচ্চা আমি মেম্বারের পোলা সুমন্যা কইতেছি বেশি নড়াচড়া করলে একেবারে জবাই দিমু। ঐ বাবলু প্লায়ার্স দে। কর হা কর কইতেছি, হা কর। ” এরপর হোটেল বয় বাবলু কুরবানি গরুর মতো সোনা মিয়ার মাথাটা শক্ত করে ধরে রইল আর মেম্বারের পোলা সুমন্যা বুকের উপর বসে সোনার দাঁতে প্লায়ার্স বসিয়ে জোরে জোরে টানতে লাগলো। সোনা মিয়ার আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হল কিন্তু কেউ এগিয়ে আসলো না।