BanshkhaliTimes

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) ও আদর্শ

BanshkhaliTimes

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) ও আদর্শ

প্রফেসর ড.আ.ম কাজী মুহাম্মদ হারুন উর রশীদ

আরবি বর্ষপঞ্জির ১২ রবিউল আউয়াল মুসলিম বিশ্বে এক আবেগময় আবহ সৃষ্টি করে। কারণ এ তারিখে আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (দ.) এর আবির্ভাবের আনন্দ ও তিরোধানের বেদনা বহন করে আনে। আজ ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র মিলাদুন্নবী (দ.) মানব ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ দিবস। রাহমাতুল্‌লিল আলামিনের পৃথিবীতে আগমন মানব জাতির জন্য আল্লাহর অপার অনুগ্রহ। এ স্মৃতি বিজড়িত দিবস শুধুমাত্র মুসলিম নয়; বরং জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পুরো মানব জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমণ্ডিত । ‘মিলাদুন্নবী’ আরবি দ’ুটি শব্দের গঠিত একটি যুক্ত শব্দ। যার অর্থ নবী (দ.)-এর জন্ম। আজ থেকে চৌদ্দশ’ বছর আগে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশে আমিনার গর্ভে হজরত মুহাম্মদ (দ.) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের আনন্দে আলো উদ্ভাসিত হয়েছিলো। হজরত জিবরাঈল (আ.)সহ সকল ফেরশতাগণ নভোমণ্ডলে ও ভূমণ্ডলে তাঁর আবির্ভাবের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালার আরশ, লওহে মাহফুজ ও মহাকাশে ছিলো খুশির বন্যা। রাসুলুল্লাহ সারা বিশ্বের জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার-অনাচার, অবিচার ও ঝগড়া-ফ্যাসাদের মূলোৎপাটন ঘটিয়ে সত্য ন্যায়ের শিক্ষা ও আদর্শ স্থাপন করে গেছেন।
আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (দ.) ছিলেন সর্বশেষ নবী ও রাসুল । তাঁর আবির্ভাবের ব্যাপারে পৃথিবীর সব জাতিই কম-বেশি জানতেন। প্রত্যেক নবীই তাঁর আগমন সম্পর্র্কে ভবিষদ্বাণী করে গেছেন। চৌদ্দশ’ বছর আগে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (দ.) এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হন, যখন সমগ্র পৃথিবী অন্ধকারের অতল সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিলো। মানব সভ্যতার লেশমাত্রও অবশিষ্ট ছিলো না এবং ন্যায় বিচার বলতে কিছুই ছিলো না; বরং হিংসা-বিদ্বেষ, যুদ্ধ-সংঘাত, অত্যাচার-অনাচার, চুরি-ডাকাতি, হত্যা-রাহাজানি, সর্বপ্রকার অন্যায়, অপকর্ম ও পাপাচারে মানুষ লিপ্ত ছিলো। কোথাও ছিলো না শান্তি, ছিলো না কোথাও স্বস্তি। চলছিলো মানুষে মানুষে হানাহানি, কাটাকাটি দুর্বলরা শক্তিধরদের অত্যাচার ও নির্যাতনে জর্জরিত হচ্ছিলো। ধর্মের নামে সর্বত্র বিরাজ করছিলো শিরক, কুফর আর ধর্মহীনতা। নারী সমাজ পরিণত হয়েছিলো পণ্য সামগ্রীতে। তাদের ব্যবহার করা হতো আসবাবপত্রের মতো। তাদের ছিলো না কোনো অধিকার, ছিলো না কোনো মর্যাদা। মানবিক মূল্যবোধ বলতে কোথাও কিছু ছিলো না। অরাজকতাপূর্ণ এক অস্থির পৃথিবীতে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সোবহে সাদিকের সময় সমস্ত বিশ্বজগত আলোকোজ্জ্বল করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন পবিত্র কুরআনের ধারক ও বাহক, বিশ্ব জাহানের মুক্তির দিশারী, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, রাহমাতুল্লীল আলামিন, খাতামুন নাবীয়ীন, মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
রাসুল (দ.)-এর আগমনে ধন্য হয়েছিলো সমগ্র মাখলুকাত, মুখ থুবড়ে পড়েছিলো দীর্ঘকালের যাবতীয় অন্ধকার এবং বিকশিত হয়েছিলো সত্য সুন্দর হেদায়াতের সমুজ্জ্বল রশ্মি। যুগ, কাল ও মহাকালের বিবর্তনশীল পৈঠায় দাঁড়িয়ে যাঁর আগমনের জন্য জগত অপেক্ষার প্রহর গুনছিলো। যাঁর সান্নিধ্য ও সংস্পর্শ লাভের আশায় কুল-মাখলুকাত ছিলো উদ্বেল। তিনি আগমন করেছিলেন বিশ্ববাসীর জন্যে আল্লাহ পাকের অনন্ত অসীম রহমতের জীবন্ত প্রতীক হয়ে এবং বহন করে এনেছেন বিশ্ব মানবতার জন্যে চিরশান্তি ও চির নাজাতের পয়গাম। তাঁরই উছিলায় সৃষ্টি হয়েছে মানব-দানব, জ্বীন-ফেরেশতা, আকাশ-বাতাস, গ্রহ-নক্ষত্র, গাছ-পালা, নদ-নদী, পশু-পাখি, পাহাড়-পর্বত, জীব-জন্তু, আরশ-কুরসি, লওহ-কলম বলতে গেলে সমুদয় সৃষ্টি জগত।
চৌদ্দশ’ বছর আগে রাসুলে কারিম (দ.) আজকের এই দিনে আগমন করার কারণে এ দিনটি রাসুলুল্লাহর আশেকানদের মনকে উতাল-পাতাল করে তোলে এবং অনাবিল আনন্দের জোয়ার সৃষ্টি হয়। চারিদিকে ধ্বনিত হয় রাসুলুল্লাহর (দ.)-এর সম্মানে সালাত ও সালাম। আর মুসলিম সমাজে আলোড়িত করে তোলে তাঁর জন্ম থেকে ওফাত পর্যন্ত তেষট্টি বছর হায়াতের ওপর আলোচনা সভা, মিলাদ মাহফিল, সিরাত মাহফিল, সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি।
আজকের এই দিনটি রাসুল (দ.)-এর শুভাগমনের জন্যেই শুধুমাত্র জাতির ইতিহাসে সমুজ্জ্বল নয়; বরং দু’জাহানের নবী হজরত মুহাম্মদ (দ.) আজকের এইদিনে রেসালতের গুরু দায়িত্ব সুসম্পন্ন করে পৃথিবীবাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে নশ্বর পৃথিবী থেকে অবিনশ্বর জগতে আল্লাহপাকের সান্নিধ্যে ফিরে গিয়েছিলেন। সেদিন আকাশে বাতাসে যেনো স্বজনহারা বেদনার করুণ সুর বাজছিলো। আকাশে-বাতাসে নেমে আসছিলো এক ভাবগম্ভীর পরিবেশ। প্রিয়নবী (সা.) তাঁর প্রভুর দরবারে চলে গিয়েছেন এবং তার উম্মতের জন্যে রেখে গেছেন মহাগ্রন্থ আল-কুরআন, তাঁর সুন্নাত এবং জীবনাদর্শ। যে আদর্শের মাধ্যমে তিনি পৃথিবীবাসীকে উপহার দিয়েছিলেন একটি সুখী সমৃদ্ধশালী শোষণমুক্ত শান্তিময় সমাজ। যে সমাজে তিরি মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অপার এক ভ্রাতৃত্ববোধ। নিশ্চিত করেছিলেন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা।
আল্লাহপাক গোটা বিশ্ব জগতকে সৃষ্টি করার পর স্বীয় প্রদত্ত ও প্রকৃতিসম্মত আদর্শিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের জন্য যুগ যুগ ধরে আদর্শ মহাপুরুষদের পাঠিয়েছেন। তাঁরা যেমন ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ আদর্শ মানব; তেমনি ছিলেন স্ব স্ব যুগের মানবতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। আল্লাহ প্রদত্ত ওহী দ্বারা তাঁরা মানুষকে আদর্শ শিক্ষা দিয়েছেন। সুতরাং প্রত্যেক নবী বা রাসুলই ছিলেন উজ্জ্বল আদর্শের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। নবীদের ক্রমধারা আল্লাহপাক স্বীয় পূর্ব পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিশ্ব জাহানের মানুষের মুক্তির দিশারী ও সত্য পথ প্রদর্শক, ন্যায়ের প্রতীক, মানবতার মুক্তিদাতা, সমাজ সংস্কারক, রাষ্ট্রনায়ক, যোদ্ধা, সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান-গুণের অধিকারী এবং অনুপম আদর্শের নিদর্শন সায়্যিদুল মুরসালিন, রাহমাতুল্লিল আলামিন প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (দ.)-কে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুদ্ধ অস্থির ধরায় প্রেরণ করেছেন।
নবী করিম (দ.) এসেই ঘোষণা দিলেন ‘বুয়েসতু মুয়াল্লিমান’ আগত অনাগত সকলের জন্যে আমি শিক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছি।-(সুনান ইব্‌ন মাজাহ, হাদিস নং-২২৯) শিক্ষক হওয়ার জন্য যেসব মৌলিক গুণাবলীর প্রয়োজন তার পরিপূর্ণ বিকাশ নবী কারিম (দ.)-এর মাঝে বিদ্যমান ছিলো। বিশ্বনবী রাসুলে কারিম (দ.)-এর জীবনাদর্শ বর্ণনাতীত। তিনি ছিলেন মহাগ্রন্থ আল- কুরআনের ধারক ও বাহক। কুরআনই হচ্ছে নবী (দ.)-এর জীবনাদর্শ। তাঁর আদর্শ সম্পর্কে কুরআনুল কারিমে স্বয়ং আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন ‘ইন্নাকা লাআলা খুলকিন আজিম।’ ওহে আল্লাহর নবী! নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ চারিত্রিক গুণাবলীর উপর অধিষ্ঠিত।-(সুরা আল-কলম, আয়াত-৪) কুরআনুল করিমের মধ্যে আল্লাহপাক আরও বলেছেন ‘লাকাদ কানা লাকুম ফি রাসূলিল্লাহি উসওয়াতুন হাসানাহ।’ অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসুলগণের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্যে উত্তম আদর্শ।- (সুরা আহজাব, আয়াত-২১)। মহানবী (দ.)-কে শিক্ষকের মহান গুণাবলী দিয়ে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করেছেন বিধায় আল্লাহ তায়ালা নবীদের আদর্শের রঙে রঙিন হওয়ার জন্যে আহবান জানিয়েছেন।
আমাদের চারপাশের জগতে যে সকল আদর্শ ব্যক্তির সন্ধান পাই তাদের আদর্শবাদীতাকে অস্বীকার করা যায় না। তবে আমাদের দেখতে হবে যে, একটি মানবসত্তার সবগুলো দিক মানবিক গুণাবলীর দ্বারা কতটুকু পরিপূর্ণ। বিভিন্ন আদর্শবান ব্যক্তিদের মাঝে একদিকে আদর্শের ছোঁয়া লাগলেও অন্যদিকে যাবতীয় দিক অতৃপ্ত, অপূর্ণ এবং ব্যর্থ পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু আমরা যখন সর্বোত্তম আদর্শের শ্রেষ্ঠতম প্রতীক নবী কারিম (দ.)-এর দিকে তাকাই, তখন দেখি তিনি কেমন মর্যাদাবান এবং কেমন আদর্শবান পুরুষ। তাঁর পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন ও আন্তর্জাতিক জীবন চির অম্লান আদর্শের অমৃত ধারা সর্বত্র বিরাজমান। তিনি এক বৃহৎ রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েও তাঁর ইন্তেকাল দিবসে নিজ ঘরে তেলাভাবে বাতি জ্বলেনি।
আজ এ পৃথিবীর মানুষ যেখানে এক পশলা শান্তির জন্য দিক বিদিক ছোটাছুটি করছে, শান্তি নামের অশান্ত কড়াইয়ে উত্তপ্ত অনলে দগ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেখানে একমাত্র শান্তির অগ্রদূত প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা (দ.)-এর জীবনাদর্শই নিশ্চিত করতে পারে কাঙ্ক্ষিত শান্তি নামের শ্বেত কপোতটিকে। এ মহান স্মৃতিবিজড়িত মাহে রবিউল আউয়ালকে শুধুমাত্র সভা, সামবেশ, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে এবং বছরের একটি মাস রাসুল (দ.)-এর মিলাদ ও সিরাত বর্ণনা করে আমাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল হবে না; বরং এ মাহে রবিউল আউয়ালকে আমাদের নবীজীর আদর্শ অনুকরণ ও অনুসরণের একটি প্রেরণার উৎসে পরিণত করতে হবে। সারাবিশ্বে অনৈক্যের রজ্জুয় দোদুল্যমান মুসলিম জাতিকে ঐক্যের মজবুত প্লাটফরমে জড়ো করার দীপ্ত শপথ গ্রহণের মাসই হলো এ রবিউল আউয়াল।
আসুন, আমরা সকলেই পবিত্র মিলাদুন্নবী (দ.) উপলক্ষে আমাদের প্রাণপ্রিয় বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ (দ.)-এর প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা, অশেষ ভক্তি ও হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা সুদৃঢ় করি এবং রাসুল (দ.)-এর আশেক হই। আর আমাদের প্রিয়নবী (দ.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণে সচেষ্ট হই এবং একটি সুন্দর, সুখী সমাজ প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হই। আল্লাহপাক আমাদের তাওফিক দান করুন। আমীন

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক; প্রফেসর, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *