পথশিশুদের নিয়ে কাজের চেয়ে বাজনা বাজে বেশি
⚫ রায়হান আজাদ
ছোটদের প্রতি প্রীতি ও ভালবাসা আমার স্বভাবজাত। অসহায়-ইয়াতিম শিশুর জন্য সদা মন কাঁধে। আজন্ম দুর্বলতা রয়েছে তাদের জন্যে। এমফিল শিরোনাম নিয়েছি যাকাতের অর্থে পথশিশুর পুনর্বাসন প্রক্রিয়া। করোনার ক্রান্তিকালে ২ বছর থমকে গিয়েছিল গবেষণা। এখন সুপারভাইজার স্যার দিচ্ছেন নিয়ত তাগাদা। গবেষণার একটি অংশ ফিল্ডওয়ার্ক -In depth Interview। আজ যাই কাল যাই করে বহুদিন ধরে যাওয়া হচ্ছিল না পথশিশু সন্ধানে পথে-প্রান্তরে। শেষতক নেমে পড়লাম। স্টেশনগুলো পথশিশুর অভয়ারণ্য, বিশেষত রেল স্টেশন। আজ দুপুরে ঠা ঠা রোদে চট্টগ্রাম বটতলী রেল স্টেশনে গিয়ে ৬নং প্লাটফর্মের কিনারাই পেয়ে যাই পথশিশুর ছোট্ট একটি গ্রুপ। তাদের সাথে কথোপকথনে আমার গা শিউরে ওঠে। প্রত্যেকের পরিবারে রয়েছে করুণ কাহিনী। ওরা ৬ জন। ওদের নাম রবিউল,মারুফ, ফেরদৌস আসিফ, সালাহ উদ্দীন ও আরাফাত। তাদের কারো বাবা নেই, কারো মা নেই- ঘরে সৎ মা, কারো বাবা-মা দুজনেই আছে কিন্তু তারা অভাব-অনটনে সন্তানের দেখভাল করতে পারে না, কারো বাবা অসুস্থ, মা ঝিয়ের কাজ করে। কারো আবার একসিডেন্টে অঙ্গহানি ঘটেছে।
আমি আলাপে আলাপে তাদের আপন হয়ে গেলাম। তারা আমাকে গান শুনাল। আমিও তাদেরকে চিপস্ খাওয়ালাম। একটা ছেলে চিপস্ পায়নি। সে বললো, আমি তো গান শুনিয়েছি; আমাকে তো চিপস্ দেয়া হয়নি। অবশ্যই চিপস্ বন্টনের সময় একটি ট্রেন আসায় সে ও আরো ক‘জন খালি বোতল কুড়ানোর জন্য ভোঁ দৌড় দেয়। তাকে আমি বিশটি টাকা দিলাম। এরপর প্লাটফর্ম পেরিয়ে ওভারব্রীজে আসতেই দেখি সে সিঁড়িতে বসে মনের সুখে সিগারেট টানছে। আমাকে দেখে চম্পট। আমি আরো কতিপয় পথশিশুর গতিবিধি লক্ষ্য করি। দেখলাম, শিশু শিশুই। তাদের কোন দু:খ নেই। সবাই একটুকু খাবারের জন্য কাড়াকাড়ি করছে, আবার কেউ রেলযাত্রীর ফেলানো উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে খাচ্ছে।
গল্পটি না বলে পারছি না। গল্পের মূল চরিত্র নাজমা। তার বাড়ি বরিশালে। তার স্বামীর ছিল আরো এক স্ত্রী। সে স্ত্রী স্বামীর সাথে রাগ করে ঘুমের বড়ি খেয়ে ট্রেনের নীচে পিষ্ট হয়েছে। তার কোলে ছিল ১ মাসের এক সন্তান। সন্তানটি মা রোকসানার পেটের মধ্যিখানে ছিল। এ সন্তানের এক পা পিষে গেছে। নাজমা তার সতীনের এ এ মুমূর্ষূ শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে ২ মাস চিকিৎসা দিয়ে এক পা কেটে ফেলে জীবনে বাঁচিয়েছে। এ বাচ্চা মেয়ের নাকি ২বার অপারেশন লেগেছে; ৬ ব্যাগ রক্ত প্রয়োজন হয়েছে। বড়মা নাজমা এ বাচ্চাটির নাম রেখেছে রুপালি। রুপালি এখন ৪ সৎ ভাইবোনের সাথে বস্তিতে বড় হচ্ছে। তাদের বাবা অসুস্থ। সুস্থতা লাগলে মাঝে মাঝে ডেকোরেশনের দোকানে কামলা খাটে। আয়-ব্যয় সামলাতে না পেরে নাজমা এখন তার সকল সন্তান নিয়ে প্লাস্টিকের বোতলের খোঁজে রেললাইনেই সারাদিন কাটিয়ে দেয় । তাকে বাচ্চাদের পড়াশোনার কথা বললে সে বলে, যেখানে তিনবেলার মধ্যে একবেলার খাবার জুটাতেই দিন শেষ সেখানে কিসের পড়াশোনা?
পথশিশুদেরও প্রতিভা আছে। কিন্তু এ প্রতিভার পরিচর্যা নেই। পরিবার থেকে ছিটকে পড়ায় ওরা বাঁধনহারা, ওদের কাছে আইন-কানুনের ভালাই নেই । ‘যেখানে রাত সেখানে কাৎ’- তাদের জন্যে এটাই শোভা পায়। নাজমা বলে, যাদের গ্রæপ আছে তারাই সরকারি/এনজিও’র সাহায্য পায়। যারা সাহায্য দেয় তারা মুখ দেখে দেখে দেয়। পথশিশুর কল্যাণে কাজ করা সংগঠনগুলো লোক দেখানো কতিপয় উন্মুক্ত পাঠশালা পরিচালনা করে কিংবা তারা একবেলা/দুইবেলা আহারের ব্যবস্থা করে। এতে তাদের কোন সমস্যার সমাধান হয় না।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় পথশিশু নিয়ে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও, এনজিওগুলো দেশ-বিদেশ থেকে কাড়িকাড়ি টাকা এনে বাজেট সাজিয়ে প্রকল্প নিলেও তাদের কাজের কোন সুফল বাস্তবিক অর্থে পথশিশুরা পাচ্ছে না। গবেষণাবিহীন অস্বচ্ছ এ কাজ কেবল মধ্যস্বত্বভোগীদের ফায়দা-ই দিচ্ছে, পথশিশুদের পথেই রেখে চলেছে। পদ্ধতিগত গবেষণার মধ্যদিয়ে পথশিশুদের সমস্যা নিরুপণ এবং প্রতিকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে পথশিশু নামে দুর্গত শিশুদের এ সমীকরণ আর থাকবে না। এক্ষেত্রে নি:সন্দেহে যাকাত একটি উত্তম ব্যবস্থাপনা। সে রূপরেখা অন্যদিন পেশ করব, ইনশা-আল্লাহ।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট