নীতি, আদর্শের প্রতীক সুলতানুল কবির চৌধুরী
মুহাম্মদ তাফহীমুল ইসলাম
ন্যায়, নীতির আদর্শ পুরুষ এডভোকেট সুলতানুল কবির চৌধুরী। যিনি আজীবন নীতির সাথে গড়েছেন সখ্যতা। জীবনের ঝুঁকি মাথায় নিয়েছেন তবুও বিচ্যুত হননি আদর্শ থেকে। মানুষের কল্যানে মায়াভরা জীবনকে করে দিয়েছেন উৎসর্গ। অন্যায়ের বিপরীতে প্রতিষ্ঠা করেছেন ন্যায়কে। অসত্যের কবর রচনা করে উন্মোচন করেছেন সত্যের দ্বার। একাত্তরে দেশ স্বাধীনে শত্রুর মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে। এভাবে পুরো জীবন তিনি ব্যয় করেছেন দেশ ও মানুষের কল্যানে।
১৯৪৮ সালের ১লা জানুয়ারী বাঁশখালীর পুঁইছড়ি ইউনিয়নের জমিদার বাড়ীতে সুলতানুল কবির চৌধুরীর জন্ম। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের করাচী বেঙ্গলী স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬৭ সালে বোয়ালখালী স্যার আশুতোষ ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম সরকারী সিটি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন সুলতানুল কবির। ১৯৬৪ সালে মিউনিসিপাল স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে সুলতানুল কবির চৌধুরীর রাজনীতির হাঁতেখড়ি হয়। ১৯৬৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস ও ১৯৬৯ সালে ভিপি নির্বাচিত হন। ‘৬৯ এর আন্দোলন, ‘৭০ এর নির্বাচনেও সুলতানুল কবির চৌধুরী ছিলেন রাজপথে সক্রিয়। এভাবে তিনি ধীরে ধীরে রাজনীতির ময়দানে নিজের অবস্থান সৃষ্টি করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৩ই এপ্রিল পাহাড়তলী অপারেশনে গুরুতর আহত হয়ে জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়েন সুলতানুল কবির। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়েও চরম নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত এই নেতা।
সুলতানুল কবির চৌধুরী ১৯৭২ সালে এলএলবি পাস করেন এবং চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতির সমাপ্তি টানেন। ১৯৮১ সালে তিনি কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ১৯৯৬ সালে কেন্দ্রীয় যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সুলতানুল কবির চৌধুরী ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন মৃত্যুপূর্ব। ১৯৯১ সালে সুলতানুল কবির চৌধুরী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের বাঁশখালী আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। সেই সুবাদে তিনি বাঁশখালীতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। তাঁর সময়কালে ছিল না দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি। তিনি দৃঢ়তার সাথে বাঁশখালী থেকে এসব অন্যায়ের কবর রচনা করেছেন।
সুলতানুল কবির চৌধুরীর জীবদ্দশায় সর্বশেষ সংসদ নির্বাচন হয় ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারী। এই নির্বাচন বিভিন্ন কারণে বিতর্কিত হয়েছে এবং অংশগ্রহণমূলক হয়নি। দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন বিএনপিসহ অনেক দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। সুলতানুল কবির চৌধুরী চাইলে এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে সহজেই এমপি হতে পারতেন। কিন্তু তিনি শেষ জীবনে এই বিতর্কিত নির্বাচনে অংশ নিয়ে এমপি হয়ে নীতির পথ থেকে বিচ্যুত হননি। রাজনীতির নামে দুর্বৃত্তায়নের এই সময়ে এরকম রাজনীতিবিদ কয়জন আছেন! এখানেই সুলতানুল কবির চৌধুরীর অনন্যতা। এখানেই সুলতানুল কবির চৌধুরীর সাথে অন্যদের পার্থক্য।
সুলতানুল কবির চৌধুরী ছিলেন গরীব, দুঃখীদের জন্য আশ্রয়স্থল। তিনি গরীব, অসহায়দের সহজে টেনে নিতেন বুকে। সবার মাঝে বিলিয়ে দিতেন ভালোবাসা। ২০১৩ সালের ১০ই জানুয়ারী সুলতানুল কবির চৌধুরী প্রায় চার বছর পর বাঁশখালী আসেন বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের আলোচনা সভায়। সেদিন স্বচক্ষে দেখেছি তাঁর প্রতি সাধারণ মানুষের ভালোবাসা, প্রেম। বাঁশখালী প্রধান সড়কে নির্মিত হয়েছিল শত শত তোরণ, মানুষ ফুলের তোড়া নিয়ে তীব্র রোদ উপেক্ষা করে অপেক্ষা করেছে প্রিয় নেতার জন্য। প্রিয় নেতা এলে তাদের কত যে চেষ্টা একবার হাত মেলাতে। সুলতানুল কবির চৌধুরী অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে মঞ্চে আসন গ্রহণ করলে আবারও মানুষ ছুটে যায় মঞ্চের দিকে নেতার হাতের ছোঁয়া পেতে, কেউ কেউ কপালে চুমু খাওয়ার চেষ্টাও করেন। বক্তব্য দেয়াকালীন সভাস্থলে নেমে আসে শুনশান নীরবতা। অনেকেই প্রিয় নেতাকে স্মরণীয় করে রাখতে মোবাইল উঁচিয়ে ভিডিও করছেন। এগুলোর নামই ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। এসব দৃর্শ্য শুধু বাঁশখালী নয় পুরো দেশেই আজ তেমন একটা দেখা যায় না। সুলতানুল কবির চৌধুরীদের মতো নেতাদের আজ বড়ই অভাব। সুলতানুল কবিররা একে একে সবাই আমাদের দৃষ্টির অগোচর হচ্ছেন। চলে গেছেন- এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী, ইসহাক মিঞা, বদর উদ্দীন কামরানসহ অনেকে জনবান্ধব নেতা।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এডভোকেট সুলতানুল কবির চৌধুরী পরপারে পাড়ি জমান ২০১৪ সালের ৩০শে জুন ভোর ৪টা ১৫ মিনিটে গুলশানের নিজ বাসভবনে। তিনি সেদিন সেহরি খেয়ে ফজরের নামাজ আদায়ের জন্য অযু করতে বাথরুমে গেলে সেখানে স্ট্রোক করেন। পরক্ষনেই খারাপ লাগছে বলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বর্ষীয়ান এই নেতা। ১লা জুলাই তাঁকে নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রামে। তবে এইবার সুলতানুল কবির চৌধুরী কারো সাথে কথা বলছেন না, কারো থেকে জিজ্ঞেস করছেন না- ‘কেমন আছো? কি খবর?’। প্রতিবারে নেতাকে পেয়ে সবাই আনন্দিত হলেও এবার বেদনাহত। কারণ, সুলতানুল কবির চৌধুরীর সেই হৃদয় তাদের মাঝে ফিরেনি। তাদের মাঝে ফিরেছে সুলতানুল কবির চৌধুরীর নিথর দেহ।
সুলতানুল কবির চৌধুরীর প্রথম জানাযা অনু্ষ্ঠিত হয় নিজ সংসদীয় এলাকা বাঁশখালীর আলাওল ডিগ্রী কলেজ মাঠে সকাল দশটায়। রমযান মাস হওয়া সত্ত্বেও বাঁশখালীর সর্বস্তরের মানুষ শরীক হয় তাদের প্রিয় নেতার শেষ বিদায়ের আয়োজনে। সেদিন আমিও চেচুরিয়াস্থ বাড়ি থেকে চার টাকা ভাড়া দিয়ে বাসযোগে জানাযার নামাজে উপস্থিত হয়েছিলাম। তখন আমি অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত। জানাযার নামাজে সাধারণ মানুষকে চোখের পানি ফেলতে দেখেছি অসহায়ের মতো। কানায় কানায় পূর্ণ আলাওল কলেজ মাঠে নেতাকে বিদায় জানাতে উপস্থিত হয় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও। তারা শ্রদ্ধা জানায় প্রিয় নেতার প্রতি। কাউকে কাউকে দেয়ালে হেলান দিয়ে কাঁদতেও দেখেছি। জানাযা শেষে সুলতানুল কবির চৌধুরীর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে। সেখানে দুপুরে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় তাঁর দ্বিতীয় নামাজে জানাযা। দ্বিতীয় জানাযা শেষে তাঁকে শায়িত করা হয় নগরীর গরিবউল্লাহ শাহর মাজারস্থ কবরস্থানে।
সুলতানুল কবির চৌধুরী আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নেয়ার অর্ধ যুগ পূর্ণ হচ্ছে। এই ছয় বছরে বাঁশখালী হয়েছে নানান সমস্যায় জর্জরিত। বাঁশখালীতে নেই সুলতানুল কবির চৌধুরীর মতো আরেকজন সিংহ পুরুষ। যার ভয়ে বাঁশখালীর দিকে কেউ কুদৃষ্টি দেয়ার সাহস করবে না। অদম্য সাহসী এডভোকেট সুলতানুল কবির চৌধুরীকে হারিয়ে বাঁশখালীবাসী আজ অভিভাবক হারা। বাঁশখালীর স্বার্থে আঘাত এলে সুলতানুল কবির চৌধুরীর সেই গর্জন আজ বাঁশখালীবাসীর কাছে অপরিচিত। যাই হোক- বাঁশখালীর উন্নয়নে এডভোকেট সুলতানুল কবির চৌধুরীর অবদান অবিস্মরণীয়। মৃত্যুবার্ষিকীতে এই মহান মানবতাবাদী নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। কামনা করছি তাঁর আত্মার মাগফিরাত। মহান আল্লাহর কাছে মোনাজাত- তিনি যেন সুলতানুল কবির চৌধুরীকে জান্নাতুল ফিরদাউসে আসীন করেন- আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম