নির্বাচিত স্ট্যাটাস || আবু সাঈদ রয়েল
(১)
সদ্য দু’টি ঘটনা – দায় কার?
(২)
ছোটবেলায় প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতাম প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটে। বর্ষায় যখন খালের পাড়ের এঁটেল মাটির রাস্তায় সহপাঠিরা ঠিকমতো হাঁটতে পারত না,অামি ঠিকই হেঁটে যেতাম,কোথাও কখনো পড়ে যায়নি। অারিফ বর্ষার বৃষ্টিতে রাস্তায় হাঁটতে পারত না,অামি ছিলাম তার সঙ্গী। অারিফ সকালে অামাদের বাড়িতে চলে অাসত,দু’জনে প্রতিদিন এক সাথে স্কুলে যেতাম। টিফিন ছুটিতে ছেলেমেয়েরা অাইসক্রিম,চকলেট,কলা,অাচার ইত্যাদি খেত,অামি দূরে দাঁড়িয়ে থাকতাম।অাম্মা কখনো কখনো পকেটে এক টাকা দিত,সব সময় দিত না।যেদিন এক টাকা পেতাম সেইদিন অামি খুশিতে লাফাতাম।এভাবে প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিবর্তন করে দ্বিতীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়েও একই ভাবে সময় কেটে গেল।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্মৃতি মাঝেমাঝে খুব মনে পড়ে।স্কুলে যেতাম দলবেঁধে।টিফিন ছুটিতে সবাই বজলের দোকানে,গুরামিয়ার দোকানে চলে যেত।অামি মাঠে খেলে হাত মুখ ধুঁয়ে পানি খেয়ে চুপচাপ ক্লাসের দিকে হাঁটতাম।নিজের ভেতরে কোন অাক্ষেপ ছিল না।নবম শ্রেণী পর্যন্ত কখনো দু’টাকা,কখনো পাঁচ টাকা পেতাম,তবে সম সময় পেতাম না।চারপাশে সহপাঠিরা বিভিন্ন কিছু খেত,অামি চুপচাপ পিছনে গিয়ে বসতাম।
দশম শ্রেণীর শেষের দিকে অাম্মা হাতে মোটামুটি টাকা দিত,অামি নিতে চাইতাম না।জোর করে টিফিন বক্সে ভাত দিত,সব সময় নিতাম না।দশম শ্রেণীর মাঝামাঝি স্কুলে তেমন যেতাম না,রুমে স্বেচ্ছায় বন্দি জীবনযাপন করতাম।অাম্মার জোর করে ভাত দেওয়ার ভালোবাসার অত্যাচার বন্ধ হয়েছে।ছেলের গ্যাস্ট্রিক হবে যদি দুপুরে ভাত না খাই,যদি তেলের জিনিস খাই।অামি জানতাম অাম্মা গ্যাস্ট্রিকের কথা কেন বলতেন।এভাবে মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে দিলাম।
(৩)
কলেজে ভর্তি হয়েছি – মহসিন কলেজ।দেশ সেরা কলেজের ছাত্র।চারপাশে সব নতুন মুখ,অচেনা,অজানা।সবার পরিপাটি জামা,নামী দামী ব্রান্ডের জুতা,স্যান্ডেল।হকার মার্কেট থেকে ৯০ টাকা নামের ধবধবে সাদা শার্ট কিনেছি,পাশের মার্কেট গিয়ে দু’টি স্যান্ডেল,দু’টি প্যান্ট।
বাসা ছিল বহদ্দারহাট।কলেজে যেতাম ১নং বাসে।চট্টগ্রাম কলেজের পূর্ব গেইটে নেমে সোজা কলেজের ভেতর দিয়ে ওপারে মহসিন কলেজ।কলেজের যেতে বরাদ্দ ছিল ১০ টাকা। ২ টাকা যেতে বাস ভাড়া,২ টাকা অাসতে বাস ভাড়া অার ৬ টাকা দিয়ে কিছু খেতাম।কলেজে শেষের দিকে রিক্সা করে যেতাম,সব সময় নয়।১নং বাসে মানুষের ভীড়ে অাইরণ করা কলেজ জামার চেহারা বদলে যেত।কখনো কারো প্রতি অাক্ষেপ ছিল না,অভিমান ছিল না।যেখানে ভাল রেজাল্ট দিতে পারতাম না,সেখানে অন্য কিছুর জন্য অাক্ষেপের প্রশ্ন ওঠে কি করে? বাড়িতে তো ঐটুকু চাইত,তার বেশি কিছু নয়।
(৪)
ভার্সিটিতে এসে বরাদ্দ কিছুটা বেড়েছে।প্রতিদিন ৫০ টাকা করে মাসে ১৫০০ টাকা।যদিও কখনো কখনো এই ৫০ টাকাও হাত ছাড়া হয়ে যায়,ঘনিষ্ঠমাত্র জানে – ঘুম! ১৫০০ টাকার জীবন এবং কাউকে না জানিয়ে কম বেতনের একটা টিউশনি দিয়ে জীবন সুখে কেটে যাচ্ছে।টুকটাক বই,ম্যাগাজিন কেনাও এর ভেতরে চলে যাচ্ছে।খারাপ তো নেই,নেই কোন অাক্ষেপ,অভিমান,বাড়তি চাওয়া।
ভার্সিটি বাসে সবাই কানে হেডফোন লাগিয়ে সকাল বেলা যখন প্রার্থনা সংগীত শুনত,তখন অামি বাসের জানালা দিয়ে সকালের অালো দেখতাম অার ভাবতাম জীবন তো ভালই যাচ্ছে।চেয়ারম্যানের দোকানে নাস্তা খেতে খেতে যখন চারপাশে অনেকেই নতুন নতুন মোবাইল সেটের গল্প করে,অামি চুপচাপ শুনতাম।কেউ কেউ খোঁচা দিত, ”এই জীবনে তো তার হাতে একটা ভাল ”ANDROID” সেট দেখলাম না।” কেউ কেউ বলত, ” মামু এই ছোট্ট মোবাইলে এত স্ট্যাটাস দিয়ে কেনে চলরররর?”
অামি মৃদু হেসে ক্লাসের দিকে হাঁটি।জীবনে বড় বিলাসীতা নেই,নেই কোন অাক্ষেপ।অাগের প্রজন্ম তার পরের প্রজন্মকে সব কিছুই দিতে পারবে এমন কোথাও লিখা নেই।তবুও জীবন জীবনের মত চলে যাচ্ছে।কখনো বাবা মাকে এই জন্য শরীরে অাগুন লাগিয়ে দিব কল্পনায় ও ভাবতে পারি না।
(৫)
কলেজে পড়ুয়া একটা ছেলের অলরেডি ”আর ১৫ ” মোটরবাইক অাছে! বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দু’টি দামী বাইকের একটি – অার ১৫! এবং এটি খুবই দ্রুত সম্পন্ন! এই ছেলে নতুন মডেলের আর একটি বাইক কিনে না দেওয়ায় তার বাবা মায়ের শরীরে অাগুন দিয়েছে! সেই বাবা মা এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।
ফেসওয়াশ কিনে দিতে পারেনি বলে মা বাবার ওপর অভিমান করে এক কিশোরী অাত্মহত্যা করেছে।
ঘটনা দু’টি সদ্য।
পরিবার ফেসওয়াশ দিতে পারেনি এই জেদ কে শক্তিতে পরিণত করে দেশের,পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফেসওয়াশ কোম্পানির বড় কর্মকর্তা হবার ইচ্ছা পোষণ করা কী ভুলের হত?
যে বাবা মা কলেজ পড়ুয়া ছেলেকে এমন ভাবে বড় করে তারা তো শরীরে অাগুন দিব,সিম্পল।ঘরে কাল শাপ পুষলে ছোবল মারবে,যেমন মেরেছিল ঐশি !
তাদের বাবা মা এত টাকা কোথায় পায় ??