নারী স্বাধীন নাকি পরাধীন
সোহা চৌধুরী
শুনছি নারী নাকি আজকাল খুব স্বাধীন!
নারী নাকি ইচ্ছে করলেই একা একা স্বাধীন জীবন কাটাতে পারে! পুরুষের মতো কর্ম করে সমান তালে তাল মিলিয়ে চলতে পারে!
তবে কেন শোনা যায়, অফিসের উর্ধ্বতন কলিগ কিংবা মালিক দ্বারা এক মহিলা কর্মকর্তার যৌন হয়রানির খবর?
কেন শোনা যায় উচ্চ শিক্ষিত স্বনামধন্য পরিবারের স্ত্রীলোকটি স্বামীর হাতে পরে পরে মার খায়?
কেন শোনা যায় যৌতুক দিতে না পারায় গৃহবধূকে অমানুষিক নির্যাতন করে পুড়িয়ে মেরেছে?
নারী নাকি তার যোগ্য স্বাধীনতা পেয়েছে! আদিমকালের সমস্ত কুসংস্কার ভেঙে ফেলে সংস্কারের পথে হেঁটে চলেছে। পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমান তালে কাজ করছে এবং মাঝে মাঝে সমমর্যাদা পেয়ে উন্নতির উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হচ্ছে।
কিন্তু কি জানেন! এই নারীটিও যখন অফিস কিংবা ব্যবাসায়িক সমস্ত কাজ সম্পন্ন করে ঘরে ফেরে তখন তার যোগ্য মর্যাদা পায় না।
বাইরের এতো হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যখন ঘরে ফিরে আসে তখন সে চায় বাইরের জগতের সমান মর্যাদা ঘরেও তাকে দেয়া হোক। সমান না হোক ন্যূনতম মর্যাদা অন্তত পরিবারের লোকজন তাকে দিক। সবাই কষ্ট দিলেও বাবা-মা আর স্বামীর দেয়া আঘাত মেনে নেয়া যায় না। এদের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকে। কিছু না হোক বাবা-মা কিন্তু একটুখানি স্নেহের পরশ দিতেই পারেন।
শুধু কিছু বাক্য, “ইস! মেয়েটা আমার বাইরে কতো খাটুনি খেটে বাড়ি ফিরলো! সারাদিন ভালোভাবে পেট পুরে খেতেও পারেনি, মুখটা কেমন শুকনো দেখাচ্ছে! ”
এই বাক্যগুলো দিয়ে আপনি আপনার মেয়েটির সমস্ত ক্লান্তি দূর করে দিতে পারেন।
আর স্বামীর কাছে চাওয়া-পাওয়াগুলো সব পূরণ না হলেও শুধু একটু হাতটা ধরে বলুক, “অনেক পরিশ্রম করে এসেছো! কষ্ট বুঝি অনেক..! এবার সব কাজ ফেলে আমার কাছে একটু বসো, আমি আছি তোমার পাশে।”
এই প্রত্যাশা কি খুব অন্যায়?
অথচ জানেন! এতো পরিশ্রম করে বাড়ি ফিরে স্বামীর মুখে শুনতে হয়,”বা* ফালায়া আসছো না রাস্তায়। সারাদিন তো বা* ফালাইছ।”
এগুলোকে কি স্বাধীনতা বলে? কোথায় দিলেন আপনারা নারীকে সম্মান?
এবারে আসি সেই নারীকে নিয়ে যে কখনও বাইরের জগতে সেভাবে বিচরণ করেনি। কিন্তু তার খুব ইচ্ছে করে স্বাধীনভাবে নিজেকে যোগ্য করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে। অনেক পড়াশোনা করে অনেক বড় হবার স্বপ্নে পরিবার আগেই বাঁ হাত দিয়ে দেয়। বিয়ে দিয়ে তাকে পিছনে ফেলে দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এদের পড়াশোনার গন্ডি ঐ বিয়ের আগের ডিগ্রি পর্যন্তই থাকে। আর আগানোর সুযোগ হয় না তার। সংসারের ঘানি টানা, বাচ্চা লালন-পালনেই জীবন পার হয়ে যায়। কেউ কখনও জানতেও চায়নি তার কী ভালো লাগে, কী ইচ্ছে করে। সংসার ধর্মে পঁচে গলে গন্ধ ছড়ালে কিন্তু সে গন্ধ বাইরে যায় না। যার যার জীবন তার তার মুখ বুঝে মানিয়ে নিয়ে বা মেনে নিয়ে চলতে হয়।
আর যেসব নারী বিয়ের পর পড়াশোনা করে তাদেরকে কঠিন সংগ্রামে নামতে হয়। সংসার ধর্মও পালন করতে হয় আবার পরীক্ষায় পাশও আবশ্যক হয়ে যায়। বাপের টাকায় পড়া আর স্বামীর টাকায় পড়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য। পান থেকে চুন খসলেই খোঁটা দিতে থাকে। আর যদি সে সংসারে শাশুড়ী-ননদ থাকে তাহলে তো কথাই নেই। স্বামীর চেয়ে ৪গুণ বেশি বাঁশ খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।
শাশুড়ী কখনওই মা হতে পারেন না। ননদ কখনও বোন হতে পারেনা। আবার দেবর কখনো নিজের ভাই হতে পারে না।
আমি সব সময় এই থিউরিতে বিশ্বাসী। পেটের চামড়া যেমন পিঠে লাগেনা তেমনি পিঠের চামড়াও পেটে লাগেনা।
এদের সাথে আপনি যত ভালো ব্যবহারই করেন না কেন এরা ততক্ষণই ভালো যতক্ষণ আপনি ভালো। আপনার একটু রেগে যাওয়া এরা কখনোই নিজের মেয়ে, নিজের ভাই, নিজের বোনের মতো করে মেনে নেবে না। এরা আপনার স্বামীর কাছে বিচার দিয়ে আপনাকে আরও একধাপ অপমান করাবে। অপমানের পরিমাণটাও নির্ভর করবে আপনার নিজেকে গুটিয়ে নেয়া নিয়ন্ত্রণের উপর। আপনি যদি নিয়ন্ত্রণ হারান তাহলেই বিপদ। সংসার ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
সুতরাং মানিয়ে নিয়ে কিংবা মেনে নিয়ে চলতে হবে।
এখন আমাকে বলেন, নারী কোথায় স্বাধীন?
এতসব যন্ত্রণা যারা মেনে নিয়ে পারেন না তারা সংসার থেকে বেরিয়ে আসেন। শুরু হয় নতুন অধ্যায়। দ্বিতীয় বিয়ে। আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো হলে সুখের জীবন। নয়তো আগের চেয়ে দ্বিগুণ ভোগান্তির জীবন আর সাথে যদি থাকে আগের ঘরের বাচ্চা তাহলে তা চারগুণ ভোগান্তি।
বলতে পারেন ক’জন আছে আগের ঘরের বাচ্চাকে নিজের সন্তানের মতো আদর দিয়ে সেই বাচ্চার বাবার স্নেহের অভাব পূরন করবে? ক’জন আছে আগের সংসারের কুটকেচালী টান দিয়ে আপনাকে অপমান করবে না?
স্বাধীন হয়েছে নারী। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, বাইরে অবাধে চলাচল করতে পারছে, ভালো চাকুরী করে সংসারে সচ্ছলতা আনছে। মোদ্দাকথা সবই পারছে নারী। মুক্তি মিলেছে তার পূর্বের অনেক অপসংস্কৃতির গোঁড়ামি হতে।
কিন্তু সবকথার শেষ কথা ঘরই তার সম্মানটা দিতে পারেনি। এখনও ঘরে ঘরে স্ত্রীলোকটির টুঁটি টেনে ধরা হয়। এখনও কিছু অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে রুখে দাঁড়াতে পারে না। তাকে দমিয়ে রাখা হয়। মুখে না পারলে হাতে যেভাবেই হোক তাকে দমিয়ে রাখা হয়।
সম্মান হারাতে ক’জন চায় বলেন! মামলা-মোকদ্দমায় নারীর অগ্রাধিকার থাকলেও সত্য মিথ্যের বেড়াজালে, নিজের ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে সবাই এসবে জড়াতে চায় না।
কারণ, আপনি, আমি, আমরা সবাই জানি আইনি জটিলতায় একটি হলেও মিথ্যে বলতে হয়।
সবাই তা পারে না।
কী করবেন? এবার সিন্ধান্ত সম্পর্কে জড়াবেন নাকি একা থাকবেন। পারবেন একা থাকতে? ভাড়া নিতে গেলে বাড়িওয়ালার সন্দেহদৃষ্টির কাছে প্রথমেই আপনি হেরে যাবেন। সেখানেও আপনাকেই বোঝাতে সক্ষম হতে হবে আপনি স্বাধীন চিন্তায়, ন্যায়নীতিতে নিজেই নিজের ঢাল হয়ে বাঁচতে চান।
যাইহোক একা জীবনে আপনাকে অনেকবেশি সংগ্রাম করতে হবে। মাঝে মাঝে নিজের অনেক চাওয়া-পাওয়া অবচেতন মনেই চলে আসবে, আক্ষেপ হবে, ভুলের উপর ভুলও হতে পারে, বিশ্বাসঘাতকদের চক্করেও পড়তে পারেন।
আমরা তো মানুষ। যন্ত্র নই। নিজেকে শক্ত রেখে এতো এতো সংগ্রামের ভেতর মাঝেমধ্যে হাঁপিয়ে ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
ইচ্ছে হবে বন্ধু হোক কেউ। আর সে বন্ধুটিও আপনার দূর্বলতার সুযোগ নিবে। আপনি চাইবেন বন্ধু। সে আপনাকে অন্যভাবে চাইবে। আপনি সতী নারী। ভেতরে আপনার পবিত্র মন।
একা একা থাকতে গেলে আপনাকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের সকল দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। আর মানুষ আপনার এই একাকী সততার সংগ্রামী জীবন খুটিয়েও দেখবে না। কেউ কেউ বলেই উঠবে, “নিশ্চয়ই বাইরে আকাম-কুকাম করে আসে! মেয়েরা আবার একা থাকতে পারে নাকি!”
এখন অনেকে বলবেন,”পাছে লোকে কী বলে তাতে কী-বা আসে যায়!”
ভাই! আসে যায়। নতুবা কারো অনুপ্রেরণায় মন শান্ত হয়ে যেতো না, কারো অনুপ্রেরণায় সামনে চলার পথ সুগম হতো না। কিংবা কারো নিন্দায় মন ভেঙে যেত না, এতো এতো অপারগতার গল্প তৈরি হতো না।
আমরা মানুষ। যতোই একা পথ হাঁটেন না কেন সেখানে সমাজবদ্ধ মানুষের সহযোগিতা না থাকলে পথ চলা দুর্গম। কারণ আমরা নারী। ইচ্ছে হলেই সবকিছু করা সম্ভব নয়।
একটা পুরুষ চাইলেই বাইরে রাত কাটাতে পারে। নারী কি তা পারে। তার সেই নিরাপত্তা কই?
তবে কিসের স্বাধীনতা! নারী এখনও কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হয়ে ঘরে এসে মুখ থুবড়ে কাঁদে। কতরকম মিথ্যে লাঞ্ছনা-বঞ্চনার শিকার হয়। ভেতরের খবর ক’জন রাখে!
আর যদি সম্মুখে আসেও তবু কতখানি জাস্টিস মিলে তার জন্য? বলেন!
আমি আসলে নারীবাদী নই, আবার পুরষবিদ্বেষীও নই। আমি সংস্কৃতমনাও নই, আমি প্রগতিশীলও নই। দয়া করে কেউ আমাকে এসব নামে আখ্যায়িত করবেন না। খুব ইচ্ছে করছিল নারী স্বাধীনতা নিয়ে কিছু লেখার। যেটা নামেই শুধু স্বাধীনতা। কিন্তু আসলে পরাধীনতা ও অসম্মানের শৃঙ্খল।