
ভ্রমণ তাঁকে ক্লান্ত করেনি। শিল্প সংস্কৃতির পীঠস্থান প্যারিস, ফ্লোরেন্স, লন্ডন ঘুরে তিনি সচক্ষে দেখেছেন দোনাতেল্লো (১৩৮৬-১৪৬৬), বার্নিনি (১৫৯৮-১৬০০), মাইকেল এঞ্জেলো (১৪৭৫-১৫৬৪), হেনবী মুর (১৮৯৮-১৯৮৬), বারবারা হেপওয়ার্থ (১৯০৩-১৯৭৫), রৌঁদা (১৮৪০-১৯১৭), বতেচেল্লির(১৪৪৫-১৫৬৪) প্রমুখের বিখ্যাত মৌলিক সৃষ্টিকর্মগুলো। তাঁর সাথে পরিচয়/ঘনিষ্ঠতা ছিল হামিদুর রাহমান (১৯২৮-১৯৮৮), সাঈদ আহমেদ (১৯৩১-২০১০), আমিনুল ইসলাম (১৯৩১-২০১১), এস.এম আলী (১৯২৮-১৯৯৩), সাইয়িদ আতীবুল্লাহ (১৯৩৩-), শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬), সৈয়দ শামসুল হকসহ (১৯৩৫-) দেশের প্রথিতযশা ও বরেণ্য বহু ব্যক্তির।
বাংলাদেশের প্রথম নারী ভাস্কর-ই শুধু নন-দেশের প্রথম আধুনিক ভাস্কর তিনি। মেধাবী। স্বাধীনচেতা। স্বতন্ত্র। নভেরা আহমেদ। অনেক জগদ্বিখ্যাত ভাস্করের (দেগা, মাইকেল এঞ্জেলো) মতো ভাস্কর্যে পাশাপাশি প্রায় একইরকম নৈপুণ্যে রোমাঞ্চকর যত ছবি। ব্রাসেলসে বাংলাদেশ দূতাবাসে তাঁর আঁকা ফণাতোলা সাপের একটি বিমূর্ত চিত্র রয়েছে। জানা গেল, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতের কক্ষেও তাঁর আঁকা চিত্রকর্ম রয়েছে।
আমাদের ভাষা আন্দোলনের অনন্য স্মারক শহীদ মিনারের সহ-স্থপতি তিনি। ভাস্কর্যশিল্পকে তিনিই এদেশে পরিচিত ও জনপ্রিয় করেছেন। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করেন। অভিমানী নভেরা ষাটের দশকের শেষভাগে দেশ ছেড়ে যান এবং এই পুরষ্কারটি নিতেও তিনি দেশের মাটিতে পা রাখেন নি। প্যারিসের একটি হোটেলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে এই পদকটি হস্তান্তর করেন। ঐ সময় কুটনীতিক ইকতিয়ার চৌধুরী, প্যারিসপ্রবাসী বিখ্যাত চিত্র শিল্পী শাহাবুদ্দীন ও তাঁর স্ত্রী আনা ইসলাম উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়।
কৌতূহলভরে তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন লেখা পড়তে গিয়ে মনে হলো অনেক লেখা বা মন্তব্যেই তাঁর প্রতি সুবিচার করা হয় নি। আবার বাংলাদেশের নারী জাগরণের ইতিহাসভিত্তিক বিভিন্ন প্রবন্ধে গ্রন্থে তাঁর নাম পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়নি। তাঁকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোন অভিসন্দর্ভও তৈরি হয়নি। আবার তাঁর প্রবাসজীবনের শিল্পকর্মগুলোর উপর গবেষণাধর্মী লেখারও অভাব রয়েছে।
১৯৯৪ সালে হাসনাত আবদুল হাই তাঁকে নিয়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায় ‘নভেরা’ নামে একটি জীবনীভিত্তিক উপন্যাস লিখেন। ১৯৯৫ সালে এই উপন্যাসটি গ্রন্থরূপ পায়। এই বইটিতে বিবৃত বিভিন্ন তথ্যের বিভ্রান্তির কথা পরবর্তীতে তাঁর নিকটজনরা বলেছেন। নভেরার বড় বোন কুমুম হক অষ্ট্রেলিয়া থেকে কিছু তথ্যগত ভুল চিহ্নিত করে চিঠি লিখেন। হাসনাত আবদুল হাই তার উত্তরে পর্যাপ্ত তথ্য প্রাপ্তির সীমাবদ্ধতাও স্বীকার করেন। সেই সাথে তিনি যোগ করতে ভোলেননি যে, ‘নভেরা’ একটি জীবনীভিত্তিক উপন্যাস, জীবনী নয়। কাজেই লেখক কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করতেই পারেন। নভেরাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে তথ্যসঙ্কট স্পষ্টত: একটি বড় সমস্যা রূপে প্রতিভাত। বিশেষত: এই সমস্যা এখন আরও প্রকট, কারণ:তার নিকটজনদের অনেকে এখন আর বেঁচে নেই।
নভেরার জন্ম ১৯৩০ সালে, চট্টগ্রামের (কালিপুর, বাঁশখালী) একটি সংস্কারমুক্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারে। সাত ভাইবোনের পরিবারে বোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। ভাইবোনদের অতি প্রিয় “রাণী” তিনি। সৌন্দর্য্য, অহংবোধ ও আভিজাত্যে তিনি ছিলেন রাণীর মতোই অনন্যা। শৈশবে মা’কে দেখে মায়ের মতোই তিনি তৈরি করতেন মাটির ফুল, ঘর-বাড়ী, পাখি। সেই সাথে আঁকতেন ছবি। পোশাকে, সাজসজ্জায় তিনি ছিলেন খুবই সৌখিন। বাড়ীতে সঙ্গীত, নৃত্য ও শিল্পচর্চার পরিবেশ ছিল। উপ-মহাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন তার বড় বোন কুমুম হকের সঙ্গীত গুরু। তিনি নভেরাদের বাড়ীতে এসেই গান শেখাতেন। নভেরা নাচ শিখেছিলেন কলকাতায় বিখ্যাত শিল্পী সাধনাবসুর কাছে। পরবর্তীতে গুণী শিল্পী বৈজয়ন্তীমালার গুরুর কাছে নাচ শিখতে তিনি বোম্বে গিয়েছিলেন। নভেরার ছোট মামার মেয়ে রহিমা মাহমুদ বলেন ‘নভেরা’ বইটিতে উল্লেখ আছে যে নভেরা নাচ শিখেছিলেন বৈজয়ন্তীমালার কাছে- তথ্যটি ভুল। তাঁর ভাস্কর্যে ছিল নৃত্যের মুদ্রা। ভাস্কর্যসৃষ্টিতে তিনি নৃত্যভঙ্গিমাগুলোকে মূর্ত করেন, অনেকটা ইংরেজ ভাস্কর বারবারা হেপওয়ার্থের (১৯০৩-১৯৭৫) মতো। নজরুল জন্মজয়ন্তীতে নভেরা একবার চট্টগ্রামের জুবিলী হলে এক ঘন্টাকাল জয়জয়ন্তী রাগে বাজানো সুরের সাথে নৃত্য পরিবেশন করেন।
বাবা সৈয়দ আহমেদের চাকরির সুবাদে কলকাতা থাকাকালে নভেরা লরেটো থেকে ম্যাট্রিকুলেশান পাশ করেন। বাংলাদেশে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ এবং চট্টগ্রাম কলেজেও অধ্যয়ণ করেন। বাবার আদরের মেয়ে নভেরা কিন্তু বাবার ইচ্ছানুসারে ব্যারিস্টার হননি। বরং নিজ সিদ্ধান্তেই হয়েছেন ভাস্কর। চল্লিশের দশকে ছোটখালার বিয়ে উপলক্ষে নভেরা কলকাতা থেকে নানা বাড়ী তৈলারদ্বীপ, বাঁশখালী এলে ছোটখাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়। নভেরার খালাতো বোন হুসনে হেনা সফদার বলেন, বুদ্ধির দীপ্তি, লাবণ্য আর অন্তর্মাধুর্যে নভেরা ছিলেন অতুলনীয়া। তিনি চুম্বকের মত আকর্ষণ করতেন পরিপার্শ্বের সবাইকে। ছোট বোনটিকে মাটির ব্যাংকের উপর অভিব্যক্তিপূর্ণ চোখের ছবি এঁকে দিয়েছিলেন তিনি। ঐ সময়ে তিনি বাঙালী মেয়েদের চিরায়ত পোশাক শাড়ী পড়তেন না বরং প্রায়শঃই পড়তেন লম্বা গাউন জাতীয় পোশাক। কখনো বার্মিজ মেয়েদের থামি পড়ে, সাঁওতাল মেয়েদের মত চুল বেঁধে, টিপ পড়ে তিনি চমকে দিতেন সহচারীদের।
১৯৫০ সালে নভেরা যখন ভাস্কর্য বিদ্যা অধ্যয়ণের জন্য লন্ডনে পাড়ি জমান, সে সময় শিক্ষা, রাজনৈতিক আন্দোলন বা সমাজ সংস্কারে এ অঞ্চলের মেয়েদের সীমিত অংশগ্রহণ লক্ষ্যনীয় হলেও, ‘ভাস্কর্য’-এর মতো বিষয় নিয়ে পড়াশুনার কথা অনেকে ভাবেনি। এমনকি পুরুষেরাও না। ১৯৬৩ সালের আগে পূর্ব পাকিস্তানে ‘ভাস্কর্য’ পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভূক্তও ছিল না। নভেরা লন্ডনে এসে পরিচিত হন শিল্পী হামিদুর রাহমানের (১৯২৮-১৯৮৯) সাথে। নভেরার খুব ভাল বন্ধু হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৫১ সালে তিনি লন্ডনের ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস এন্ড ক্রাফট্সে ভর্তি হন এবং প্রথম পাকিস্তানী মহিলা হিসেবে অনন্য মেধার স্বাক্ষর রেখে কোর্স সম্পন্ন করেন। ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যক্ষ ডঃ ক্যারেল ভোগেল প্রত্যয়নপত্রে বিশেষভাবেই উল্লেখ করেন তাঁর দৃষ্টির প্রখরতা, স্বকীয়তা ও চিন্তার গভীরতার কথা।
নভেরা ফ্লোরেসে ভাস্কর্য বিষয়ে পাঠ নেন বিখ্যাত ইটালীয় শিল্পী ভেন্টিরিনো ভেন্টুরির (১৯১৮-২০০২) কাছে। এরপর ভেনিসে যান। ১৯৫৬ সালে নভেরা ও হামিদুর রাহমান দেশে আসেন। ১৯৫৭ সালে হামিদুর রহমান পাবলিক লাইব্রেরীর দেয়ালময় একটি ফ্রেসকো করেন। অপরদিকে নভেরা ওখানে দু’টো লো রিলিফের (প্রাচীরে উৎকীর্ণ ভাস্কর্য) কাজ করেন। একই বছর নভেরা পাবলিক লাইব্রেরীতে শিল্পী হামিদুর রাহমানের সাথে যৌথ প্রদর্শনী করেন। ১৯৫০ এর দশকে নভেরা পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে ভাস্কর্য প্রদর্শনী করেন যা এই শিল্পকে সাধারণ্যে জনপ্রিয় করে তোলে। ১৯৫৭ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন তাদের দু’জনকে শহীদ মিনারের নকশা তৈরীর পরামর্শ দেন। তাঁদের নকশাটিই চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয় (হাসনাত আবদুল হাই, নভেরা, পৃ: ১০৭)। ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় টিনের ছাপড়া ঘর বানিয়ে তাতেই অবস্থান নেন নভেরা। এ কর্মশালা হতে নভেরা ও হামিদুর রাহমানের অক্লান্ত শ্রমে গড়ে ওঠে প্রথম শহীদ মিনার।
মেহবুব আহমেদ বলেন, “কিন্তু সরকারি খাতায় নভেরার নাম না থাকায় শহীদ মিনারের নকশা পরিকল্পনায় তাঁর অবদানের প্রসঙ্গটি বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে” (মেহবুব আহমেদ, শিল্প ও শিল্পী, ২০১৩)।
পরবর্তীতে সৈয়দ শামসুল হক, সাদেক খান, এস.এম. আলী, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, আমিনুল ইসলাম প্রমূখের রচনা, স্মৃতিচারণ ও সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণাদি পাওয়া যায়। নভেরা ও হামিদুর রাহমানের ঘনিষ্ট বন্ধু আমিনুল ইসলাম বলেন ঃ
“একটি সত্য যে কালের হাতে কত সহজে বিস্মৃতি ও বিভ্রান্তিত পরিণত হতে পারে এখানেই তার প্রমাণ”। এস.এম. আলীও শহীদ মিনারের নকশা প্রণয়নে নভেরার গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা বলেন।
সৈয়দ শামসুল হক বলেন, “মনে পড়ে গেল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকশা করেছিলেন যে দু’জন তাদের একজনের কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছি”। তিনি আরও বলেনঃ
“তারা মিনার নকশার কাজে ছিলেন যৌথভাবে নিবিষ্ট, আমাদের বয়সীরা এখনো ভুলে যাইনি যে, ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকশা হামিদুর রাহমান একা করেননি, নভেরাও সমঅংশে ছিলেন এবং নকশাটির বীজ উপ্ত হয়েছিল প্রধানত নভেরারই করোটিতে। অথচ নভেরার নাম আমরা করিনা, কেবল হামিদের নাম করে থাকি”।
সাদেক খানও বলছেন যে, শহীদ মিনারের নকশায় সন্তানসহ মায়ের যে আনত ভঙ্গিমা ঐ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে নভেরা ছাড়া ঐ রকম বির্মূত কাজ আর কেউ করেনি।
হামিদুর রহমানের অনুজ সাঈদ আহমেদের (১৯৩১-২০১০) লেখা থেকে জানা যায়, বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে প্রবহমান ঝর্ণাধারার কলধ্বনির মধ্যে ভাস্কর্যের যে নান্দনিক বিন্যাসরচিত হয়, সেই প্রস্রবণ¯œাত ভাস্কর্য (ঋড়ঁহঃধরহ ঝপঁষঢ়ঃঁৎব) দেখে এসে নভেরাকে মোহিত (ঋধংপরহধঃবফ) করে। তাই শহীদ মিনারের নকশাতেও তিনি প্রস্রবন ভাস্কর্য সাংযোজন করার কথা ভেবেছিলেন।
১৯৫৮ সালের ২১ ফ্রেব্রুয়ারি “ঞযব চধশরংঃধহ ঙনংবৎাবৎ” এর প্রথম পাতাতেও এ সংক্রান্ত তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়।
অনেক প্রমাণের বিদ্যমানতায় এখন শহীদ মিনারের সহ-স্থপতি হিসেবে নভেরার অবদানের বিতর্কিত বিষয়টি মীমাংসিত। বাংলাদেশ সরকারও তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁকে পদক দিয়ে ভূষিত করেছেন। তবু মনে হয়, শুধু পদক দিয়েই তাঁর প্রতি রাষ্ট্রের দায় শেষ হয়নি। শহীদ মিনার নির্মাণের ইতিহাস বা একুশের ইতিহাসে তার নামটি সংযুক্ত করবার জন্য সচেতন উদ্যোগ প্রয়োজন। নয়তো নতুন প্রজন্ম আংশিক সত্য তথ্যটিকে পূর্ণ সত্যরূপে জানবে। ব্যথিত হই জেনে যে, নভেরার এক সময়ের ঘনিষ্ট বন্ধু হামিদুর রাহমান এককভাবেই এই স্বীকৃতি নিয়েছেন এবং বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তাকে একজন ‘দীপ্তিহীন সহকারী’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। হামিদুর রহমানের বন্ধু সৈয়দ শামসুল হক এ বিষয়ে বার বারই ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। কবি সাইয়্যিদ আতীফুল্লাহ লিখেন ঃ
“কী অভিমানীনি সে আসে না কোনদিন শহীদ মিনারে
……………………………………
শহীদ মিনার কী করুণ ডাকে সেই নভেরাকে
কিছুতে পায় না সাড়া, ডাকে বার বার
কিছুতে পায় না সাড়া, ডাকে বারবার”
১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে নভেরার “ওহহবৎ এধুব” শিরোনামে একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয় তৎকালীণ কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরী চত্বরে। এটি ছিল পাকিস্তানের প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর ব্রোশিউরে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন লিখেন যে, ‘‘পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প জগতে একটি ক্ষুদ্র বিপ্লব ঘটে যখন নভেরা আহমেদ ১৯৫৭ সালে নগরের কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের দেয়ালে উচ্চাবচ ভাস্কর্য গড়েন এবং প্রথম প্রাঙ্গন ভাস্কর্য গড়েন ১৯৫৮ সালে। তবে তিনি মনে করেন, আমাদের শিল্প জীবনে এ দুটি কাজের অভিঘাত মূল্যায়ণ করতে বহু প্রজন্মের প্রয়োজন হবে।” (রেজাউল করিম সুমন, শিল্প ও শিল্পী, ২০০৯)।
নভেরার সর্বাধুনিক ভাস্কর্য ”ঈড়ংি রিঃয ঃড়ি ভরমঁৎবং” (১৯৫৮) এ অঞ্চলের প্রথম প্রাঙ্গন ভাস্কর্য যাতে তিনি কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের চিরায়ত রূপকে তুলে ধরেছেন। নান্দনিক ও কারিগরি সুষমার দিক থেকে এটিকে নভেরার একটি অনবদ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লালারুখ সেলিম। এই ভাস্কর্যে নভেরা গরু এবং মানুষকে একটি একীভূত সত্তা হিসেবে তৈরী করেছেন যা কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশ কৃষকের সাথে কৃষির অবিচ্ছেদ্যতাকে নির্দেশ করে। স্থাপত্যকর্মটি প্রথমে ধনী ব্যবসায়ী এম.আর খানের বাগানে স্থাপিত হয়। বর্তমানে এটি জাতীয় জাদুঘরের সামনে স্থাপিত হয়েছে। (গঁংযভরয়ঁব ডধফঁফ, ঝপঁষঢ়ঃরহম ইধহমষধফবংয, ২০০৯).
১৯৬১ সালে লাহোরে ঘধঃরড়হধষ ঊীযরনরঃরড়হ ড়ভ চধরহঃরহম, ঝপঁষঢ়ঃঁৎব ধহফ এৎধঢ়যরপ অৎঃং- এ নভেরার মোট ৬টি ভাস্কর্য প্রদর্শিত হয়। যার মধ্যে ঈযরষফ চযরষড়ংড়ঢ়যবৎ ভাস্কর্যটি শ্রেষ্ঠ ভাষ্কর্যের পুরষ্কার ছিনিয়ে নেয়। এই আবক্ষ ভাস্কর্যটির মডেল ছিল তারই ঘরের বছর দশেকের এক পরিচারকের, যাকে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন ভিন্ন অভিব্যক্তিতে।
প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী মর্তুজা বশীর (১৯৩২-) জানান, এই পুরষ্কারের মাধ্যমে পাকিস্তানে ভাস্কর্য শিল্পও শিল্পকর্ম হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি পায়। কেননা পাকিস্তানে তখনও ভাস্কর্য পরিচিত বা স্বীকৃত শিল্প ছিল না। (হাসনাত আবদুল হাই, নভেরা, ১২৬)।
লাহোরের প্রদর্শনীর পর আমেরিকান ফ্রেন্ড অব দা মিডল ইস্ট এর ডাইরেক্টর এবং শিল্পকর্মের পৃষ্ঠপোষক ওয়াটসন একটি রিভিউতে লিখেন ঃ
“ঘড় ফরংপঁংংরড়হ ড়ভ চধশরংঃধহ ধৎঃ ড়িঁষফ নব পড়সঢ়ষবঃব রিঃযড়ঁঃ যবৎ”
ষাটের দশকের শেষ প্রান্তে নভেরা দেশ ছেড়ে যান। কখনোই আর দেশে ফিরে আসেননি। বন্ধু আত্মীয়Ñপরিজন না দেশ- কার উপর তাঁর এই অপরিমেয় অভিমান তা আজও অজ্ঞাত। অভিমানে নিমজ্জিত নভেরা আত্মীয় বা পরিচিত কারও সাথে দেখা করেন নাÑ নিভৃত জীবন বেছে নিয়েছেন তিনি।
উদার-মানবতাবাদী ভাস্কর নভেরার ভাস্কর্যে নান্দনিক দিক ছাড়াও গুরুত্ব পেতো সামাজিক দায়বদ্ধতা। তাঁর সকল ভাস্কর্যই ছিল মানবতার বার্তাবহ । ‘শান্তি’ ‘মাতৃমূর্তি’ ‘পরিবার’ ইত্যাদি ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। যুদ্ধবিরোধী ভাস্কর্য গড়বার মানসে তিনি ভ্রমন করেছেন ভিয়েতনাম। বৌদ্ধমূর্তি দেখতে গিয়েছেন বার্মায়। ব্যাংকক (১৯৭০) ও প্যারিসে (১৯৭৩) তাঁর আরও দুটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘর নভেরার পুরনো ভাস্কর্যগুলো নিয়ে মাসব্যাপী (১৪ এপ্রিল-১৩ মে) প্রদর্শনীর আয়োজন করে এবং জাদুঘরের একটি হলের নামকরণ করা হয় ‘নভেরা হল’। এদেশের তরুণ প্রজন্ম জেনে না জেনে নভেরার নানা ভাস্কর্যের সাথেই বেড়ে উঠেছে। পাবলিক লাইব্রেরীর আবর্জনা স্তুপের পাশে ও গুদামঘরে বহুদিনই বড় অবহেলায় পড়ে থেকেছে তার ভাস্কর্যগুলো। দেশের প্রথম ঝর্ণা ভাস্কর্যের নির্মাতা তিনি। ভাস্কর্য দেখে অভিভূত হলেও অনেকেই জানেনা তাঁর এই অবদানের কথা। অনেকেই জানেনা বাংলাদেশের প্রথম বহিরাঙ্গণ ভাস্কর্যও (ঙঁঃফড়ড়ৎ ংপঁষঢ়ঃঁৎব) তাঁরই সৃষ্টি। জাতি হিসেবে আমরা শুধু অকৃতজ্ঞ নই- কৃতঘœ। তাঁর অবদান ভুলে গেলেও তার ব্যক্তিজীবন নিয়ে টানাটানি করতে ছাড়িনি আমরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক ও ভাস্কর হামিদুজ্জামান খানের মতে তিনি যদি ভাস্কর্যকে এই পর্যায়ে এনে রেখে না যেতেন তবে আরো অনেক সময় লেগে যেত পরবর্তী পর্যায়গুলোতে পৌঁছতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের শিক্ষক এনামুল হক এনামের দেয়া তথ্য মতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভাস্কর্য বিভাগ প্রতিষ্ঠায় (১৯৬৫) শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনকে বিশেষভাবে সহায়তা করেন বরেণ্য ভাস্কর নভেরা আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাক।
চট্টগ্রামের রেকিট এন্ড কোলম্যানের অফিস এবং ঢাকার অ্যাটমিক এনার্জী কমিশনের সামনে নভেরার দুটো ভাস্কর্য রয়েছে।
সিমেন্ট, সুরকি, কাঠ দিয়েই নভেরা তৈরী করেছেন নিরীক্ষাধর্মী অভিনব মূর্ত, বিমূর্ত ও প্রায় বিমূর্ত ভাস্কর্য । মাধ্যমের এই সীমাবদ্ধতার কথা লাহোর প্রদর্শনীর রিভিউতে বিশেষভাবেই উল্লেখ করেছিলেন ওয়াটসন। সীমার মাঝেই অসীমের এ সাধনায় নভেরা যোগ করেছেন ভিন্ন মাত্রা।
একটা সময়ে দেশে নভেরার দীর্ঘ অনুপস্থিতি এবং সেই সাথে প্রচার বিমূখতার কারণে তাঁর সম্পর্কে নানা ভ্রান্তি তৈরী হয় বিশেষতঃ তার বেঁচে থাকা নিয়ে। বাংলাদেশের “নারী চরিতাভিধান”- এ সাঈদা জামান জানান ১৯৮৯ সালে নভেরা মৃত্যুবরণ করেছেন (জামান, নারী চরিতাভিধান, ৮৪) পরে নানা ঘটনার সূত্রেই জানা যায় এটি ভুল তথ্য ছিল। অন্য একটি সূত্রে জানা যায়, দূর্ঘটনায় পা হারানোয় সৌন্দর্য্যরে চিরপূজারী নভেরা সাধারণ্যে নিজেকে আর প্রকাশ করতে চাননি।
‘মুক্তাঙ্গন’ শীর্ষক ব্লগটিতে নভেরাকে নিয়ে রেজাউল করিম সুমনের লেখার সূত্র ধরেই জানা গেল নভেরার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে। জানা গেল, নভেরা রুশ বাংশোদ্ভূত ফরাসী আলোকচিত্রী ও আর্ট ডিলার গ্রেগোয়া দ্য ব্রুন (হাসনাত আবদুল হাইয়ের নভেরাতে যাকে ‘পোলানস্কি’ বলা হয়েছে) এর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন। গ্রেগোয়ার পিয়েরে লো গ্র স্ট্রিটের আর্ট গ্যালারিটিতে (যেটি আগে মূলত একটি গ্রন্থবিপণী ছিল) নভেরার বিভিন্ন শিল্পকর্ম এবং বিভিন্ন প্রদর্শনীর ব্রোশিওর সাজিয়ে রাখা আছে। এষড়নব ঞৎড়ঃঃরহম এই দোকানটির সাম্প্রতিক কিছু ছবি ঐ ব্লগে পোষ্ট করলে এ সম্পর্কে জানা গেল। একই ব্লগের মন্তব্যসূত্রে ২০০৯ সালে আনা ইসলামের (বিশিষ্ট শিল্পী শাহাবুদ্দীনের স্ত্রী) মাধ্যমে জানা গেল বয়সজনিত হাঁপানীর সমস্যা ছাড়া নভেরা ভাল আছেন। ২০১২ এর নভেম্বরে প্যারিস প্রবাসী জনৈক সজীবের সাথে গ্রেঁগোয়া তার ফোনালাপ করিয়ে দেন বলেও জানা যায়।
২০১০ সালে গ্রেগোয়ার আর্ট গ্যালারিতে নভেরার শিল্পকর্মের একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের সাথে যুক্ত এন রাশেদ চৌধুরী নভেরাকে নিয়ে ঞযব খড়হম ডধরঃ (নভেরার ভাস্কর্যের নামানুসারে এ নামকরণ করা হয়েছে) শিরোনামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন।
বাংলাদেশের ভাস্কর্যকলার ইতিহাসে নভেরা অত্যুজ্জ্বল এক আলোকস্তম্ব। তাঁর স্মরণীয় হবার দাবি কেবল কালের বিচারে নয়, প্রতিভাবান শিল্পীর মর্যাদায়ও” (মেহবুব আহমেদ, শিল্প ও শিল্পী, ২০১৩)। এই বিশাল মাপের শিল্পী ও জীবন্ত কিংবদন্তীকে যথার্থ মর্যাদা দিয়ে শহীদ মিনারের ইতিহাসে তাঁর নামটি যথাযথভাবে সংযুক্ত করা এবং তাঁর ভাস্কর্যগুলো আন্তরিকতার সাথে সংরক্ষণ, প্রদর্শন এবং সাধারণ্যে পরিচিত করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অলোকসামান্য প্রতিভাময়ী মানবসংবেদী এই শিল্পীকে অমর্যাদা করার অপরাধের সীমাহীন গ্লানি থেকে স্রষ্টা আমাদের রক্ষা করুন।
লেখক: রুহী সফদার
সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সরকারী সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম