গত পর্বে আলোচনা করেছিলাম, একজন মা গর্ভকালীন সময় ও বাচ্চা জন্মদানের পর যেসব সমস্যায় ভুগে থাকেন সেগুলো। ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টোরেন হরমোনের উঠানামার কারণে মানসিক অবসাদে ভুগে থাকেন একজন নতুন মা। একে পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন বা বেবি ব্লু বলা হয়।
এমন ঘটনাও হয়তো আপনাদের জানা আছে, বাচ্চাসহ মা হাসপাতালের ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। অনেক মা নবজাতক বাচ্চাকে আহত করেন অথবা নিজেকে আঘাত করেন। অনেক দুধের বাচ্চার মা সম্পূর্ণ মানসিক রোগী। বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে। তাদের চিকিৎসা করানো হয় না। ‘খারাপ বাতাস লাগসে, মাথা আউলাইয়া গ্যাছে’ এইসব বলে দায় সারেন অভিভাবকগণ। এসবের কারণ মূলত এই পোস্ট-পার্টাম ডিপেশন। হরমোনাল চেঞ্জের কারণে এমনিতেই মা ডিপ্রেশনে থাকেন। এসময় তার জন্য অনুকূল পরিবেশের পরিবর্তে যদি তার জন্য প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় তখন এই ডিপ্রেশনের মাত্রা এক্সেসিভ পর্যায়ে গিয়ে মা ও শিশুর জন্য মারাত্মক ক্ষতিগুলো করে থাকে।
আজকে আমরা জানব, নতুন মায়ের জন্য অনুকূল পরিবেশ কীভাবে তৈরি করা যাবে। আর প্রতিকূল পরিবেশ যাতে সৃষ্টি নাহয় সেজন্য আমাদের কী করা উচিত।
অনেক নতুন মায়ের সাথে আমি কথা বলে জেনেছি, বাচ্চা হওয়ার পরপর সবাই যখন বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায় তখন তাদের মনে হয়, ‘এখন বাচ্চাই সব, আমার কথা আর কেউ ভাবছে না।’ তার নাড়ি ছেঁড়া ধন, অনেক আকাঙ্ক্ষিত ও প্রতিক্ষিত সন্তান কখনও তার কম্পিটিটর হতে পারে না। কিন্তু অযৌক্তিক ও হাস্যকর মনে হলেও সন্তান জন্মদানের পর অনেক মায়েরই এমন মনে হয়, সন্তান আসার পরপরই তার মূল্যায়ন কমে গেছে। তাকে কেউ আর আগের মতো প্রায়োরিটি দিচ্ছে না। কাছের মানুষদের কাছ থেকে এসময় তার প্রত্যাশা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়।
এক্ষেত্রে পরিবার ও আত্মীয় স্বজনের ভূমিকা হতে পারে, মাকে একটু বেশি প্যাম্পারিং করা, একটু বেশি যত্ন নেয়া। এ সময় খাবার-দাবারে বাছাবাছি করা হয়। তেল, মসলা ছাড়া শুধু লাউয়ের তরকারি, অথবা কম মসলা দিয়ে দেশি মুরগি, কবুতর বা জিওল মাছ খেতে দেয়া হয়। প্রথম একদিন, দুদিন খেলেও পরে এসব খাবার খেতে খেতে মায়েদের বিস্বাদ লাগে।
বাচ্চা দেখতে গেলে বাচ্চার জন্য কাঁথা, কাপড়-চোপড় আরও নানা উপহার নেয়া হয়। অথচ সদ্য পৃথিবীতে আসা বাচ্চাটার কাছে এই উপহারসামগ্রীর কোন মূল্য নেই। উপহার হিসেবে এমন কিছু দেয়া অবশ্যই ভালো যা বাচ্চার ও মায়ের কাজে আসবে। সাথে সাথে এটাও করা যায় নতুন মায়ের জন্য কিছু উপহার নেয়া। গৎ-বাধা খাবার-দাবারের পরিবর্তে নিতে পারেন চকলেট, মজার কোনো কুকিজ। যেসব খাবারে তার সমস্যা হবে না আবার সে পছন্দও করে এমন খাবার নিতে পারেন।
মায়ের জন্যও নতুন জামাকাপড় নেয়া যায় উপহার হিসেবে। এটা হয়তো অনেককাল ধরে চলে আসা প্রথার বিপরীত। কিন্তু ভেবে দেখুন এই ছোট্ট একটা কাজে মা যদি খুশি হয়, সে যদি উপলব্ধি করতে পারে সবার কাছে সে অনেক ভ্যালুএবল একজন পার্সন তাহলে তার শারীরিক-মানসিক ব্যথা-বেদনা ছাপিয়ে আনন্দের পরিমাণটা কেমন হতে পারে।
এ সময় স্বামীর উচিত তার সাথে সহমর্মী আচরণ করা। যেহেতু স্বামীই সবচেয়ে কাছের ও আপনজন। তার পক্ষ থেকে সামান্যতম অবহেলা ও অনাদরও এসময় মারাত্মক মানসিক আঘাতের কারণ হতে পারে।
বাচ্চা দেখতে একই সময়ে একসাথে অনেক আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতি যেমন আনন্দদায়ক তেমনই বাচ্চার জন্য সমস্যা সৃষ্টিও করতে পারে। বাচ্চা দিন-রাত শুধু কাঁদতেই থাকে, দুধ খায় না, ঘুমায় না। সে কাঁদলে একবাক্যে সবাই বলেন যে, ‘বাচ্চার খিদা লাগসে, দুধ দাও দুধ দাও।’ অথচ তাকে দুধ খাওয়ানোর পরিবেশটা করে দেয়া হয় না।
নিরিবিলিতেই বাচ্চারা স্বাচ্ছন্দ্যে, স্বস্তিতে দুধ পান করে। আর বাচ্চাজে দুধ পান করানোর সময় মাকেও রিলাক্সে থাকতে হয়। বাচ্চার অতিরিক্ত কান্নার কারণ সব সময়ই খিদে পাওয়া, পেট খালি থাকা, পেট ব্যথা করা, ডোআ উঠা (বা বাহু উঠা, হাতের বাহুর জয়েন্টের হাড় নড়ে যাওয়াকে বলা হয়) নয়। অতিরিক্ত মানুষের সমাগম ও শোরগোলের কারণেও বাচ্চারা কান্না করে এটা কেন যেন কেউ বুঝতেই চান না।
উপদেশ বা পরামর্শ দিতে আমরা সবাইই খুব পছন্দ করি। কিন্তু যাকে দিচ্ছি সে উপদেশ নিতে পছন্দ করে কিনা এটা একটা ভাববার বিষয়। অনেক সময় উপদেশ আর পরামর্শ দিয়ে দিয়ে মায়ের মন মস্তিষ্ক ভারী করে ফেলা হয়। যেটা তার ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে। একেক জনের একেক পরামর্শ বাচ্চার টেক-কেয়ারের সময় মাকে উৎকণ্ঠিত ও কনফিউজড করে তুলতে পারে।
নতুন বাচ্চার মাকে সবাই-ই টুকটাক পরামর্শ দেন। কিন্তু এই পরামর্শগুলো একসাথে ভারী বর্ষণের মতো না দিয়ে সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী দেয়া ভালো। যেহেতু নতুন মা, সে নিজেই অভিজ্ঞ মায়েদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাইবেন। তখন তাকে সে বিষয়ে সঠিক পরামর্শ দেয়া যায়। তাছাড়া এখন ইন্টারনেটের যুগ। মা নিজেই গুগলিং করে বিভিন্ন বিষয় জেনে নিতে পারেন।
নতুন বাচ্চা আসা মানে পরিবারে শুধু একটা বাচ্চার আগমনই নয়, এরসাথে আরও অনেক দায়িত্ব যোগ হয়। আগের মতো কিছুই থাকে না। মা নিজের যত্ন নিতে ভুলে যান। এ সময় পরিবারের সবারই উচিত নতুন মায়ের সাথে সহমর্মী আচরণ করা। তার দায়িত্বগুলো পরিবারের সবাই কমবেশি ভাগাভাগি করে নেয়া। এতে মা নিজের জন্য কিছুটা সময় পাবেন।
আগামী পর্বে থাকছে কীভাবে একজন নতুন মা নিজেই নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা করবেন। এর সাথে শেষ হবে প্যারেন্টিং সিরিজের প্রথম অধ্যায়, ‘মা হওয়া সহজ নয়’।