ধোঁয়াশার বৃত্তে বাঁশখালীর রাজনীতি || আরকানুল ইসলাম

ইদানীংকালে পুরো দেশে ‘বাঁশখালী’ একটি পরিচিত নামে পরিণত হয়েছে। হোক ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক পরিচয়ে! সবাই এক নামেই চেনে। চিনবে না-ই বা কেন! অতি সম্প্রতি বৈলছড়িতে ঘরে আগুন দেওয়া, চেচুরিয়া হাবিবের দোকানে গোলাগুলির ঘটনা, পাইরাংয়ে ১৭-১৮ জন গুলিবিদ্ধ হওয়া, আরও বিচ্ছিন্ন অথচ পরিকল্পিত সব ঘটনা। মানুষ সহিংসতা পছন্দ করে না। তারা শান্তিবাদী। তারা এলাকায় শান্তি চায়, সৌহার্দ্য চায়, চায় পারস্পরিক বোঝাপড়া। এইসব সহিংসতা তাদেরকে রাজনীতি-বিমুখ করে তুলছে।

সাধনপুরে ১১ হত্যা বা গন্ডামারায় কয়লাবিদ্যুৎ নিয়ে ফোর মার্ডার কি কম আলোচিত ইস্যু? দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়ও যে সেখবর ছড়িয়ে পড়েছে লেলিহান আগুনশিখার মতো!

সবকিছুর মূলে রাজনীতির একটা ‘খেল’ আছে। কয়লাবিদ্যুৎ ইস্যুতে সব রাজনৈতিক দল ছিল একপক্ষে আর সাধারণ মানুষ ছিল আরেকপক্ষে। যেখানে সাধারণ জনতার বাড়িঘর, ভিটেমাটি রক্ষার মতো বিষয় জড়িত ছিল তখন দেখা গেছে সেই রাজনীতিকরা সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে ছিল। অথচ তাদের অবস্থান হওয়া উচিৎ ছিল জনগণের পক্ষে।
এমনিতে রাজনৈতিক মঞ্চে যারা এক টেবিলে বসে না, পরস্পরের বিষোদগার করে, অমুকের সাথে বেহেশতে হলেও যাবে না বলে শপথ করে তাদের দেখি ঐ ইস্যুতে টাকার পকেটে গিজগিজ করে বসে থাকতে! তখন তাদের সমস্যা হয় না, ইজ্জত যায় না, চেতনারও বেশকম হয় না। জনতার ইস্যুতেই তারা কেবল পাছার মতো দুই ভাগ হয়ে যায়।

তা-ও কম ছিল, তখন দল ও দলে ভাগ হতো। এখন তো একই দলে কয়েক ভাগ হয়ে গেছে! এ সমাবেশের ডাক দেয় তো, ও একই জায়গায় সমাবেশের ডাক দেয়! ফলাফল – মারামারি, হাতাহাতি এমনকি গোলাগুলিও! শেষ পর্যন্ত বদ-শিরোনামে আসে ‘বাঁশখালী’! টোটাল ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাঁশখালী ও তার সাধারণ জনগণ। নেতাদের চামড়া হচ্ছে গন্ডারের মতো, বাঁশখালীর বদনাম হলে তাদের কিচ্ছু যায় আসে না, তাদের পকেট ভারী হলেই হলো!

বাঁশখালী আওয়ামী লীগ এখন কয় ভাগ হয়েছে? কয়টি গ্রুপ হয়েছে তারা? কেন এত গ্রুপিং?
আমার দেখায়, বর্তমানে ‘বাঁশখালী আওয়ামী লীগ’ তিনটি গ্রুপে বিভক্ত। খোঁজ নিলে অবশ্য আরও দুটি গ্রুপ বের করা কঠিন হবে না। রাজনীতির উদ্দেশ্যই যদি হয় মানুষের সেবা ও কল্যাণসাধন করা তাহলে এত গ্রুপ হওয়ার কথা নয়। তারা সবাই মিলে একই গ্রুপে মানে একটিই দল হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিত। কিন্তু এখন তারা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে আওয়ামী লীগ (মো) গ্রুপ, আওয়ামী লীগ (লি) গ্রুপ কিংবা আওয়ামী লীগ (মু) গ্রুপ বলে! কেন এত গ্রুপ? নিশ্চয় মানবসেবা বাদ দিয়ে এর ভেতরে অন্য ধান্ধা রয়েছে। না-হলে সবাই একই নৌকায় আশ্রয় নিত।
ক’দিন আগেই দুই গ্রুপে গোলাগুলি হলো, ভাগ্য ভালো কেউ মারা যায়নি, তবে যেতে পারত।

সত্যি যদি তারা দেশকে ভালোবাসত, দলকে ভালোবাসত, নেতার আদর্শকে ধারণ করত তাহলে তারা কিছু স্বার্থ ছাড় দিয়ে গ্রুপিং ছেড়ে একটাই গ্রুপে পরিণত হতো। টোটালই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগ। আগের উপজেলা নির্বাচন যার বড় প্রমাণ। তাদের এখন প্রতিপক্ষ দল লাগে না, প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা গ্রুপ সৃষ্টি করে রেখেছে। তাই মানুষ এখন এসবের বাইরে নতুন নেতা খুঁজছে, প্রকাশ্যে এলে হয়তো তার দিকেই ঝুঁকে পড়বে বাঁশখালীর আওয়ামী লীগ কর্মী ও সমর্থকেরা। মানুষ তুলনামূলক বিচার করে যাকে ভালো মনে হয় তার দিকেই ঝুঁকে পড়ে। সবকিছুর উর্ধ্বে দল থাকলে টুকটাক মনোমালিন্য ভুলে বাঁশখালী ও বাঁশখালীবাসী তারা নিজেদের নিয়োজিত করত।

কিংবা বিএনপির কথাই ধরা যাক। গত কয়েক বছরে তাদের গ্রুপিং স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আগে যেখানে সবাই এক ছিল, সেখানে আজ একে অপরকে চাকর, নকল বিএনপি, সংস্কারপন্থী ব’লে গালি দিচ্ছে। অথচ এই দৃশ্য আগে কখনো ছিল না। বাঁশখালী থেকে বারবার নির্বাচিত এমপি অনেকটা একা হয়ে পড়েছেন! সর্বশেষ, বেগম জিয়ার কক্সবাজার-টেকনাফে সফরের সময় এই গ্রুপিং আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নতুন ব্রীজ সংলগ্ন এলাকায় সাবেক এমপি এক পাশে ব্যানার নিয়ে দাঁড়ানো, আরেকপাশে বাঁশখালী বিএনপির নেতা চেয়ারম্যান-সাবেক চেয়ারম্যানেরা নিজস্ব ব্যানার নিয়ে নেত্রীকে স্বাগত জানিয়ে মুহূর্মুহ শ্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে। এবং সংবর্ধনা শেষে ফেরার পথে গুনাগরীতে প্রতিপক্ষ গ্রুপের ওপর হামলা, তারও পরে বৈলছড়ির এক বিএনপি নেতার ভাইয়ের ইলেক্ট্রোনিকসের দোকানে হামলা, লুটপাট এই গ্রুপিংকে আরও প্রকাশ্য হতে দেখা গেছে। অথচ, শেষমেষ ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু বাঁশখালী বিএনপি। মানুষ একই জিনিস বারবার পেলে অহংকারী হয়ে ওঠে। আমরাও কি বাঁশখালী বিএনপিতে সেটাই দেখতে পাচ্ছি না? স্থানীয় নেতাদের বাদ দিয়ে কেউ যদি শুধু ‘ধানের শীষ’-এ জনগণ ভোট দেবেই মনে করে বসে থাকেন তাহলে তিনি তার ফল নির্বাচনের দিনই হাতেনাতে পেয়ে যাবেন।

উপজেলা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বাম্পার বিজয় পেয়ে হাতে অনেকটা চাঁদ পাওয়ার মতো খোশমেজাজে ছিল বাঁশখালী জামায়াত। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে গ্রুপিংয়ের সুবিধাটা বেশ ভালোভাবেই লুফে নিয়েছিল জামায়াত। যে যা-ই বলুক, বাঁশখালীতে জামায়াতের অবস্থান এখনও তৃতীয়। উপজেলার পরিষদের সব প্রধান তিনটি পদে আছে বলে যারা জামায়াতকে বাঁশখালীতে প্রধান ও সবচেয়ে বড় দল ভাবছে তারা হয়তো অতি আবেগে বা বাস্তবতা বাদ দিয়ে ভেবে বলছে। নির্বাচনে জেতার পর কয়েক বছর তাদের নিজেদের মধ্যে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। তবে, ইদানীং সম্পর্কে কিছুটা টান পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। কথায় আছে, যা রটে তার কিছুটা বটে। সারাদেশে জামায়াতের মধ্যে কোনও গ্রুপিং লক্ষ্য করা যায় না। কারণ গ্রুপিং হলেও তারা ড্রয়িংরুম পর্যন্ত আসতে দেয় না, বেডরুমেই সুরাহা করে নেয়! তবে বাঁশখালীতে বড় নেতার কাছ থেকে কর্মীরা হালকা দূরত্বে আছে বলে জানা গেছে। এবং উপরমহলের কিছু সিদ্ধান্ত ও আচরণ তৃণমূল কর্মীরা মানতে পারছে না। তার ফলাফল নির্বাচনে পড়বে কি না জানা নেই। কারণ, এরা ব্যক্তির চেয়ে দলকেই এগিয়ে রাখে।

এদের বাইরেও কয়েকজন রাজনীতির মাঠে দৌড়ঝাঁপ করছেন। তারা কেবল নির্বাচন কাছে এলেই বসন্তের কোকিল হয়ে দেখা দেন, বাকি চার বছর তাদের দেখা মেলে না! জনগণও তাদের চেনে, তাই নির্বাচনের আগে ‘খেয়ে ছেড়ে দেন’ তাদের!

সত্যিকার অর্থে যে বাঁশখালী ও বাঁশখালীবাসীর স্বার্থে কাজ করবে, জনগণ তাকেই বেছে নেবে। এবং জনগণ তাকে চিহ্নিত করে রাখছে। সেদিনই বাকিদের মুখে ধুলো দিয়ে পছন্দের ব্যক্তি, কাজের কাজীকে বিজয়ের মুকুট পরিয়ে দেবে।

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *