মুহাম্মদ মিজান বিন তাহের, বাঁশখালী: চট্টগ্রামে লিচুর কথা উঠলেই প্রথমে সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ লিচু উৎপাদন এলাকা হিসেবে বাঁশখালীর কালীপুরের নামটি সর্বাগ্রে উঠে আসে। লিচুর জন্য বিখ্যাত বাঁশখালীর কালীপুর। এখানকার লিচু যেমন সুস্বাদু, তেমন পুষ্টিসমৃদ্ধ। তাই কালীপুরের লিচুর কদর সারাদেশেই। কালীপুর লিচুর জন্য বিখ্যাত যুগ যুগ ধরে। বৈলছড়ি, গুণাগরি, পুকুরিয়া, জলদি, জঙ্গল চাম্বলসহ প্রায় প্রত্যেক ইউনিয়নেই পাহাড়ি এলাকায় একই সাথে সমতলে লিচুর চাষ হয়ে আসছে বহুকাল থেকেই। মৌসুমের একেবারে প্রথম দিকেই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে কালীপুরের লিচু। মধুমাস জ্যৈষ্ঠের রসালো ফল লিচু। কালীপুরের আগাম লিচু বাজারে আসছে। পাকনা লিচু বাগান ছাড়াও শোভা পাচ্ছে বাড়ির ছাদ বাগানেও। কালীপুরের পূর্ব পাহাড়ি এলাকায় খুব কম বসতঘরই আছে, যাদের তিন-চারটা লিচু গাছ নেই। মৌসুমী এ লিচু প্রকৃতিতে যেমন সৌন্দর্য বিলায়, তেমনি চাষিদের মুখে হাসি ফোটায়। এবারে বাঁশখালীতে লিচুর ব্যাপক ফলন হয়েছে। সম্প্রতি বাঁশখালীর অভ্যন্তরীণ হাট-বাজারে উঠতে শুরু করেছে বছরের সেরা রসালো ফল বাঁশখালীর কালীপুরের লিচু। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ও পোকামাকড়ের তেমন আক্রমণ না থাকায় বাঁশখালীতে লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে দাবি উপজেলা কৃষি অফিসের।
বাণিজ্যিক ও ঘরোয়াভাবে উৎপাদিত এই লিচুর কদর দেশজুড়েই। আগাম লিচু বাজারে দেখা মিলছে এখন। তেমন কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন না হওয়ায় এবার লিচুর উৎপাদন হয়েছে বরাবরের চাইতে কয়েকগুণ বেশি। লিচুর বাম্পার ফলন হলেও দামের কমতি নেই এখানে। ব্যাপক চাহিদা থাকায় এবার আগাম লিচু বাগান ও লিচুর আকার ভেদে প্রতি ১০০ লিচু বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৪০০টাকায়।
স্থানীয় বাজারে প্রথম দিকে দাম বেশি থাকলেও ধীরে ধীরে ২০০-২৫০ টাকায় কমে আসবে। রাজশাহী-দিনাজপুরের লিচুর তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও স্বাদে-মানে বাঁশখালীর লিচুর তুলনা নেই। তাছাড়া বাঁশখালীর লিচুর তুলনায় রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুরের লিচু কিছুদিন পরে বাজারে আসতে শুরু করে। চট্টগ্রাম ও আশেপাশের এলাকায় বাঁশখালীর লিচুর আলাদা কদর রয়েছে।
ইতিমধ্যে বাঁশখালী অধিকাংশ হাট বাজারে লিচু ক্রয় করার জন্য মানুষের ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রতিদিন বাঁশখালী কালীপুরের রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে কিংবা গুনাগরিতে প্রধান সড়কের আশেপাশে সাধারণ যাত্রীকে গাড়ি থামিয়ে লিচু কিনতে দেখা যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ দেশ বিদেশে লিচু রপ্তানি করার জন্য গাড়ি গাড়ি পাইকারি দামে ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছে।
মৌসুমের একেবারে প্রথম দিকেই বাজারে পাওয়া যায় বলে কালীপুরের লিচুর খ্যাতির রেওয়াজটাও কমে না। এবার লিচু উৎপাদনে লক্ষ্য মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বলে জানান কালীপুরের লিচু চাষী নাছির ও মালেক।
বাঁশখালী উপজেলার কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, বাঁশখালীতে ৭০০-৭৫০ হেক্টর জমিতে লিচুর বাণিজ্যিক চাষ হয়। এবারে ফলন বেশি হওয়ায় লিচুচাষীরা খুশি। তাছাড়া কৃষি অফিস থেকে যথাযথ সহযোগিতা দেয়া হয়েছে লিচুচাষীদের- এমনটিও জানা যায় । ব্রিটিশ আমল থেকেই বাঁশখালীর উপজেলার কালীপুরে জমিদার বংশের লোকজন বোম্বাই, কোলকাতা, চায়না-থ্রি জাতের লিচু চারাকলম সংগ্রহ করে বাগান করে আসছেন। পরে তা জলদি, পুকুরিয়া, সাধনপুর, চাম্বল, নাপোড়ায় বিস্তৃতি লাভ করে। ভালো ফলন হওয়ায় একেকটি বাগান এক থেকে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাঁশখালীর তিন চারটি এলাকায় লিচুর পাইকারি বাজার বসে। পাইকারদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন যায়গায় পৌঁছে যায় বাঁশখালীর এ লিচু।
বাঁশখালীর লিচুর কলম চারার চাহিদাও ব্যাপক। কালিপুর, বৈলছড়িসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে কলম চারার ব্যবসা ভালো জমেছে। দূর দূরান্ত থেকে লিচু চাষীরা কলম চারা কিনে নিয়ে যায় এখান থেকে।
কালীপুর এলাকার বাগান মালিক আবু ছালেক জানান, ‘গত বছর আমাদের নিজস্ব বাগানে লিচু চাষ করেছি। এ বছর ১ কানি পরিমাণ লিচু বাগান ১৪ হাজার টাকায় ক্রয় করেছি। বাগানে ৩০ থেকে ৪০টা গাছ আছে। পরিবেশ অনুকূলে থাকলে, উপযুক্ত দাম পেলে আশা করছি বাগান থেকে লিচু বিক্রি করে ৫০-৭০ হাজার টাকা আয় করতে পারব। এখন পাইকারদের কাছে হাজার প্রতি ১৭শ থেকে ১৮শ টাকায় বিক্রি করছি। অল্প কয়দিন পর চড়া দাম পাব বলে আশা করছি।’
কালিপুরের একটি বাগান থেকে লিচু কিনতে আসা কর্ণফুলী মইজ্জারটেক এলাকার মো. বেলাল উদ্দিন বলেন, ‘সারা বছর তো আমরা রাসায়নিকযুক্ত লিচু খেয়ে থাকি। কিন্তু বাঁশখালীর লিচুতে ভেজাল থাকে না, তাই দাম একটু বেশি হলেও বাগান থেকেই বাচ্চাদের জন্যে লিচু কিনে নিয়ে যাচ্ছি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু ছালেক বলেন, এবার চলতি মৌসুমের শুরু থেকে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মৌসুমি ফল আম, কাঁঠাল, লিচুর ভালো ফলন হয়েছে। তবে মৌসুমি ফলের মধ্যে বাঁশখালীর কালীপুরের লিচু স্পেশাল একটি ফল। এখানে বাণিজ্যিকভাবে লিচুর চাষাবাদ হয়। এ বছর
বাঁশখালীতে প্রায় সাড়ে ৭শ হেক্টর জায়গা জুড়ে লিচু চাষ হয়ে থাকে। স্থানীয় উন্নত প্রজাতির এই লিচু উৎপাদনে চাষীরা বেশ গুরুত্ব সহকারে উৎপাদন কাজে শ্রম ব্যয় করায় বাণিজ্যিক ও ঘরোয়াভাবে উৎপাদিত এই লিচুর কদর দেশ জুড়েই। বর্তমানে বাঁশখালীর সর্বত্র আগাম লিচু বাজারে দেখা যাচ্ছে দেশীয় গুলো। তবে এই বৎসরে চায়না-থ্রির ভালো ফলন হয়েছে। আগামী ১২-১৫ দিনের মধ্যে ই এই চায়না থ্রি লিচু বাজারে আসবে।
লিচুর উৎপাদনের শুরুতেই বৃষ্টি কম হওয়ায় চাষীরা অনেকটা হতাশ ছিল। কিন্তু শেষ মুহুর্তে এসে বৃষ্টির দেখা মেলায় চাষীরা অনেকটা আশান্বিত হলেও প্রবল বাতাসে ও ভারী বৃষ্টি ও বজ্রপাতে লিচু গাছের ক্ষতি হতে পারে এই আশংকা রয়েছে চাষীরা। বাজারে আগাম লিচু বাগান ও লিচুর আকার ভেদে প্রতি শত লিচু বিক্রি হচ্ছে ৩-৪শ টাকায়। স্থানীয় বাজারে প্রথম দিকে দাম বেশি থাকলেও ধীরে ধীরে ২শ থেকে আড়াইশ টাকায় কমে আসতেছে। চট্টগ্রাম জেলার সর্বত্র বাঁশখালীর কালীপুরের লিচুর আলাদা কদর রয়েছে। এ বৎসর লিচুর উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বলে জানান স্থানীয়রা।