তুরস্কের সামনে ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি
আবদুল্লাহ মুরাদোগলু
২৪ জুনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তুরস্ক নিজেকে “রাষ্ট্রপতির শাসন ব্যবস্থায়” রূপান্তর করছে। আমরা আশা করি এটি এ দেশের জন্য উপকারী হবে। প্রতিটি ব্যবস্থার পরিবর্তনের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ব্যবস্থাটি দেশের শাসন পদ্ধতির জন্য একটি নতুন বিন্যাসও নিয়ে আসে। তবে ব্যবস্থার মধ্যেই এমন কোন নাটকীয় জাদুমন্ত্র থাকে না যে তা অবিলম্বে সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। এতে কোন সংশয় নেই যে আমাদের এমন অনেক সংঘাতের সম্মুখীন হতে হবে যা সাধারণত সব পরিবর্তনের সময়েই দেখা দেয়। এই বিষয়ে, তুরস্কের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
আমাদের এই অঞ্চলের গভীরতর সংকট এবং বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকিগুলি একটি বেদনাদায়ক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলছে যা মোকাবেলার জন্য দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত অন্তর্দৃষ্টি প্রয়োজন। সংকট এবং ঝুঁকির একটি বৈশ্বিক মাত্রা রয়েছে যা জন জীবনকে প্রভাবিত করে। প্রতিটি দেশকে তার শক্তিতে যতটা সম্ভব এই প্রভাব সহ্য করতে হবে। আর্জেন্টিনাকে অর্থনৈতিক সংকটের ফলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৫০ বিলিয়ন ডলারের উদ্ধার কর্মসূচি সম্পন্ন করতে হয়েছে। এখন আর্জেন্টিনীয়দের একটি “তিক্ত বটিকা” গিলতে হচ্ছে।
প্রতিটি দেশ শুধুমাত্র তার ক্ষমতা পর্যন্ত আঘাত সহ্য করতে পারে। সেই ক্ষেত্রে, আমাদের টেবিলে আমাদের দেশের সহনীয় ক্ষমতাকে সামনে রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে বলা যায় ক্ষমতা শুধুমাত্র পরিসংখ্যান, প্রযুক্তি বা শিল্পের সমন্বয় নয়, বৈরি অবস্থা মোকাবেলায় সামাজিক, আইনী ও নৈতিক মূল্যবোধও এক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের অন্তর্নিহিত সবচেয়ে বড় ক্ষমতা হলো “আস্থা” জাগ্রত থাকা। সারা বিশ্বে এখন এক “আস্থার সংকট” চলছে। সুতরাং, ” আস্থা অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বাসের সৌধ” নির্মাণ করতে হবে।
ইউরোপে জনতুষ্টিবাদী দলগুলির উত্থান দৃশ্যত অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে জড়িত, যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, এটিকে “সভ্যতার সঙ্কট” হিসাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। জনতুষ্টিবাদী দলগুলির উত্থান মধ্যপন্থী দলগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করে। জার্মানিতে, এঞ্জেলা মার্কেলের নেতৃত্বাধীন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন এবং অধিকতর ডানপন্থী খৃস্টান সোস্যাল ইউনিয়ন এর মধ্যকার দীর্ঘদিনের জোটের মধ্যে “অভিবাসন নীতিমালা” নিয়ে ফাটল ধরা শুরু হয়। ব্যাভারিয়ান রাজ্য শাসনকারী খৃস্টান সোস্যাল ইউনিয়ন ম্যার্কেলকে বাধ্য করছে অভিবাসীদের জন্য তার মধ্যপন্থী “খোলা দরজা নীতি” পরিত্যাগ করতে।
ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে চলমান গৃহ সংঘাত এই সব দেশের মধ্যে “রাষ্ট্র শক্তি”কে দুর্বল করেছে। একটি রাষ্ট্রের পতন, এবং ফলস্বরূপ আইনী বন্ধন শিথিল হবার কারণে, মানুষের মধ্যে “আস্থার অভাব” তৈরি হয় এবং ভবিষ্যতের জন্য তা হয় উদ্বেগের কারণ। বৈশ্বিক সম্পদ বিতরণে মহা অবিচার প্রতিটি দেশে নতুন করে সমস্যা ও নতুন অপরাধের জন্ম দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাদকদ্রব্যের ব্যবহারের কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার লোক প্রাণ হারাচ্ছে। মাদক সঙ্কট এখন আমেরিকাতে একটি জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ হিসাবে আলোচিত হচ্ছে। “বয়সি জনসংখ্যা” বৃদ্ধি বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাজেটের উপর চাপ বৃদ্ধি করছে এবং ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে সমাজের সক্ষমতার উপরও এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে।
পশ্চিম ও রাশিয়ার মধ্যে শুরু হওয়া “নতুন স্নায়ু যুদ্ধ”, “চীন-মার্কিন প্রতিযোগিতা”, ট্রাম্পের শুরু করা বাণিজ্য যুদ্ধ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের কারণে “ইরান পারমাণবিক চুক্তির” সম্ভাব্য পতন , রাশিয়া ও ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার পারমাণবিক সঙ্কট, “ফিলিস্তিনী ইস্যু” এবং অন্যান্য অনেক ভূ রাজনৈতিক ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান অন্যান্য রাষ্ট্রের পাশাপাশি তুরস্কের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বার্ষিক প্রতিরক্ষা ব্যয় রাশিয়া ও চীনকে অনুরূপ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করে। সর্বোপরি, ট্রাম্প একটি “সামরিক স্পেস ফোর্স” তৈরি করতে পেন্টাগনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এসবের উদ্বেগজনক প্রভাব রয়েছে।
আগামী দিনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আসছে “অর্থনীতির অঙ্গন থেকে।” এখন এমন এক সময় এসেছে যখন অর্থনীতিকে দেখতে হবে জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগের বিষয় হিসেবে। বিশ্বের অর্থনৈতিক সঙ্কটের পিছনে মৌলিক কারণ হল আর্থিক ব্যবস্থা পরিচালনায় প্রকৃত অর্থনীতির উপর অগ্রাধিকার প্রদান শিথিল হয়ে পড়েছে। আরো প্রত্যক্ষভাবে বলা যায়, আর্থিক অপারেশন এবং বাস্তব অর্থনীতির ভূমিকার ট্রেন্ড বিপরীতমুখি
হয়ে দেখা দিচ্ছে।
বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি দ্বারা সৃষ্ট অর্থনীতির চাপটি বিশ্বাসযোগ্য এবং সমাজের সম্পৃক্ততার উপর ভিত্তি করে একটি সুষ্ঠু অর্থনীতি মডেল গ্রহণের মাধ্যমে মোকাবেলা করা যেতে পারে। আস্থা শব্দটির সারাংশ অব্যাহতভাবে ” অনন্য এক সামাজিক মান হতে চলেছে যা সমাজের প্রতিরোধক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে। আসন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য এবং আমাদের সব মানুষকে সুখী করার জন্য, আমাদের বীরত্ব গাথাঁ বোনা বন্ধ করা উচিত এবং তার পরিবর্তে পরিকল্পনা এবং “বড় স্বপ্ন” সম্পর্কে কথা বলা শুরু করা উচিত।
[আবদুল্লাহ মুরাদোগলুর এ লেখাটির একটি সার্বজনিন বৈশ্বিক আবেদন রয়েছে। তিনি তুরস্কের মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও প্রশাসনিক বিজ্ঞান অনুষদের “জন প্রশাসন ও রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগ” থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনি ১৫ বছর ধরে মিডিয়ার সাথে যুক্ত রয়েছেন। ১৯৯৭ সাল থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তিনি বিশেষ সংবাদ, ধারাবাহিক লেখা, গবেষণা নিবন্ধ, সাক্ষাত্কার, ইতিহাস নিয়ে কলাম লিখছেন। তিনি তুরস্কের ইনি সাফাক পত্রিকার নিয়মিত কলামিস্ট। তিনি তুরস্কে বিভিন্ন সিভিল সোসাইটি সংস্থার দায়িত্ব পালন করেছেন।]
ডেইলি ইনি সাফাক থেকে অনুবাদ মাসুমুর রহমান খলিলী