
উত্তুরে-হাওয়া শয়তানী শুরু করেছে মানে গায়ে মোটাকাপড় চড়াও, কান-মাথা ঢুকিয়ে নাও গরম কাপড়ে। পারলে একটা শাল জড়িয়ে ভাব আনা যেতে পারে। ভাব আনার আরেক নাম স্বাধীনতা। ভাব আসতে চায় সহজে, তাকে আনতে হয় কায়দা করে। কায়দা করতে গিয়ে ব্যক্তিকে বিসর্জন দিতে হয় ম্যালা কিছিমের ফায়দা, কুরবানি দিতে হয় নানান জিনিস। ব্যক্তিক ভাবের সাথে সম্পর্ক বাঁধে সামাজিক চোখ। ব্যক্তিক বিভার ঔজ্জ্বল্য গাঢ় হতে থাকলে সামাজিক দৃষ্টির প্রখরতা বাড়ে। এই বাড়-বাড়ন্ত দৃষ্টি লম্ফ দিতে চায় চিরকালের কালচারে। কালচারের ক্রিয়া ও বিক্রিয়ায় প্রতিনিয়ত যোগ হতে থাকা অজিজ্ঞাসু বিষয়াশয়কে প্রশ্নের মুখোমুখি করে সচেতন পার্থিব সত্ত্বাটি। এই সচেতনভাব একদিনে আসে না। হাজার দিনের সামষ্টিক ত্যাগের সাথে দৃষ্টিভঙ্গির মিলন হলেই আঘাত করার শক্তি আসে আপনা থেকে। তুমুল জিজ্ঞাসা ও পরিবর্তনের ছাপ দ্রুত ছড়িয়ে যায় গোলাপসুবাসের মতো। আদি ও আসল বোধের ভিন্নতর ব্যঞ্জনে রাষ্ট্রযন্ত্রে ধাক্কা দেয় সময়। সময়ের কার্ণিশে বসে যুগের প্রহরীদের চিৎকারে খসে পড়ে পলেস্তরা। দীর্ঘদিনের অভ্যেসহেতু যে মরিচিকায় মিশে যেতো যাবতীয় ঝোল– তাতে যুক্ত হয় পূজের বর্ণ। ভীষণতর ঘৃণায় ছিটকে পড়ে ছা-পোষা মনটি, সেখানে ভালোবাসা আসে, প্রেম আর দ্রোহ আসে। দ্রোহের মন-বদলে কবিতা হয়, প্রাণের বিনিময়ে কিনে নিতে হয় মানচিত্র। এই দহনজ্বালায় কিংবা অনিঃশেষ প্রার্থণার শেষে রাষ্ট্রপুঞ্জের অস্থিত্ব স্বীকৃত হওয়া মানেই ব্যক্তির বিজয়; ব্যক্তি মানে বাপদাদার আকিকা দেয়া কতিপয় শব্দবন্ধের নাম নয়; বিশ্বাস, প্রেরণা, কর্ম ও নিয়তির সমষ্টি। ভাগশেষ থাকতে পারে, তাতে বদ্বীপের মতো ষড়ঋতুর যোগান দৃশ্যমান হলে বাউল হওয়া অস্বাভাবিক নয়, কবি অথবা পাগলও হতে পারে। তখন শীতেরা অতিথিপাখির ডানায় চড়ে নামে আমাদের বিলে, সন্ধ্যার আমন্ত্রণে ভর করে আমাদের গ্রামে। কতিপয় উচ্ছন্নে যাওয়া দল নাড়া পোড়ে, আগুনের গরম নেয়, নিজেকে সতেজ করে; উঞ্চতার স্পর্শ নিয়ে সকালের রসদ যোগাড় করে। সকাল মানে রোদ, সকালের তর্জমা হতে পারে একটি পতাকার প্রসবব্যথা, জমিনে কর্ষণের যাবতীয় আয়োজন। সবুজ-সবুজ খেলার স্বর্গে নিজেকে সামিল করা-হেতু তখনই দৃশ্যপটে আসে সুখ। সুখের সাথে সমৃদ্ধি। সুখের সৎভাই দুঃখও দাঁড়িয়ে থাকে ঝুলবারান্দায়। পরস্পরের মেলামেশায় মানবসন্তানেরা স্বাধীনতা নামক অমৃত ভোগ করে। ঝঞ্ঝার্টময় এ উপভোগে কখনো ডাকাত পড়ে, মুসাফির নামে, দেবদূতেরা আসে বারবার। উদ্ধার করে আর রাঙিয়ে দেয়। বোবা শব্দকে দেয় অসীম সাহসের আলপনা।
২.
এই শীত স্মৃতিকে কান ধরে নিয়ে যায় লেজের দিকে। লেজ মানে পেছন, পেছনের সঠিক তরজমা হতে পারে অতীত। বাকী ঋতুর খোলস দেখানোর নামে শীত দেখিয়ে দেয় বাংলাদেশ হয়ে উঠার সময়গুলো। তুমল ঝড়, ব্যাপক আত্মবিশ্বাস, বিসর্জনের স্তুতি– সব মিলিয়ে স্বাদেশিক-অভূতপূর্ব এক ব্যাপার। ভাবনায় জেগে উঠে রক্তনদী, লাশ, খুন… বহুদিন ধরে হেঁটে চলা এই সময় সিঞ্চন-শংকরে ভরা। কেমন পবিত্রতর একটা প্রলেপ। অথচ গোরস্থানে শহীদেরা শুয়ে শুয়ে ভাবছে অন্যকিছু! এ্যাঁ, এতদিন লাগে? এতদিনের মামলা নাকি! লজ্জ্বিত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। পরদেশ থেকে শেখা স্যরি শব্দটি উচ্চারণ করে টুপ করে। অথচ শব্দটির সাধ্য নেই অত বেদনা লুকোবার! ওদিকে, জীবিতদের রাজনীতিমার্কা কারসাজিতে শহীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে কেবল। গোবরসুরত বুদ্ধিবিক্রেতারা বকতে থাকে বিরামহীন, বেশরমভাবে। কেঁপে উঠে লীলাবতীদের আসন। শীতের প্রকোপ বাড়তে থাকলে তরুণেরা জোগাড় করতে থাকে শীতবস্ত্র। রাতের আধাঁরে কিছুটা কুয়াশা আর শীতবায়ু খেয়েদেয়ে তারা খুঁজে বেড়ায় সমস্যাসংকুল মানুষদের। কুয়াশার দেয়ালের ভেতরেও কম্বল কি গরম জামা পাওয়ার হাসি দৃশ্যমান হতে থাকে, দেখা যায় এক ফালি দাঁত। এমন হাসির নাম দেয়া যেতে পারে বিজয়ফুল। পৃথিবীর যেকোন মানবিক অর্জনের গোত্রভুক্ত নাম বিজয়, এরা ফুলের নাম বিলিয়ে যায় আতরঘ্রাণ।
শীত বাড়তে থাকে বেশরমের মতো। ওদিকে পাতাঝরাদের আবহসংগীত ধরে মিড়িয়াপাড়ায় সোর উঠে বিজ্ঞাপনচিত্রের। ত্বককে সুস্থ্য রাখতে, মসৃণ ও আবেদনময়ী করতে এগিয়ে আসে বিশ্বগ্রামের নানা প্রোডাক্ট। মোলায়েম ত্বকের বাসনায় বাংলার ঘরে ঘরে সাড়া পড়ে যায় কেমনতরো; ওসব ক্রীম কি লোশন হাতের নাগালে না-এলেও নারিকেল তৈল কিংবা সরিষার তৈলের গরীবী আয়োজন নিজেকে সামিল করে আমজনতা। ম্যাংগোপিপল যেহেতু ভোটের পূর্বেই দাম পায় উপরমহল কর্তৃক তাই তারা ভুলে যায় যত্ন-আত্মীর কথা। পরম্পরার হার্দিক সম্পর্কে ধূলো পড়তে পড়তে আনন্দগুলো ভোঁতা হয়ে যায় অনেকটা কিন্তু একটু আদরে, একটু মমতায় জেগে উঠে সবুজ পাতা। ফলত, বিজ্ঞাপিত লোশন শরীরে মাখার আগে মনের কোণে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। জগতের সকল অর্জনেই কি ঢালতে হয় আলগা- পিরিত? বিজয়কে যত্ন দিতে হয়, স্বাধীনতা ভোগে পরিমিতিবোধ, সার্বভৌমত্বের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা ও কর্মের সমন্বয়ে এ-যত্ন পরিস্ফুট হয় আধাঁর ভেদ করে। বিজয়কে যারা আদর দেয় না, তাদের কোন অধিকার নেই মুখে পতাকার ছবি আঁকার, শব্দকে কাবু করে কবিতা লেখার। জঞ্জাল আর আবর্জনা তৈরি হয় প্রেমের অভাবে, রাষ্ট্রযন্ত্র দুর্বল হয়ে যায় ভালোবাসার অভাবে, সমৃদ্ধি আর প্রগতির স্রোতটি ক্ষীণ হয়ে আসে মহব্বতের অভাবে। বিজয় কেবল উদযাপনের নয়, উদ্দীপনার, বোধের, জাগরণ আর জাগিয়ে দেয়ার। ঘুম ভাঙানোর মিছিল যত দীর্ঘ হয়, বিজয়ের সৌন্দর্য বিকশিত হয় দ্রুতবেগে। এই সুন্দর ভারী মানায় তরুণদের কাঁধে, তাদের কাতারে।
৩.
কলমটা কেমন বেয়াড়া ঘোড়ার সুরত ধরতে চায়। তাকে টেনে ধরি, কুল পাই না। ওদিকে ভাই আমার অপেক্ষমান, বিজয়ের গদ্য নিতে! কলমটা হেঁটে হেঁটে কালির গভীরে চলে যায়? পরদাদা বলেছিলেন, এটাই বিজয়! মোক্ষম শব্দ পাইনি বলে কাঁদবো না, ওসব আমার ধাতে নেই। তরুণপ্রাণ কেউ যখন শব্দের ভেলায় চড়ে মরিচা ছাড়ানোর অসামান্য কাজে ডুবে থাকে, তাকে পেয়ে বসে বিজয়-সুন্দরের বাসনা। বিজয়কে ভেতরগত লালনের ব্যাপার-স্যাপার এভাবেই উন্মুক্ত হয়ে যায়। তখনো শীতকাল আসতো, অতিথি পাখি আসতো। অতিথিপাখির রক্তে হাত লাল হতো, শীতবস্ত্র বিতরন চলতো অথচ এসবের ভেতর গোপনে কি প্রকাশ্যে খেলা করতো রক্তের দামামা। একাত্তরের পর, বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ চিহ্নিত হবার পর থেকে বিজয় নিশ্চিত। ফলত, নানা কিসিমের মুক্তচিন্তা আর মুক্তির পায়রা বাসা বাঁধে তরুণপ্রাণে। নানা দিকের ক্যাচাল, কাজিয়া-ফ্যাসাদ, গোঁজামিল থেকে মুক্তি চায় নতুনেরা। মুক্তির এই আকাঙ্খা আছে বলেই বাংলাদেশ নানা সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে চমৎকারভাবে। এগিয়ে যাওয়ার চিরন্তন আঁকর একাত্তর। প্রতিবার বিজয় দিবসের প্রক্কালে এই মুক্তবাদ ফিরে ফিরে আসে আমাদের প্রাঙ্গনে। অবস্থানভেদে নানা রূপের বিজয়কে উদযাপন করতে হয়, উপভোগ করতে হয়, আর দিতে হয় ভোগ। বাংলাদেশ ভূখন্ডের বিজয়কে মহান করতে যেসব মানুষেরা শ্রম দেয় তাদের মন হয়ে যায় দক্ষিণমুখী জানালা। শীতশেষে নতুন হাওয়ার যোগান দেয়া এসব জানলা-মানুষকে স্যালুট। তরুণপ্রাণ বিজয়কে রাঙাতে যারা দিনমান ভাবতে থাকে নানান সৃজনক্রীয়ায় তাদের টুপিখোলা অভিবাদন!
লেখক: কবি ও গদ্যকার