ডিসেম্বরেই চালু হতে পারে আমিরাতের ভিসা

গত ১৫ অক্টোবর সংযুক্ত আরব আমিরাতের মানব সম্পদ ও আমিরাতিকরণ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ড. ওমর আবদুর রহমান আল নুয়েইমির নেতৃত্বে ৭ সদস্যের একটি সরকারি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে যান। এর ২ দিন আগে আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ডা. মোহাম্মদ ইমরান প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানাতে দেশে যান। তাঁরা ১৬ অক্টোবর ঢাকায় ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট এন্ড ট্রেনিং (বিএমইটি), বাংলাদেশের জনশক্তি উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন। এছাড়া তাঁরা ঢাকার গুলশানস্থ ইউএ ই ভিসা সেন্টারও সফর করেন। সফরের শেষদিন ১৭ অক্টোবর তারা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি’র সাথে বৈঠক করেন।

দীর্ঘ হোমওয়ার্কের ফসল ছিল যা ঃ ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর ইউ এ ইতে রাষ্ট্রীয় সফর, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও আবুধাবী দুতাবাস এবং সর্বশেষ গত ১০ অক্টোবর ব্যংককে এশীয় কো-অপারেশন ডায়ালগের শীর্ষ সম্মেলনে আসা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সাথে আমিরাতের জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. থানি আহমেদ আল জেইয়ুদির বৈঠকের ফসল বলে ধরা হচ্ছে। যদিও এরই মধ্যে এরাবিয়ান গালফের গড়িয়ে গেছে বহুদুর, এক রকম অভিভাকহীন হয়ে পড়ে থাকা বহু বাংলাদেশি প্রবাসীর আহাজারিতে, কান্নায় ভারী হয়েছে আমিরাতের আকাশ।
২০১২ সালের মধ্য-অগাস্ট হতে এদেশে বাংলাদেশিদের ভিসা ও আভ্যন্তরীণ রিলিজ ট্রান্সফার বন্ধ হয়ে পড়ায় এদেশের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অবস্থান নাজুক হয়ে পড়ে। প্রান্তিক শ্রমজীবী থেকে শুরু করে পেশাজীবী শ্রেণীঅব্দি সর্বত্রই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ২০১২ সনের অক্টোবরে ইউএই সরকারের একজন আন্ডার সেক্রেটারি প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে এই ভিসা বন্ধের কথা স্বীকার করেন।
বাংলাদেশিদের গুণতে হয়েছে চড়ামূল্য ঃ ভিসা বন্ধের আগে যেখানে প্রতি বছর ইউএইতে ২ লাখ করে বাংলাদেশি অভিবাসী এদেশের শ্রমবাজারে ঢুকেছেন সেখানে কার্যত কিছু নারী গৃহকর্মী,আরব গৃহের ব্যক্তিগত গাড়ি চালক, কুক আর ফ্রি-জোনের কিছু ভিসা কেবল বের হয়েছে। এটি ছিল হতাশাব্যঞ্জক। এ ভাবে হঠাৎ করে ভিসা বন্ধে বড়ই বিপাকে পড়ে বাংলাদেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীরা, ভেস্তে যায় তাদের শত কোটি টাকার বিনিয়োগ দেশীয় জনশক্তির অভাবে অনেককেই ব্যবসা গুটিয়ে দেশে ফিরে যেতে হয়েছে, কেউবা বাজারে দেনা রেখে পালিয়েছেন দেশে। যারা চাকুরীজীবী বা শ্রমজীবী ছিলেন তাদের মধ্যে হাজারো প্রবাসীকে অর্থনৈতিক মন্দা সহ বিভিন্ন কারণে কাজ হারিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে দেশে। ভিসাবন্ধের এইদীর্ঘ সময়ে ঘরমুখো প্রবাসীর মিছিল দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হয়েছে। লিওয়ার কৃষি শ্রমিক থেকে শুরু করে রাসাল খাইমার মোটর মেকানিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে দেশে ফিরে যেতে হয়েছে।
যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে রেমিটেন্স প্রবাহে। এটা ঠিক যে এই ভিসা বন্ধের পুরো সময়টা আমাদের জন্য ছিল ‘এসিড টেস্ট’।
অপরাধ তালিকা থেকে বাংলাদেশিদের ‘গুড-বুক’ এ আসা ঃ আমিরাতে বিচারিক প্রতিষ্ঠান কিংবা কারাগারগুলোয় অপরাধ কর্ম ও অপরাধীর তালিকায় শীর্ষ অবস্থান থেকে বাংলাদেশিরা এখন এদেশের ‘গুড-বুক’ এ আসতে শুরু করেছেন। ইউএই’তে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ডা. মোহাম্মদ ইমরান এদেশের সরকারের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে দুতিয়ালি করতে যেয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা জেনেছেন এবং মনে করছেন যে ভিসা খোলার একটা উপযুক্ত পরিবেশ বর্তমানে বিরাজমান। তাই যে কোন সময় ভিসা খোলার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি প্রবাসীদের প্রতি এদেশের আইন শৃঙ্খলার প্রতি সম্মান দেখিয়ে নেতিবাচক কোন পরিস্থিতি যাতে আমাদের এ অর্জনকে বিপথগামী না করে সে বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ ভিসা পুনরায় চালুর ব্যাপারে আমাদের এ সময়ের কর্মকা-কে বিবেচনায় আনা হবে। তাই এক্ষেত্রে হতাশার মেঘ কেটেছে কিছুটা।
যদিও আমিরাতে ভিসা বন্ধের এ কঠিন সময়ে জনশক্তি রপ্তানির সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উম্মোচনকারী দেশ ওমান হতে আসছে অশনি সংকেত। ফ্রি ভিসার নামে আদম ব্যাপারিদের অবাধ ভিসা বাণিজ্য সেখানে প্রচুর কর্মহীন বাংলাদেশির জন্ম দিয়েছে, আর তাদের কেউ কেউ অপরাধ কর্মের সাথে জড়িয়ে পড়ায় এখন ওমানের এই বাজারটি আমরা হারাতে যাচ্ছি। কাতারে চলছে অবৈধভাবে সে দেশে অবস্থানকারীদের সে দেশ ত্যাগের জন্য সাধারণ ক্ষমা। সৌদি আরব ও আমিরাত এখন সবার কাছে কাছে নতুন আশার পিদিম।
সর্বনিম্ন মজুরীর ব্যাপারে নেই আশাব্যাঞ্জক খবর ঃ
বিশ্বব্যাপী তেলের দরপতন মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমেরবাজারে এনেছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। গালফ কো অপারেশন কাউন্সিল ভুক্ত দেশগুলোতে বর্তমানে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২.৩ শতাংশ। ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে মাত্র ২.৫ শতাংশ। সম্প্রতি আবুধাবীতে হয়ে যাওয়া মিডল ইস্ট সোসাইটি ফর হিউমান রিসোর্স এন্ড ম্যানেজমেন্ট এর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশি এক কূটনীতিক এই প্রতিনিধিকে জানান, এই সম্মেলনে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, নেপাল, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনসহ আরো বেশ কিছু দেশ অংশ নেয়। এতে আলোচনায় স্পষ্ট করে দেয়া হয় যে কিছু দেশের ইকনোমিক বুম (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি)’র কারণে কেউ যদি সর্বনিম্ন মজুরির অযৌক্তিক বৃদ্ধির কথা বলেন তাহলে এখানে আজকের মাঠ বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে না। আর তারা ন্যুনতম মজুরি নির্ধারণের পর তা কমপক্ষে দুই বছরের জন্য বাড়ানো যাবে না এইমর্মে নিশ্চয়তা চান। তাই মাঠ বাস্তবতার আলোকে বাংলাদেশ ন্যুনতম মজুরি ৮ শ দিরহামের মধ্যেই রাখছে। যা একমাত্র নেপাল ছাড়া বাকি সবগুলো দেশের ক্ষেত্রে এক হাজার দিরহাম বা তাঁর চেয়ে বেশী। তবে কাজের দক্ষতার ভিত্তিতে তার পরিবর্তন হতে পারে।
রিলিজ বা ভিসা ট্রান্সফার হচ্ছে না আগে ঃ আবুধাবীর কূটনৈতিক সূত্র ভিসা খোলার আগে ভিসা ট্রান্সফার চালুর একটি ইঙ্গিত দিয়েছিল, যদিও বর্তমানে তারা তাঁদের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। এটি ভিসা ট্রান্সফার প্রার্থীদের জন্য নিঃসন্দেহে একটি দুঃসংবাদ। রিলিজ/ ট্রান্সফার চালু হচ্ছে বাংলাদেশিদের জন্য একটি ‘কেস সেন্সেটিভ ইস্যু। আমিরাতে নতুনভাবে ভিসা খুলুক আর নাই খুলুক অন্ততঃ রিলিজ/ ট্রান্সফার চালু হলে প্রবাসীরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচতেন। ভিসা ট্রান্সফার চালু হলে প্রবাসে নেমে আসতো স্বস্তি। কোম্পানিতে কাজ না থাকায় বেতন ভাতা বন্ধ হয়ে পড়াসহ বিভিন্ন কারণে চাকরি হারিয়ে বহু সংকটে পড়েছেন বাংলাদেশিদের অনেকেই। ভিসা খোলার আশায় তাঁরা দিন গুণে হয়রান হয়েছেন, চেয়েছেন অন্ততঃ ভিসা ট্রান্সফার চালু হোক। এরিমধ্যে অনেকে হয়ে পড়েছেন অবৈধ। জেল জরিমানার দ- গুণতে হবে জেনেও কেবল ভিসা ট্রান্সফার চালুর আশায় তারা রয়ে গেছেন আমিরাতে। কিন্তু তা ভিসা খোলার আগে চালু হচ্ছে না বলে দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে। আগাম রিলিজ চালু হলে প্রবাসীরা দ্রুত কোম্পানি বদল করবেন, তাতে জনশক্তির বাজারে একটা ভারসাম্যহীনতা দেখা দেবে, তা আমিরাত কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় আনছেন। তাই তাঁরা ভিসা রিলিজ/ ট্রান্সফার
চালু করতে যাচ্ছেন ভিসা চালুর একই সাথে।
কবে চালু হচ্ছে ভিসা ঃ কবে চালু হচ্ছে ভিসা… এ প্রশ্নটি হচ্ছে এখন লাখো প্রবাসীর কাছে পয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট বা আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। আমিরাতি সরকারি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ সফর সম্পন্ন করেছেন, আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ডা. মোহাম্মদ ইমরান প্রতিনিধিদলের সাথে থেকে পুরো সফরটি সমন্বয় করেছেন। দূতাবাসের সূত্রটি নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিনিধিকে বলেছেন, এ সফর অত্যন্ত ফলপ্রসু হয়েছে। এখন বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানির ব্যাপারে তাঁরা নতুন করে সমঝোতা স্মারক বা গঙট স্বাক্ষর করবেন, যার পরপই ভিসার দ্বার অবমুক্ত করা হতে পারে। জটিল কোন পরিস্থিতির উদ্ভব না হলে মধ্য ডিসেম্বরের মধ্যে ভিসা খোলার সম্ভাবনা আছে। দূতাবাসের সূত্রটি বলেছে আমরা ডিসেম্বরের মধ্যে ভিসা খোলার যে আশ্বাস পেয়েছি তার বাস্তবায়ন দেখতে চাই, যেমনটা দেখতে চান লাখো প্রবাসী। প্রবাসীরা ভিসা পুরোপুরি না খোলা অবধি জোরালো ভিসা ডিপ্লোমেসি অব্যাহত থাকুক এটা চান সরকারের কাছে।
সূত্রঃ পূর্বকোণ

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *