চাঁদপুর-তৈলারদ্বীপ শঙ্খতৃতীয় সেতুর টোল সম্প্রতি আনোয়ারা, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, পেকুয়া ও চকরিয়া উপজেলার মানুষের জন্য একটি মুখরোচক আলোচ্য বিষয়ে পরিনত হয়েছে। শঙ্খের তৃতীয় সেতুই বাঁশখালী উপজেলাকে হাজারো বিড়ম্বনার যাতায়াত ব্যবস্থা থেকে মুক্ত করে। চট্টগ্রাম জেলা শহর তথা সমগ্র দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে বাঁশখালী সারাসরি সম্পৃক্ত হলো ২০০৬ সালে। ১৯৭১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাঁশখালীবাসীর জেলা শহরে যোগাযোগের ইতিহাস যেমন করুন তেমনই বিড়ম্বনার। পায়ে হেঁটে, সাম্পান যোগে, স্টিমারে, সাতকানিয়া-পটিয়া হয়ে জীপ গাড়ি যোগে, বাস যোগে, তৈলারদ্বীপ-চাঁদপুর পয়েন্টে ফেরি যোগে যাতায়াত বিড়ম্বনা এখন শুধু ইতিহাস। স্মৃতিচারণ বর্তমান প্রজন্মের কাছে বানানো গল্প মনে হবে।
বাঁশখালীর দুঃখ খ্যাত শঙ্খনদীর উপর ব্রীজ নির্মাণ সমাপ্ত হবার পর আমরা মনে করেছিলাম আমাদের যাতায়াত বিড়ম্বনার দুঃখ ঘুচবে । কিন্তু ব্রীজ চালু হবার পর নতুন সংকটের মুখোমুখি হলো যাত্রী সাধারণ। পি এ বি সড়ক যানবাহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের অশুভ থাবার কবলে জিম্মি হলো বাঁশখালী, পেকুয়া, কুতুবদিয়াসহ বাঁশখালী সড়ক ব্যবহারকারী যাত্রী সাধারণ। পেট্রোল, ডিজেলসহ তেলের মূল্য কমলেও ভাড়া কমানো দূরের কথা টোল ভাড়ার অজুহাতে বাড়তি ভাড়া আদায়ের পাশাপাশি বৃহস্পতিবার, শুক্রবার, শনিবার এবং যে কোন উপলক্ষ পেলেই গলাকাটা ভাড়া আদায় করে। জলদির ভাড়া ৬০ টাকার স্থানে নেয় ১০০ টাকা আর পুকুরিয়া, চাঁদপুরের সরকারি নিয়মের ২২ টাকা ভাড়াও নেয় একশত টাকা। আপনি তাদের শর্ত মেনে উঠলে গাড়িতে তোলবে, নয় তো গাড়িতে উঠতে দেবে না।
২. ১৯৯১ সালের পর বাঁশখালীর যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতির দিকে মোড় নেয়। আনোয়ারা উপজেলার উপর দিয়ে বাঁশখালী সড়ক যোগাযোগ শুরু হয় ১৯৯৫ সাল থেকে। শঙ্খনদীতে ফেরি পারাপার শুরুর মধ্যদিয়ে। এর পর ২০০৬ সালে শঙ্খ তৃতীয় সেতু চালু হলেও আনোয়ারা বাঁশখালীর গাড়ি ছাড়া অন্যকোন গাড়ি বাঁশখালী রোড়ে ঢুকতে দেয়নি মালিক-শ্রমিক সমিতি। এমনকি কোন মাইক্রোবাস সার্ভিস পর্যন্ত । বাঁশখালীর ও তৎসংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ বাস মালিক ও শ্রমিকদের হাতে জিম্মি। যারা একাত্তোর সালের পর থেকে বাঁশখালীর জনপ্রতিনিধি ছিল তাদের কাছ থেকে যাত্রীসাধারণ কোন রকম সহযোগিতা পেতে দেখা যায়নি।
আমরা জানি তাদের সিদ্ধান্ত সব সময় মালিক শ্রমিকের পক্ষেই ছিল। অনেকের বউ বাচ্চারা গাড়ির মালিক ছিল, আবার মালিক শ্রমিক নেতারা অনেকের আত্মীয় স্বজন ছিল। অতীতের সাংসদরা যাত্রীসাধারণের পক্ষে কাজ করতে আমরা দেখিনি। আমি নিজে যাত্রী কল্যাণ সমিতির ব্যানারে উপজেলা নির্বাহীর অফিসে বহুবার বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম। মালিক সমিতি যাত্রীদের সমস্যা সামাধানের বার বার আশ্বাস দিয়েছে কিন্তু আশ্বাসঘাতকতাই করতে দেখেছি। ২০০৬ সালে শঙ্খসেতু চালু হলে প্রথমে ফেরির ইজারাদার তার মেয়াদ শেষ না হওয়ায় ব্রীজ থেকে টোল তোলা শুরু করে। দোহাজারী সড়ক বিভাগ ফেরির টোলের মেয়াদ শেষ হবার পর ব্রীজের টোলের জন্য আবার ইজারাদার বসায়। সেই থেকে শঙ্খব্রীজে টোল স্থায়ী রীতি হয়ে যায়। তখন থেকে কোন নেতা টোলের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। টোল আদায়ের প্রায় ১১ বছর পর ২০১৭ সালে আলহাজ মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী শঙ্খসেতুর টোলের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন। যুক্তি দেখান দোহাজারী ব্রীজের টোল মুক্ত অবস্থার। তবে যত মিটার দুরত্বের ব্রীজে টোল নাই তার চেয়ে শঙ্খসেতুর দুরুত্ব বেশি। তা যাই হোক টোলে সরকারের রাজস্ব আসে। দেশ থেকে রাজস্ব আদায় না করলে সরকার দেশ চালাতে টাকা কোথায় পাবে _ এমন যুক্তি সরকারের। টোল যেহেতু শঙ্খসেতুতে শুরু থেকে আদায়ের কাজ শুরু হয়েছে তা সরকার বা কোর্ট হয়তো বাতিল করবে না। এটা সাধারণ যুক্তি। তবু দীর্ঘ প্রায় ২৭ বছর বাঁশখালীর রাজনীতি থেকে দূরে থেকে মাহমুদু মিয়া শঙ্খসেতুর টোল বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছেন সে জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই। তার সাথে টোল ফ্রি সুবিধাভোগী সিএনজি অটোরিক্সা মালিক শ্রমিক সংগঠন এবং বাস মালিক শ্রমিক সংগঠন মাহমুদু মিয়ার উপর মহাখুশি। তাঁকে গণসংবর্ধনার আয়োজন করলো সিএনজি সংশ্লিষ্টরা।
উল্লেখ্য যে, টোল ফ্রিতে যাত্রীসাধারণের
কোন উপকার হলো না। তবু মাহমুদু মিয়ার বাহাদুরিতে তাঁর পুরানো সমর্থকরাও মহাখুশি। কিন্তু সরকার দলীয় সংগঠন মাহমুদু মিয়ার গণসংবর্ধনা পণ্ড করে দিল।
৩. বাঁশখালী আনোয়ারা সীমান্তবর্তী শঙ্খ তৃতীয় সেতুর টোল বন্ধের এক মাসের মাথায় ২৪ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টা থেকে পুনরায় আপিল বিভাগের নির্দেশ পেয়ে দোহাজারী সড়ক ও জনপথ বিভাগ আবার টোল আদায় শুরু করে। টোল স্থগিতাদেশ হয়েছিল ২৪ আগস্ট। ২৫ সেপ্টেম্বর তা আবার চালু হয়ে যায়।
একমাস টোল বন্ধ থাকায় সরকার ১৬ থেকে ১৮ লাখ টাকার রাজস্ব হারিয়েছে এমন তথ্য দেন দোহাজারী সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলি তোফাইল মিয়া।
একদিকে হাই কোর্ট থেকে মাহমুদু মিয়ার টোল বন্ধের আদেশ এনে টোল বন্ধ করা, অন্যদিকে সরকার পক্ষের আপিল বিভাগের নির্দেশনা নিয়ে আবার টোল আদায় পুরোটাই একটা হালকা রাজনীতি ছাড়া আর কিছু নয়।
বাঁশখালীর সকল প্রকার যাত্রীবাহি গাড়ির স্থায়ী নিয়ম মাফিক ভাড়ার সংস্কৃতি যে নেতা প্রবর্তন করতে পারবেন তিনিই হবেন প্রকৃতপক্ষে বাঁশখালীর গণমানুষের উপকারকারি নেতা। আমরা চাই রাজনীতিবিদরা দলীয় আদর্শ আর সুন্দর ব্যক্তি চরিত্র নিয়ে জনগণের কাছে আসুক। আমাদের অপেক্ষা জনগণের প্রকৃত সেবকের জন্য। নেতাদের চরিত্র হতে আশ্বাস ঘাতকতা, প্রতারণা, ভণ্ডামী, আত্মসেবার উদ্দেশ্য বর্জিত হোক। আমিন।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক