BanshkhaliTimes

জ্ঞানতাপস অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র সিংহ

BanshkhaliTimes

জ্ঞানতাপস অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র সিংহ
-মুহাম্মদ তাফহীমুল ইসলাম

জ্ঞানতাপস, শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র সিংহ। উপমহাদেশে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিস্তারে যার অনুপম ভূমিকা সর্বজন স্মীকৃত। প্রাজ্ঞ এই শিক্ষাগুরু চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার প্রথম এম. এ ডিগ্রীপ্রাপ্ত ব্যক্তি। অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র সিংহ ১৮৯০ সালে জন্মগ্রহণ করেন বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর গ্রামে। বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে তিনি পটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্টিকুলেশন পাশ করেন। জ্ঞানের পীপাসায় কাতর যোগেশচন্দ্র সিংহ এরপর ভর্তি হন কলিকাতা সিটি কলেজে। পরবর্তীতে সেখান থেকে আই. এ ও ইংরেজী সাহিত্যে বি. এ পাশ করেন। এসময় আই. এ পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল করায় তিনি বঙ্কিমচন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। অতঃপর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে কৃতিত্বের সাথে এম. এ ডিগ্রী লাভ করেন। তখন খ্যাতিমান সাহিত্যিক ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী অধ্যাপক ছিলেন।

১৯১৮ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ইংরেজী অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র সিংহের কর্মজীবন শুরু। সেখানে টানা ৩০ বছর অধ্যাপনা করে ১৯৪৮ সালে তিনি অবসরগ্রহণ করেন। শেষের দিকে তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যক্ষও নিযুক্ত হয়েছিলেন। এসময় পাকিস্তান জাতীয় সংসদের স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরী, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের প্রথম রাষ্ট্রদূত শ্রী সুবিমল দত্ত, রম্য সাহিত্যিক অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ প্রমুখ অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র সিংহের ছাত্র ছিলেন। এরপর কমার্স কলেজের আহবানে সেখানে দুই বছর অধ্যাপনা করেন। চট্টগ্রামের প্রখ্যাত সমাজকর্মী বাদশা মিয়া চৌধুরী চট্টগ্রামে একটি নৈশ কলেজ (বর্তমান সরকারি সিটি কলেজ) প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাঁর অনুরোধে ১৯৫৪ সালে যোগেশচন্দ্র সিংহ সেই কাজে ব্রতী হন এবং প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে যোগেশচন্দ্র সিংহ সেখানে যোগ দেন। এরপর ১৯৫৭ সালে অবহেলিত নারী জাতির উচ্চ শিক্ষা বিস্তারে দিবাভাগে একই কলেজের ভিক্টোরিয়া ইসলামীয়া হোষ্টেল ভবনে মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে অধ্যক্ষ হিসেবেও গুরুদায়িত্ব পালন করেন তিনি। এই কলেজ পরবর্তীতে নাসিরাবাদ সরকারি মহিলা কলেজে রূপান্তরিত হয়। চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ ও চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পূর্ণাঙ্গ কলেজে রূপান্তরে অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র সিংহের অবদান অনস্বীকার্য। এই মহান শিক্ষাগুরু ১৯৫৮ সালে বার্ধক্যজনিত কারণে শিক্ষকতা পেশা থেকে নিরবিচ্ছিন্ন অবসরগ্রহণ করেন। বৃহত্তর চট্টগ্রামের শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে।

অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র সিংহ টানা ৩৮ বছর অধ্যাপনা শেষে অবসর গ্রহণের পর লেখালেখিতে ব্রতী হন। এতোদিন লেখালেখিতে সক্রিয় না হলেও সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ে তিনি অর্জন করেছেন অসাধারণ পাণ্ডিত্য। বিশেষ করে রবীন্দ্র সাহিত্যে তাঁর পাণ্ডিত্য সর্বজন স্মীকৃত। শিক্ষকতা জীবনেও যোগেশচন্দ্র ইংরেজী ক্লাসে অনর্গল রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতার উদ্ধৃতি দিতেন। রবীন্দ্র সাহিত্য ছিল তাঁর নখদর্পনে। যার অনন্য সাক্ষী তাঁর রচিত প্রবন্ধ ‘ধ্যানী রবীন্দ্রনাথ’। বাইশটি প্রবন্ধ নিয়ে মলাটবদ্ধ হওয়া এই গ্রন্থ যোগেশচন্দ্র সিংহের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কীর্তি। এই গ্রন্থে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্য নিয়ে সুবিস্তর আলোচনা রয়েছে। বইটি সাহিত্যিক ও পাঠক মহলে বেশ গ্রহণযোগ্য ও আলোচিত বই। বাজারে দুর্লভ বইটির নতুন সংস্করণ সময়ের দাবি। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রাস লীলা, মাতৃ প্রশান্তি, পরম বৎস অদ্বৈতানন্দ, দুর্গাপূজার নব পত্রিকাতত্ত্ব, গীতা বোধিনী (৪ খন্ড), স্বরসতী তত্ত্ব, সীতা কালী, পিতৃ তর্পণ ও পিতৃ পূজা উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ধর্মীয় ও সাহিত্যের নানা বিষয়ে বিভিন্ন পত্রিকা, সাময়িকীতে যোগেশচন্দ্রের অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র সিংহ শুধুমাত্র শিক্ষক ও সাহিত্যিকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন পূজনীয় ধার্মিক ও দেশপ্রেমিক মহাপুরুষ। নিজ ধর্মের প্রতি তিনি ছিলেন অবিচল আস্থাশীল ও বিশ্বাসী। শুধু নিজ ধর্ম নয়, অন্য ধর্মের দর্শন জানতেও তিনি ছিলেন উদগ্রীব। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় তাঁর স্বধর্মের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সকলে দেশ ত্যাগ করে ভারত চলে যান। তিনি দেশকে এত গভীরভাবে ভালবেসে ছিলেন যে সে কঠিন সময়েও তিনি দেশত্যাগ করেননি। বিখ্যাত এই মনীষীর পুরো জীবন একজন আদর্শ মানুষের উপমাযোগ্য অনন্য উদাহরণ। জ্ঞানতাপস অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র সিংহ ১৯৭৯ এর ১৫ সেপ্টেম্বর ৮৯ বছর বয়সে চট্টগ্রাম শহরের রহমতগঞ্জস্থ নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী জন্মস্থান বাঁশখালীর সাধনপুরে তাঁর শেষকৃত্যানুষ্ঠাদি সম্পন্ন হয়। বর্তমান সময়ে তাঁর মতো কর্মপ্রিয় দায়িত্ববান মানুষের খুব প্রয়োজন। নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর জীবন, কর্ম তুলে ধরা উচিত।

সূত্র:
চট্টগ্রামের কবি সাহিত্যিক,
দৈনিক আজাদী,
বাফা-৭ম সংখ্যা

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *