জিলহজ মাসের প্রথম দশদিনের আমল ও ফযিলত

জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের ফজিলত ও আমল
আরবি বারো মাসের সর্বশেষ মাস জিলহজ মাস। এ মাসটি বছরের চারটি সম্মানিত মাসের একটি। অনেক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এ মাস। এ মাসে কেউ পবিত্র হজ পালন করে ধন্য হবেন, আবার কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পশু কোরবানি করবেন। অন্যদিকে, আল্লাহর এমন কিছু বান্দা থাকবেন যারা এ দুটি আমলের কোনোটিই করবেন না। সম্পদশালী ব্যক্তি যাদের ওপর হজ ফরজ হয়েছে এ মাসেই তারা সেই হজ সম্পাদন করবেন। হাজী সাহেবান এবং যারা হজ করবেন না তবে কোরবানি করবেন তারাও এ মাসেই কোরবানি করবেন। তাহলে যারা এর কোনোটিই করবেন না তারা কী করবেন? তারা কি এ মাসের ফজিলত থেকে বঞ্চিত হবেন? না, রাহমানুর রাহিম আল্লাহ উল্লিখিত আমল ছাড়াও এমন বিশেষ কিছু ‘আমলের ব্যবস্থা রেখেছেন যা সবার জন্য উন্মুক্ত। জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনে সে ‘আমলগুলো পালন করে তারাও সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। এ দশ দিন সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসের আলোকে কিছু তথ্য উপস্থাপন করছি।
১. ক. আল্লাহ তায়ালা ফাজর ও দশ রাতের কসম খেয়েছেন। (অর্থানুবাদ, ফাজর:২)। ইবন কাছিরের ভাষ্যনুযায়ী ইবন ‘আব্বাস, ইবনুজ জুবাইর ও মুজাহিদ প্রমুখের মতে এ দশ রাত হলো জিলহজ মাসের প্রথম দশ রাত।
খ. অন্য একস্থানে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন যার অনুবাদার্থ হলো, ‘আর তারা নির্ধারিত দিনে আল্লাহর নাম স্মরণ করে থাকে।’ (হাজ: ২২)। ইবন ‘আব্বাস থেকে বর্ণিত জিলহাজের প্রথম দশদিনকেই ‘নির্ধারিত দশ দিন’ বলা হয়েছে। আবু মুসা আশআরি, মুজাহিদ, ‘আতা ও সাঈদ ইবন জুবাইর থেকেও অনুরূপ বর্ণিত। (ইবন কাছির)।
গ. আল্লাহর সান্নিধ্যে মুসা আলাইহিস সালাম যে চল্লিশ দিন তুর পাহাড়ে কাটিয়েছিলেন এ দশ দিন সে দিনগুলোর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
২. ফজিলত:
ক. হাদিস গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নেক ‘আমলের ক্ষেত্রে আল্লাহর নিকট এ দিনগুলোর চেয়ে উত্তম অন্য কোনো দিন নেই।’ (অর্থাৎ জিলহজ মাসের এ দশ দিন।) জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর রাহে জিহাদও নয়? তিনি – সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহর রাহে জিহাদও নয়। তবে ইতঃপূর্বে যদি কেউ জানমাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশে বেরিয়ে গেছে এবং সে এগুলোর কিছুই নিয়ে ফিরে আসেনি।’ (বুখারি)। অর্থাৎ সে শাহাদত বরণ করেছে। (ফাতহুল বারি)। হাদিস থেকে বুঝা যায় বছরের শ্রেষ্ঠ দশ দিন হলো জিলহজ মাসের এ দশ দিন।
খ. এ দশ দিনের একদিন হলো আরাফার দিন যে দিনের কসম খেয়েছেন আল্লাহ পাক তার কালামে। ‘এবং কসম জোড় ও বেজোড়ের’। (অর্থানুবাদ, ফাজর:৩)। এ বেজোড় দিনটি হলো জিলহজ মাসের ৯ তারিখ যা ইয়াওমু ‘আরাফা নামে প্রসিদ্ধ। হাদিসের আলোকে ইয়াওমু আরাফা তথা আরাফার দিনকে সবচাইতে মর্যাদাপূর্ণ দিন বলা হয়েছে। (ইবন হিব্বান: সহিহ)।
গ. এ দিনকে জাহান্নাম থেকে মুক্তির দিনও বলা হয়। হাদিসে বর্ণিত, আরাফাতের দিনের চাইতে আর কোনো দিন এমন নেই যেদিন আল্লাহ বান্দাদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন; তিনি সে দিন নিকটবর্তী হন অতঃপর তিনি তাঁর ফেরেশতাগণের সাথে গর্ব প্রকাশ করেন এবং বলেন, তারা কী চায়? (মুসলিম: সহিহ)।
৩. এ দিনগুলোতে যে বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে সেগুলো হলো-
এক. খালিস তাওবা করতে হবে এবং বিরত থাকতে হবে যাবতীয় গুনাহ থেকে। কারণ গুনাহে লিপ্ত হওয়া মানুষকে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত করে এবং তার ও মাওলার মাঝে পর্দা টেনে দেয়।
দুই. এ সময় সত্য পথে চলার জন্য থাকতে হবে নিষ্ঠা, সততা, আন্তরিক প্রতিজ্ঞা ও দৃঢ় প্রত্যয়। যিনি আল্লাহর সাথে সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবেন অবশ্যই আল্লাহ পাক তাকে তার প্রতিশ্রুতি পালনে সাহায্য করবেন।
তিন. যারা কোরবানি (ওয়াজিব হোক বা নফল) করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা জিলহজ মাসের প্রথম তারিখ থেকে কোরবানি না দেয়া পর্যন্ত নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকবেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে পাকে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা জিলহজ মাসের চাঁদ দেখলে এবং তোমাদের মধ্যে কেউ কোরবানির নিয়ত করলে সে কোরবানি না করা পর্যন্ত চুল-নখ কাটা থেকে বিরত থাকবে।’ (মুসলিম: সহীহ)।
৪. এ দিনগুলোতে করণীয় আমলসমূহ:
এক. পুরুষরা নিয়মিত জামায়াতে এবং মহিলারা সময়মতো ফরজ সালাত আদায় করবে। সকলেই যত বেশি সম্ভব নফল সালাত আদায় করবে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহর নিকট নেক ‘আমলের জন্য এর চাইতে উত্তম দিন আর নেই। তা ছাড়া প্রতিটি সাজদার জন্য রয়েছে বিশেষ ফজিলত।
দুই. এক থেকে নয় তারিখ পর্যন্ত সাওম পালন করবে। বিশেষ করে নয় তারিখ ইয়াওমু আরাফা বা আরাফার দিন। এ প্রসঙ্গে উম্মুল মু’মিনীন হজরত হাফসা থেকে বর্ণিত যে, ‘নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘আশুরার দিন, (জিলহজের প্রথম) দশ দিন (নয় দিন) এবং প্রতি মাসের তিন দিনের সাওম ছাড়তেন না।’ (আহমাদ: মুসনাদ)। আবদুল্লাহ ইবন ‘উমার এ সাওমগুলো পালন করতেন; জিলহজ মাসের দশ দিনের সাওম সম্পর্কে ইমাম নববীর মতো হলো, এটা অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ একটি মুস্তাহাব আমল।’
তিন. কিয়ামুল লাইল তথা তাহাজ্জুদ সালাতের প্রতি আরো বেশি যতœবান হতে হবে। জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনে সাঈদ ইবন জুবাইর প্রচণ্ড রকমের মেহনত করতেন যে, অনেক সময় মনে হতো, তিনি আর পেরে উঠছেন না। তার থেকে বর্ণিত যে, ‘এ দশ রাতে তোমরা ঘরের বাতি নিভিওনা।
চার. বেশি বেশি জিকরে মাশগুল থাকা। যেমন তাকবির (আল্লাহু আকবার) তাহলিল (লা-ইলাহা ইল্লাহ) তাহমিদ (আল-হামদুলিল্লাহ) ও তিলাওয়াতে সময় কাটানো। ইমাম আহমাদ এ প্রসঙ্গে ‘নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দেন যে, তিনি বলেছেন, ‘আমলের ক্ষেত্রে আল্লাহর নিকট এ দিনগুলোর চেয়ে প্রিয় ও মর্যাদাপূর্ণ অন্য কোনো দিন নেই। অতএব তোমরা এ দিনগুলোতে বেশি বেশি করে তাহলিল, তাকবির ও তাহমিদের জিকর করো।’ (আহমাদ: মুসনাদ)।
পাঁচ. ঘরে বাইরে যেন তাকবির ধ্বনি দেয়া হয়। এ সুন্নাতটি এখন প্রায় বিলুপ্ত। জিলহজ মাসের এ দশ দিন হজরত আবু হুরাইরা ও আবদুল্লাহ ইবন ‘উমার ঘর থেকে বের হয়ে বাজারমুখী হয়ে তাকবির ধ্বনি দিতেন; আর তাদের এ তাকবির ধ্বনির সাথে সাথে অন্যরাও তাকবির ধ্বনি দিত।
আমরা শুধু নয় তারিখ থেকে তেরো তারিখ আসর পর্যন্ত প্রতি ফরজ সালাতের পর ওয়াজিব তাকবির আদায় করে থাকি। কিন্তু এক থেকে দশ তারিখ পর্যন্ত যে তাকবির আছে তা শুধু কিতাবেই রয়ে গেছে। আমল করার মানুষ নেই। তাই আসুন, আমরা এ সুন্নাতের প্রচলন করি। যখনই ঘর থেকে বের হবো জোরে তাকবির দেব, যেন তাকবির ধ্বনি শুনে অন্যরাও তাকবির দেয়। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *