জলকদরের অবয়চিত্রঃ যেখানে যেমন জলকদর
মুহাম্মদ মোখতার হোছাইন সিকদার
এ-পর্যন্ত জলকদরের মৌলিকত্বের উপর একটি মোটামুটি বর্ণনা হয়ে গেছে। এখন আমরা আলোচনা করব জলকদরের উভয় পাড়ে অবস্থিত নানা কিছু নিয়ে। যা কিছু নিয়ে মূলত জলকদরের সংসার তারই বর্ণনা দেয়া হবে। সময়ের পরতে পরতে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় উভয় পাড়ের জনগণের কল্যাণে নানান উন্নয়ন সাধিত হয়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক প্রায় এক ডজনের মত ¯স্লুইচ গেইট স্থাপনের বিষয়টি জনস্বার্থে অতি গুরুত্বপূর্ণ। বাঁশখালীর পূর্বে অবস্থিত পাহাড় থেকে ছুটে আসা ছোট ছোট খাল বা ছড়াসমূহের জলকদরে সংযুক্তিটা একটি বহতা নদীর জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। সাথে প্রিয় বাঁশখালীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শুষ্ক মৌসুমে লবণ ও বর্ষায় মাছ চাষের বিষয়টি অনস্বীকার্য সত্য। তাই মাছ চাষ ও লবণ চাষ সংশ্লিষ্ট গুটি কয়েক খাল বা নালার বর্ণনা দরকার মনে করছি। কারণ সে সবের অনেক কিছু আজকের আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারতে বসেছে।
♦খাটহালী বাজার (১)
হাটখালী বাজার এখন আর সেই আগের রুপে নেই। বিশেষ করে এক সময় বঙ্গোপসাগরের কর্মরত নাইয়্যা-মাঝিরা এই হাটখালী বাজারে এসে তাদের সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক সফরের বাজার সংগ্রহ করে অকূল সমুদ্রে পাড়ি জমাতেন মৌসুমী মাছ সংগ্রহ করতে। বিশেষ করে ইঞ্জিন চালিত বোটগুলোর জন্য জালানী-তৈল সংগ্রহ করতেন বলে এই বাজারে বড় বড় তৈলের দোকান ছিল। অপরদিকে আমাদের পাশবর্তী কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া উপজেলার লোকজনও এই হাটখালী বাজার থেকে নিয়মিত নিত্যপ্রয়োজনীয় সদাই করতেন। উনারা আবার বাংলাবাজার, সরকার বাজার, বহদ্দার হাট ও বারিহাট/চাম্বল বাজার থেকে বাজার-বারসমূহে নিয়মিত করতেন।
♦ দৃষ্টিনন্দন জমিদার বাড়ি- (২)
হাটখালী বাজারের পূর্ব পাশেই একটি দৃষ্টিনন্দন বাড়ি ছিল। যা আজ আর নেই। জমিদার পরিবারের সন্তান সৈয়দুল আলম চৌধুরী প্রকাশ লেদু মিয়া- জমিদারি সৌখিনতা থেকে এই দৃষ্টি নন্দন বাড়িটি করেছিলেন। বেশ কয়েক একর জমিজুড়ে এই বাড়িটির ব্যাপ্তি ছিল। তিনি এখানে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মাছ চাষ থেকে ছাগল পালন ও হাঁস মুরগি এবং কবুতর পালন করতেন শখের বসে। এই বাজারের পশ্চিম পাশে একটি স্লুইচ গেইট আছে তারই পশ্চিম পাশে লেদু মিয়ার বড় ছেলে বদিউল আলম চৌধুরী প্রকাশ বদু মিয়ার ছিল আরেক সুন্দর বাগান বাড়ি বা খামার বাড়ি। উল্লেখ্য যে, লেদু মিয়া আর তাহার দুই ছেলে বদু মিয়া ও কুতুব মিয়া গন্ডামারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। তারা বেশ খ্যাতির সহিত জনসেবা করছিলেন, বিশেষ করে লেদু মিয়াকে এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকেন।
♦ মৌঞ্জির ঘাট/ডোমপাড়া ঘাট (৩)
হাটখালী থেকে আধা কিলো মিটার মত পূর্বদিকে এই জলকদর হয়ে গেলেই নদীর ওপারে ছনুয়ায় যাতায়াতের জন্য ডোমপাড়া ঘাট ব্যবহার হতো। এটাকে মৌঞ্জির ঘাট বলে খ্যাত ছিল। এখনো এই ঘাটে ব্যবহার কম করে হলেও চালু আছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে স্থল পথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় এই সব পুরনো ঘাটের ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রে উঠে গেলেও কোথাও কোথাও এখনো সামান্য করে হলেও চালু আছে। আগে এসব ঘাটের রাজস্ব ডাক হতো। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে এসব ডাক হতো এখনো হয় খুব কম মূল্যে। আবার কোনো যায়গায় ডাক হয়ও না। কারণ ডাক নেওয়ার কাউকে পাওয়া যায় না। আমাদের সাগর বা নদীর পাড়ের মানুষের মাঝে একটা প্রচলন ছিল- কেউ মারা গেলে এসব ঘাটে চালের গুরির রুটি-পিঠা আর হালুয়া পাঠানো হতো। সাথে টাকা পয়সাসহ আরও অনেক কিছু দিতেন। এটা নাকি ঘাইট্যার হক। তাই এসব দেয়া হতো। এ সব কিছু সামনে যত ঘাটের বর্ণনা আসবে সব ঘাটের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা থাকত। বিজ্ঞজনদের মতে এসব ছিল এলাকায় প্রচলিত এক রকম কুসংস্কার। ঘাইট্যার পারাপারের টাকা আদায় না করে থাকলে অবশ্য তা টাকা দিয়েই আদায় করতে হবে। হালুয়া রুটি দিয়ে কি প্রাপ্য টাকা আদায় করা হতে পারে?
♦ হেঁইতখালী খালের মুখ/ফাঁড়ির মুখ (৪)
জলকদর এর সাথে ছেটে ছোট খালের সংযোগ আছে অনেক। তেমনি এই হেঁইতখালী খালটি জলকদর থেকে বর্তমান ফাঁড়িরমুখ এলাকা হয়ে দক্ষিণে ছনুয়া ও শেখেরখীল ইউনিয়নের মাঝ দিয়ে বয়ে গিয়ে পেকুয়া উপজেলার আরবশাহ খালের সাথে যুক্ত হয়েছে। এই খালেরও বহু লম্বা ইতিহাস আছে, সুযোগ হলে সেটা নিয়ে আপনাদের সামনে আবার আসব ইনশাহ আল্লাহ।
♦ এমদাদ মিয়ারঘাট বা সরকার বাজার ঘাট (৫)
হেঁইতখালী খালের মুখ থেকে উত্তর দিকে আর একটু সামনে গেলে জলকদরে পশ্চিম পাড়ে এমদাদমিয়ার ঘাট বা পূর্ব পাড়ে মানুষদের নিকট এই ঘাটের নাম ছিল সরকার বাজারঘাট বা সরকারঘাট। এই ঘাট দিয়ে জলকদরের উভয় পাড়ের মানুষজন তাদের প্রয়োজনে যাতায়াত করতেন। বড়ঘোনার সাথে শেখেরখীলের যোগাযোগ ও বহদ্দার হাটে যাতায়াত করতে এ ঘাট ব্যবহার করতেন সেকালের মানুষেরা। শেখেরখীলের লোকেরা এই নৌ-ঘাট দিয়ে বড়ঘোনা রহমানিয়া মাদ্রাসায় পড়তে যেতেও বিশেষ করে ব্যবহার করতেন।
♦ এমদাদ মিয়া চৌধুরী- স্লুইচ গেইট (৬)
ঘাট থেকে উত্তরে গেলেই দেখা মিলবে বহু পুরানো একটি স্লুইচ গেইট। এটাকে এমদাদ মিয়া চৌধুরী স্লুইচ গেইট নামে স্থানীয়ারা জানে। এই স্লুইচ গেইট দিয়ে পূর্ব বড়ঘোনার পানি নিষ্কাশন করার মাধ্যমে চাষাবাদ ও বন্যার পানি সরাতেও এই স্লুইচ গেইট এলাকাবাসীর কল্যাণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন। শুষ্ক মওসুমে নদীর পানি গমনাগমনের মাধ্যমে স্থানীয় লবণ চাষেও ভূমিকা রাখতেন এই গেইট।
♦ আমিন চৌধুরী ঘোনা স্লুইচ গেইট (৭)
এমদাদ মিয়া স্লুইচ গেইটের বিপরীতে জলকদরের পূর্ব পাড়ে আমিন চৌধুরীর ঘোনা নামে আরও একটি স্লুইচ গেইট আছে। তা দিয়ে পশ্চিম চাম্বলের র্বষার পানি নিষ্কাশন ও শুষ্ক মওসুমের লবণ চাষের জন্য নদীর পানি ব্যবহার করে ঐ এলাকায়ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভুমিকা রাখতেন।
♦ শাহ আমানত দাখিল মাদ্রাসা ও হিফজ খানা (৮)
বাংলা বাজার শাহ আমানত দাখিল মাদ্রাসা একটি দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি গোড়াপত্তনকারী হলেন পশ্চিম চাম্বল জয়নগরের হাফেজ মওলানা হাবিবুর রহমান (রহ.)। যিনি আমৃত্যু চট্টগ্রামের শাহ আমানত (রহ.) দরগাহ সংলগ্ন জামে মসজিদের পেশ ইমাম হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এখানে প্রথমে শাহ আমানত হিফজখানা নামে একটি হিফজখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠান বহু কুরআনে হাফেজ তৈরী করেছেন। তিনি এলাকাবাসীর সহযোগিতায় অবশেষে এখানেই প্রথমে এবতেদায়ী মাদ্রাসা পরে দাখিল মাদ্রাসায় উন্নীত করেন। মাদ্রাসাটি অল্প কিছু দিন আগেই সরকারী এমপিও ভুক্তির সুযোগ লাভ করেন।
♦ জলকদরের পাড়ে বাংলা বাজার ও ঘাট (৯)
আজকে যেখানে বাংলাবাজার বিদ্যমান আছে ঐ জায়গায় বাংলাবাজার ছিল না। এটা ছিল জলকদরের পশ্চিম পাড়ে। আর পূর্ব পাড়ে সবে মাত্র কয়েকটা দোকান ছিল । চাম্বলের মানুষেরা বড়ঘোনা রহমানিয়া সিনিয়ার মদ্রাসায় যাওয়া আসা এবং বড়ঘোনার মানুষেরা আজকের চাম্বল বাজার বা সেই পুরানো নামে বারিহাট যাতায়াত করতেও এই ঘাট ব্যবহার করতেন। আর দু পাড়ের মানুষেরা বাংলাবাজার বা পাকিস্তান আমলে এটার নাম ছিল পাকিস্তান বাজার নাম ছিল। বলে রাখা ভাল যে, এভাবে তৎকালীন প্রতি উপজেলায় একটা করে পাকিস্তান বাজার ছিল যা স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাবাজার নামে নামকরণ করা হয়। বড়ঘোনা এলাকার ছাত্ররা চাম্বল স্কুলে যেতে বাংলাবাজার ঘাট ব্যবহার করতেন। উল্লেখ্য যে, বড় হুজুর মওলানা শফিকুর রহমান (রহ.) এবং আরেক বড় হুজুর এলাহী বক্স (রহ.) এর সাথে এতদাঞ্চলের লোকদের মোলাকাতের জন্যও এই ঘাট ব্যবহার হতো।