চট্টলাকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চট্টলবীরের মহাপ্রস্থান
মুহাম্মদ তাফহীমুল ইসলাম: চট্টলাকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন চট্টলবীর। ১৯৪৪ সালের ১লা ডিসেম্বর রাউজানের গহীরায় জন্মগ্রহণ করেন চট্টলবীর এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী।
ছাত্রাবস্থায় জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। যে রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিলো মানুষের কল্যাণ। রাজনীতির মধ্য দিয়ে সক্ষম হন মানুষের ভালোবাসা, আস্থা অর্জনে। তিন তিন বার নির্বাচিত হন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র। আজীবন দায়িত্ব পালন করেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্ব। একাত্তরে দেশ স্বাধীন করতে অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুুদ্ধে। অন্যায়ের প্রতিবাদ, প্রতিরোধে আজীবন ছিলেন সোচ্চার। এমনকি অসুস্থ হওয়ার দিনও একটি অন্যায় দাবির বিরুদ্ধে আয়োজিত মিটিংয়ে বলেন- ‘অনেকে আমি মরার জন্য দোয়া করে। আমি রাজপথে মরবো’।
দুপুরে এমন বক্তব্য দেওয়ার পরে রাতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন চট্টলবীর। নেয়া হয় পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে। সেখানে অবস্থার অবনতি ঘটলে স্থানান্তর করা হয় ঢাকায়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের পরামর্শে নেয়া হয় সিঙ্গাপুরে। সেখানে চিকিৎসা শেষে শঙ্কামুক্ত হওয়ার পর ঢাকায় আনা হয়। ঢাকায় কিছুদিন অবস্থান শেষে স্বাস্থ্যের উন্নতি হলে চট্টলবীরকে নিয়ে আসা হয় আপন নীড় চট্টগ্রামের চশমাহিলের বাসায়। চট্টগ্রামে আনার একদিনের মাথায় আবারো অসুস্থ হয়ে পড়লে নেয়া হয় ম্যাক্স হাসপাতালে। সেখানে স্বাস্থ্যের অবনতি হলে আইসিইউতে নেয়া হয়। ঐ রাতেই মৃত্যু ঘটে চট্টলবীর তথা চট্টলার ভাগ্যের। চট্টলা জুড়ে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার, শোকের ছায়া। অশ্রু বেয়ে পড়ে পুরো চট্টলার দু’চোখ বেয়ে।
মহিউদ্দীন চৌধুরী বিহীন চট্টলা ভাবতে রাজা বিহীন রাজ্যের মতো লাগে! কারণ, তিনি মেয়র থাকাকালীন এবং এর পরে যা কিছু করেছেন তা অন্য কারো দ্বারা করা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে যে খেলা শুরু হয়েছে তা অত্যন্ত স্বচ্ছতার সাথে মোকাবেলা করছেন চট্টলবীর। এমনকি চট্টগ্রামকে বাঁচাতে, চট্টগ্রামের স্বার্থে তিনি হাতে লাঠি তুলে নিতেও দ্বিধা করেন নি। কেউ চট্টলা বিরোধী কোন সিদ্ধান্ত নিলে সাথে সাথেই গর্জে ওঠতেন তিনি। যদি হয় তাঁর দল আওয়ামীলীগ বা আওয়ামী লীগ নেতাও এ কাজে লিপ্ত হন তাহলে তিনি দল এবং সহকর্মীকেও ছাড় দিতেন না। এই দিকটিই মহিউদ্দীন চৌধুরীকে সর্বজন শ্রদ্ধেয় করে তুলে।
চট্টলবীরের সাথে কোনদিন দেখা হয়নি, কথা হয়নি। তারপরেও পুরো চট্টলা বাসীর সাথে আজ আমিও শোকাহত, অশ্রুসিক্ত। কারণ, তিনি চট্টগ্রামের উন্নয়নের গান গেয়েছেন, চট্টলা বাসীর উন্নয়নের রাজনীতি করেছেন, চট্টলার জন্য কেঁদেছেন। এখন চট্টলবীর হীন চট্টলা যার যার ইচ্ছে মতো লুটে পুটে খাবে। তাতে আর কেউ তাদের বাঁধার কারণ হবে না। বন্দরসহ পুরো চট্টগ্রামকে নিয়ে শুরু হবে নতুন ভোগের রাজনীতি। যে রাজনীতি শুরু হয়েছে চট্টলবীর অসুস্থ হওয়ার সাথে সাথে । কিন্তু তাঁর প্রতিরোধে জাগতে দেখিনি কাউকে, ধ্বনিত হয়নি কোন নেতার কন্ঠ। তাই এমন দুঃসময়ে চট্টলবীরের চলে যাওয়াটা আমাদের মানতে কষ্ট হচ্ছে।
একটি সময়ে মানুষ দলে-দলে, মিছিলে-মিছিলে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে সমবেত হতো মহিউদ্দীন চৌধুরীর বক্তব্য শুনতে। তখন দেখতাম মহিউদ্দীন চৌধুরী কথা বলতেন সবাই তার কথা নীরব হয়ে শ্রবণ করতেন। মাঝে মাঝে স্লোগানের মধ্য দিয়ে শ্রবণকারীরা গর্জে ওঠতেন। কিন্তু গতকাল দেখা গিয়েছে চির নিদ্রায় শায়িত মহিউদ্দীন চৌধুরীকে কাঁধে নিয়ে সবাই কালেমা পড়তে পড়তে লালদীঘি ময়দানে হাজির হয়। কিন্তু চট্টল বীর মহিউদ্দীন চৌধুরী আজ কারো উদ্দেশ্যে কোন কথা বলছেন না। নেতাকর্মীরাও স্লোগান তুলছে না- ‘মহিউদ্দীন ভাইয়ের ভয় নাই-রাজপথ ছাড়ি নাই’ বলে। ছোট্ট একটি কাঠের বিছানায় শায়িত মহিউদ্দীন চৌধুরী কাউকে বলছে না- ‘কেমন আছো?’ ‘কি খবর’। নেতাকর্মীদেরও দেখা যায়নি তাদের প্রিয় মহিউদ্দীন ভাইয়ের সাথে হ্যান্ডশেক,কোলাকুলি করার জন্য ভিড় করতে। গতকাল দেখা গেছে প্রিয় নেতাকে এক নজর দেখার জন্য নেতাকর্মীদের ভিড় করতে। তাদের চোখে দেখা গেছে অশ্রু। দুনিয়ার নিয়ম এমনই। এভাবে আগে, পরে সবার জন্য আসবে বিদায়ী বার্তা। তবে কারো বিদায় হয় ঘৃণায়, কারো বিদায় হয় ভালোবাসায়। বিদায় যাত্রায় এটি অনেক বড় প্রাপ্তি।
সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য জনক ব্যাপার হলো- দীর্ঘদিন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা শেষে আপন নীড়ে এসে সবাইকে বিদায় জানিয়ে চলে যাওয়া। পবিত্র রবিউল মাসের জুমার দিনের মৃত্যুই প্রমাণ করে মহিউদ্দীন চৌধুরী একজন ধার্মিক, আল্লাহ ওয়ালা মানুষ ছিলেন। আজকের দিনে তাঁকে দেওয়ার জন্য দোয়া ছাড়া আর কিছু আমাদের নেই। মহান আল্লাহ তা’য়ালার কাছে প্রিয় চট্টলবীর মহিউদ্দীন চৌধুরীর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। প্রিয় নেতা পরকাল যাপনের জন্য কামনা করছি জান্নাতুল ফিরদাউস।
লেখক: তরুণ লেখক