চট্টলবীর এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত জীবনী
মোহাম্মাদ আলী হোছাইন(আলী)
১৯৪৪ এর পহেলা ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর জন্ম। পিতার নাম মরহুম হোসেন আহমদ চৌধুরী আর মাতা মরহুম বেদৌরা বেগম। আট ভাইবোনের মাঝে মহিউদ্দিন মেঝ। পিতা চাকুরী করতেন আসাম বেংগল রেলওয়েতে। পিতার চাকরির সুবাদে মহিউদ্দিন পড়াশুনা করেছেন মাইজদি জেলা স্কুল, কাজেম আলি ইংলিশ হাই, আর প্রবর্তক সংঘে। স্কুল জীবনেই জড়িয়ে পরেন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। মাধ্যমিকের শেষে বাবার আদেশে ভর্তি হয়েছিলেন ডিপ্লোমা ইন্জিনিয়ারিং এর কোর্সে। সেখানের পাঠ না চুকিয়ে ভর্তি হন চট্টগ্রামের অন্যতম বিদ্যাপিঠ চট্টগ্রাম কলেজে। বছর না ঘুরতেই কমার্স কলেজ, আর শেষমেশ সিটি কলেজ। সিটি কলেজেই তার বিপ্লবী রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন।
রাজনৈতিক জীবনের শুরতেই সান্নিধ্যে আসেন জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর। বঙ্গবন্ধুর ডাকে আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিতে গিয়ে পাক বাহিনির কাছে গ্রেফতার হন অসংখ্যবার। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে আই এস আইয়ের চট্টগ্রাম নেভাল একাডেমী সদরদপ্তরের কাছে গ্রেফতার হয়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন দীর্ঘ চার মাস। পাক বাহিনীর নির্যাতনের চিহ্ন মহিউদ্দীন শরীরে বয়ে বেড়িয়েছেন আজীবন। তার গ্রেফতারের খবরে ততদিনে ভারতের একটি মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে শহীদ মহিউদ্দীন ক্যাম্প খোলা হয়েছিলো। বেচে থাকার কথা ছিলোনা তার। শহীদ ভেবে বাবা ছেলের নামে দিয়ে ছিলো ফাতেহা (কুলহানী)। এরি মাঝে একদিন মানসিক রোগীর নাটক করে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে পালিয়ে বেরোন মহিউদ্দিন; পাড়ি জমান ভারতে। সেখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষন শেষে সক্রিয়ভাবে সম্মুখসমরে অংশ নেন। ছিলেন ভারত-বাংলা যৌথবাহিনীর মাউন্টেন ডিভিশনের অধিনে।
দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ঝাপিয়ে পড়েন নতুন সংগ্রামে। বঙ্গবন্ধুর খুবই কাছের আর আদরের ছাত্রনেতা ছিলেন মহিউদ্দীন। কিন্তু তৎকালিন সময়ে প্রবল ক্ষমতাশালি হয়েও ক্ষমতার মোহ একচুলও স্পর্শ করেনি তাকে। কিছুদিন না যেতেই ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নিহত হন বঙ্গবন্ধুর। অল্পের জন্য মহিউদ্দিন ধরা পড়া থেকে বেচে যান, মৃত্যু বরন করেন সহযোদ্ধা মৌলভি সৈয়দ। পালিয়ে গিয়ে ভারতে প্রতিবিপ্লবীদের সাথে যোগ দেন। লক্ষ্য সামরিক জান্তা, খুনি মোশতাককে সামরিকভাবেই পরাস্ত করা। কিছুদিন পরেই দলের নির্দেশে পন্থা পরিবর্তন করে আবার সক্রিয় হন প্রকাশ্য রাজনীতিতে।
দেশে এসেই একের পর এক হুলিয়া। সামরিক বাহিনীর হাতে নিষ্পেশন, নির্যাতন, আর একের পর এক কারাভোগ। তখন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায়। তরুন ছাত্রনেতা মহিউদ্দিনের ভয়ে সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা অস্থির। মাঝে আওয়ামী লীগের ভেতরেই ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর হয়ে উঠলো। বঙ্গবন্ধু কন্যা আজকের জননেত্রী শেখ হাসিনার ভুমিকাকে নগণ্য করতে তাকে ঠেকাতে শত্রুরা উঠেপড়ে লাগলো। অদম্য সাহসী মহিউদ্দীন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় গিয়ে দলবল নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যার জন্য ঝাপিয়ে পড়লেন। সব বাধা অতিক্রম করে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দলের কান্ডারীর দায়ীত্ব নিতে সহয়তা করলেন।
তারপর আসলো স্বৈরাচারি সামরিক জান্তা এরশাদ। তারই শাসনামলে চট্টগ্রামে স্বয়ং জান্তা প্রধানকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে চক্ষুসুল হন সরকারের। ফলে আবারও রাজনৈতিক বন্দি। ততদিনে চট্টগ্রামের আপামর জনতার নয়নমনি হয়ে উঠেন মহিউদ্দীন চৌধুরী। পরবর্তীতে নব্বইয়ের গনআন্দোলনে অগ্রণী ভুমিকা রেখে গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তির অন্যতম সুপুরষ বলে বিবেচিত হন সর্ব মহলে। রাজাকার আর সাম্প্রদায়ীক শক্তিকে ক্রমাগত পরাজিত করে, একানব্বইয়ের ঘুর্নিঝড়ে দুস্থ জনতার পাশে দাড়িয়ে, অসহযোগ আন্দোলনে খালেদার সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, গরিব-দুঃখী-শ্রমিকের অধিকারের কথা বলে মহিরুহে পরিনত হন আজকের মহিউদ্দীন।
এতকিছুর পরও থেমে থাকেননি এই উদ্যমী জননেতা। গনমানুষের তথা চট্টগ্রামের উন্নয়নের লক্ষ্যে ক্রমাগত ছুটে চলেছেন; উপেক্ষা করেছেন রক্তচক্ষু। চালিয়ে গেছেন উন্নয়নের চাকা। উড়িয়ে চলেছেন অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনীতি আর মুল্যবোধের পতাকা।
সর্বশেষ নির্যাতিত হন রাজনীতি পরিশোধনের নামে নেমে আশা সামরিক শকুনের ওয়ান ইলেভেনের শাসনামলে। ষাটোর্ধ বয়সে এসে কারাভোগ করেন দীর্ঘ দুই বছর। এরমধ্যেই অকাল মৃত্যু বরণ করেন আদরের মেয়ে ফওজিয়া সুলতানা টুম্পা। নানান টালবাহানা করে টুম্পাকে মৃত্যু অবধারিত জেনেও দেখতে দেয়নি অনির্বাচিত সরকার নামক ভদ্রবেশি আরেক নব্য সামরিক জান্তা। শতচেস্টা আর মানসিক নির্যাতন করেও টলাতে পারেনা সরকার মহিউদ্দীনকে একটুও। দুর্নিতিবাজদের সাথে এক করেও পারেনি দোষী সাব্যস্ত করতে। বারবার তারা পরাজিত হয়েছে এই সংগ্রামী মানুষের পাহাড়সম ব্যক্তিত্বের কাছে।
জনগনের ভোটে তিন তিন বারের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন মহিউদ্দীন। জনতার রায়ে, তাদের ভালবাসায় সিক্ত হয়েছেন বার বার। গনমানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে, শত কষ্ট, বেদনা, অসুস্থতা, নির্যাতন সহ্য করে, পরিবার পরিজন কে সময়-অসময়ে, ঘটনা-দুর্ঘটনায় হারানো এই মানুষটি। তার সবচেয়ে প্রিয় কবিতা দিয়েই লেখাটা শেষ করতে চাই
নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ
আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের ‘পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান!
না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।
থর থর করি কাঁপিছে ভূধর,
শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে,
ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
গরজি উঠিছে দারুণ রোষে।
আমি মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
(অনলাইন সংগ্রহ)
আরো পড়ুন :