গরমে আরামে থাকবেন যেভাবে

ডা. মো. আজিজুল হাকিম : গরম যখন চরমে, অস্বস্তিও চরমে। চাতক পাখির ন্যায় কোটি কোটি চোখ আকাশ পানে চেয়ে রয়, রহমতের ফল্গুধারা এই বুঝি শুরু হয়! সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের দ্বারা বিপর্যস্ত প্রকৃতি যেন পাল্টা প্রতিশোধে উন্মত্ত। গ্রীষ্মের দাবদাহ এ অঞ্চলের জন্য নতুন কিছু নয় তবে বাতাসের আর্দ্রতা সাপেক্ষে গরম বোধ কমবেশি হয়। প্রকৃতির এই বৈরীতার সাথে আমাদের মানব শরীরের প্রকৃতিও খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা করে। এই মানিয়ে নেয়ার প্রবণতা বা সক্ষমতা সবার সমান নয়। বয়স, অবস্থান, খাদ্যাভ্যাস, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, পেশাভেদে এর রকমফের হয়। যেমন শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য একটু কঠিন। গরমে প্রধান বা সাধারণ যে স্বাস্থ্য সমস্যা হয় তা হল-
১। পানি ও লবণ স্বল্পতা
২। ডায়রিয়া
৩। এলার্জি ও চর্মজনিত সমস্যা
৪। মাইগ্রেনের হার ও মাত্রা বেড়ে যাওয়া
৫। হিট স্ট্রোক
৬। হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা গ্লুকোজ কমে যাওয়া
ঋতু হিসেবে গ্রীষ্মকাল বেশ সমৃদ্ধ। চোখ মেলে তাকালেই কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, কনকচূড়া, সোনালু, জারুল প্রভৃতি ফুল আপনার মন ও মননকে সতেজ করতে বাধ্য। শরীরকে বালাইমুক্ত ও সতেজ রাখতে একটু সচেতনতাই যথেষ্ঠ। আসুন একনজরে দেখে নেয়া যাক-

পানি ও লবণ স্বল্পতাঃ প্রচুর ঘামের কারণে পানির সাথে সাথে শরীর থেকে প্রয়োজনীয় লবণও বেরিয়ে যায়। সাধারণত এর ফলে শরীরের রক্তচাপ কমে যায়, দুর্বল লাগে, মাথা ঝিমঝিম করে। পানি স্বল্পতা গরমের খুবই সাধারণ সমস্যা হলেও অবহেলা করলে তা মারাত্মক হয়ে যেতে যারে। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তি, এবং যারা বাইরে কাজ করেন এবং প্রয়োজনমতো পানি পান করার সুযোগ পান না, তারাই মারাত্মক পানি স্বল্পতায় আক্রান্ত হন বেশি। এক্ষেত্রে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং কিডনির সমস্যা হওয়াও বিচিত্র নয়। এছাড়া নিয়মিত, পরিমিত খাবার গ্রহণ না করলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রাও কমে যেতে পারে, যার কারণে মাথা ঘুরতে পারে, বমিভাব লাগতে পারে এমনকি অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।
প্রতিকারঃ বেশি বেশি ওরস্যালাইন, পানি, শরবত, ডাবের পানি, জুস, লাচ্ছি ইত্যাদি তরল খাবার খেতে হবে। তবে গলা ঠাণ্ডা করার নামে বিভিন্ন সফট ড্রিঙ্কস মোটেই স্বাস্থ্য সম্মত নয়। চা ও কফি যথাসম্ভব কম পান করা উচিত শ্রমসাধ্য কাজ যথাসম্ভব কম করতে হবে। এক্ষেত্রে কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রাম নিতে হবে ও প্রচুর পানি ও স্যালাইন পান করতে হবে। গুরুপাক খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। সাধারণ খাবার; যেমন ভাত, সবজি, মাছ ইত্যাদি খাওয়াই ভালো। খাবার যেন টাটকা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নানা রকম ফল; যেমন আম, তরমুজ ইত্যাদি এবং লেবুর শরবত শরীরের প্রয়োজনীয় পানি ও লবণের ঘাটতি মেটাবে।
ডায়রিয়াঃ অনেকেই গরমে তৃষ্ণা মেটাতে বাইরে বা রাস্তাঘাটে বিক্রেতাদের কাছ থেকে অপরিষ্কার পানি বা শরবত খান, যা অনেক সময় বিশুদ্ধ নয়। ফলে ডায়রিয়া ও বমিতে আক্রান্ত হতে পারেন। একই কারণে এ সময়টাতে পানিবাহিত অন্যান্য রোগ; যেমন টাইফয়েড, হেপটাইটিস ইত্যাদি বেশি হয়। গরমে অনেকে প্রচুর পানি পান করেন, কিন্তু তাতে পর্যাপ্ত লবণ থাকে না। ফলে শরীরে লবণের অভাব দেখা দেয়। অতিরিক্ত গরমে অনেক সময় খাবার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ঐ খাবার খেলে বদহজমসহ অনেকের পেটের পীড়া দেখা দিতে পারে যাকে আমরা ফুড পয়জনিং বলি।
প্রতিকারঃ পেটের এসব পীড়া থেকে বাঁচতে হলে আমাদের অবশ্যই বাইরের খোলা খাবার খাওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে। আর খেতেই যদি হয় তবে মানসম্পন্ন রেস্টুরেন্টে খাওয়া ভালো। বাসি খাবার খাওয়া যাবে না। খাওয়ার আগে অবশ্যই ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। এ ছাড়া পর্যাপ্ত পানি, শরবত, ফলের রস কিংবা ঠান্ডা পানীয় পান করতে হবে। পাতলা পায়খানা শুরু হলে খাবার স্যালাইন খেতে হবে, অবস্থা বেশি খারাপ হলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
এলার্জি ও ত্বকের সমস্যাঃ গরমে অনেকেরই ত্বকে বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দেয়। ঘাম থেকে ঘামাচি হওয়া, তারপর সেই ঘামাচি চুলকাতে গিয়ে নখের আঁচড়ে ঘা তৈরি করা সাধারণ সমস্যা। আবার পানি সংকটের কারণে অনেকে গোসলের সময় সাবান কম ব্যবহার করেন, ফলে গোসলের পরও শরীর অপরিচ্ছন্ন থাকে। সেই সঙ্গে রোদে পুড়ে ত্বক কালো হওয়া বা অনেকের ত্বকে ছোপ ছোপ দাগও পড়ে। এছাড়া ঘাম গায়ে শুকানোর কারণে, ফ্রিজের অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি পানের কারণে কোল্ড এলার্জি হিসেবে সর্দি-কাশি, জ্বরও হতে পারে।
প্রতিকারঃ ত্বকের সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে সব সময় চেষ্টা করতে হবে রোদে কম অবস্থানের। বিশেষ করে ভরদুপুরে তো নয়ই। প্রতিদিন বাইরে থেকে এসেই সাবান দিয়ে ভালোভাবে গোসল করতে হবে। শরীরকে সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাইরে বের হলে ছাতা ব্যবহার করতে হবে (কালো বাদ দিয়ে) ঘামের কাপড় বেশিক্ষণ শরীরে রাখা যাবে না। সব সময় হালকা রঙের কাপড় পরতে হবে। ভালো প্রতিষ্ঠানের সানস্ক্রিন লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে। চোখের প্রদাহজনিত সমস্যা থাকলে সানগ্লাস ব্যবহার করা ভালো। আর ঘামাচি হলে ঘামাচি পাউডার লাগাতে হবে। অনেকেরই এ সময় সর্দি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানির সমস্যা দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
মাইগ্রেনঃ মাইগ্রেন এক ধরনের মাথা ব্যথ্যা। এই গরমে রোদে বের হলে, ক্রাউডি এরিয়া বা প্রোগ্রামে থাকলে, রাস্তায় ধূলা-বালি, যানজট ও শব্দ দূষণের কারণে, শ্রেণীকক্ষে বিদ্যুৎ না থাকা অবস্থায় মাইগ্রেনের এটাক হতে পারে। যার পূর্ব থেকেই মাইগ্রেনের অভিজ্ঞতা আছে তার এই অনুষঙ্গগুলো এড়িয়ে চলা উচিত। চিকিৎসকের পরামর্শে ঔষধ সেবন করতে হবে।
হিট স্ট্রোকঃ গরমের সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা হলো- হিট স্ট্রোক। শুরুতে হিট স্ট্রোকের পূর্বে হিট ক্র্যাম্পে দেখা দেয় যাতে শরীর ব্যথা করে, দুর্বল লাগে এবং প্রচ- পিপাসা লাগে। পরবর্তীতে হিট এক্সহসশনে দেখা দেয়, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়, মাথা ব্যথা করে এবং রোগী অসংলগ্ন আচরণ করতে থাকে। এ অবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া না হলে শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় এবং শরীরের তাপমাত্রা ১০৫০ ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়। একে হিট স্ট্রোক বলে। এর লক্ষণসমূহ হলো- তাপমাত্রা দ্রুত ১০৫০ ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়, ঘাম বন্ধ হয়ে যায়, ত্বক শুষ্ক ও লাল হয়ে যায়, নিঃশ্বাস দ্রুত হয়, নাড়ীর স্পন্দন ক্ষীণ ও দ্রুত হয়, রক্তচাপ কমে যায়, খিঁচুনী হয়, মাথা ঝিম ঝিম করে এবং রোগী অসংলগ্ন ব্যবহার করতে থাকে। রোগীর প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়, অজ্ঞান হয়ে যায়, এমনকি শকেও চলে যেতে পারে।
প্রতিকারঃ রোগীকে দ্রুত শীতল কোনো স্থানে নিয়ে যেতে হবে। ফ্যান বা এসি ছেড়ে দিতে হবে, সম্ভব না হলে পাখা দিয়ে বাতাস করতে হবে। রোগীর গরম কাপড় খুলে ফেলতে হবে এবং ভেজা কাপড়ে শরীর মুছে ফেলতে হবে। সম্ভব হলে গোসল করতে হবে। রোগীকে প্রচুর পানি ও খাবার স্যালাইন পান করতে দিতে হবে। যদি কেউ হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয় এবং অজ্ঞান হয়ে যায়, তবে দ্রুত শরীরের তাপমাত্রা কমাতে হবে। এক্ষেত্রে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে, ঘরে চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ নেই।
আমরা আশা করব উল্লিখিত বিষয়ে সচেতন থেকে আপনি সুস্থ থাকবেন। আপনার পরিবার ও প্রিয়জনকে সুস্থ রাখবেন। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের যত্ন নিন।

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *