কোন পথে বাংলাদেশের অর্থনীতি?
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের যুগ পার করছে বাংলাদেশ। এই ডেমোগ্রফিক ডিভিডেন্ডের সময়কালকে অনেকে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির গোল্ডেন টাইম হিসেবে চিহ্নিত করে। আজকের চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া- এসব দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগিয়ে উন্নতির চরম শিখরে পৌছেছে। বাংলাদেশও এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে উন্নতির চরম শিখরে পৌছবে-এটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু সব হিসেব-নিকেশে গোলমাল পাঁকিয়ে দিল মহামারী করোনা। করোনাসৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার পথে হাজির হল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বিশ্ব মন্দা পরিস্থিতি। এই ধাক্কাতে এসে গত দুই দশক ধরে চলে আসা অর্থনীতির তেজি ভাব উলট-পালট হয়ে গেল। গত কয়েক মাসের রিজার্ভ পরিস্থতি, বাণিজ্য ঘাটতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও মূল্যস্ফীতি যেন আমাদের গভীর অর্থনৈতিক সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান গতিপ্রকৃতি ও আগামীর সম্ভাব্য পরিস্থতি অনুধাবন করতে হলে সামষ্টিক অর্থনীতির কিছু বিষয় নিয়ে আমাদের জানা দরকার। যেমন-
বিপদজনক ধাপে মূল্যস্ফীতি
বাংলাদেশে গত দুই-তিন দশকের মূল্যস্ফীতি অনেকটাই স্থিতিশীল ও সহনীয় পর্যায়ে ছিল। অর্থনীতিবিদদের মতে, মূল্যস্ফীতি ২ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে থাকলে ভালো, ৭ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে থাকা মানে বিপদ। সে হিসেবে মূল্যস্ফীতির বিপদজনক ধাপে এখন প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে গত জুন মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৭.৫৬ শতাংশ। যা গত ৯ বছরে সর্বোচ্চ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৮.৩৭ শতাংশে পৌছেছে। গত জানুয়ারি থেকে মূল্যস্ফীতি বিপদজনক ধাপে প্রবেশ করলেও গত তিন মাসে বৃদ্ধির গতি অনেক বেশি। ক্রমশ বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি এভাবে চলতে থাকলে ভঙ্গুর হয়ে পড়বে দেশের অর্থনীতি।
রেকর্ড পরিমাণ আমদানি ব্যয়
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি ব্যয়ে রেকর্ড করেছে বাংলাদেশে। আমদানি স্টেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে দেশের আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ ৮৭ বিলিয়ন ডলার। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি। ইতিহাস সৃষ্টি করা এই রেকর্ড পরিমাণ আমদানি ব্যয় কোনভাবে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স দিয়ে মেটানো সম্ভব না। আমদানি ব্যয়ের বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে চলমান অর্থবছর শেষে আমদানি ব্যয় ৯০-১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌছবে। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে আমদানি ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা বেশি দিন আর হাতে থাকবে না।
রপ্তানি আয় বৃদ্ধি
বাংলাদেশের অর্থনীতির বহিঃখাতে এই একটি খাত এখন ইতিবাচক অবস্থানে আছে। সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের মাইলফলক অর্জন করেছে বাংলাদেশ। দেশের পণ্য রপ্তানির ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ আয়। তবে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা এটাকে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির প্রতিফলন বলে মনে করছেন।
টাকার অবমূল্যায়ন ও ডলারের সংকট
আমদানি ব্যয় বিপুল বেড়ে যাওয়ায় দেশে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশী মুদ্রা টাকার মান কমে যাচ্ছে। ডলারের দর হয়ে উঠেছে পাগলা ঘোড়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১০.৭৯ শতাংশ। যদিও ডলারের বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৮ শতাংশের বেশি। কারণ বর্তমানে প্রতি ডলার ১০০ টাকার বেশি দরে কিনেছে দেশের মানি এক্সচেঞ্জগুলো। আর খুচরা বাজারে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১০৩ টাকায়। এছাড়া বেশি দাম দিয়েও খুচরা বাজারে আগের মতো বড় অংকের ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।
৩৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি!
রপ্তানিতে এক অর্থবছরে ৫২ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড করলেও আমদানিতেও ৮৭ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ। ফলে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৫ বিলিয়ন ডলার, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। আগের অর্থবছরগুলোতে বাণিজ্য ঘাটতি রেমিট্যান্স আয় দিয়ে পূরণ করা গেলেও এবারের ৩৫ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি আর পূরণ করা সম্ভব না। এই বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি বাংলাদেশের অর্থনীতির সব সূচকে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
কমছে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি
প্রবাসী আয় প্রাপ্তি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সর্বদা একটি সুবিধা দিয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয়ের রেকর্ড হলেও সদ্যসমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে কোনো প্রবৃদ্ধি নেই, বরং কমেছে। কারণ ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় হয়েছে ২১.৩ বিলিয়ন ডলার। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩.৭ বিলিয়ন ডলার কম। ফলে আগে যেভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বড় হচ্ছিল, এবার তা হচ্ছে না উল্টো কমবে।
রিজার্ভ কমছে
২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়নে উন্নীত হওয়া রিজার্ভের পরিমাণ বর্তমানে ৩৯.৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এ পরিমাণ রিজার্ভ দিয়ে দেশের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে মাত্র সাড়ে চার মাস। যা সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ! বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পরিমাণ ৩৯.৭ বিলিয়ন দাবি করলেও আইএমএফ-এর হিসাবে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ মাত্র ৩১ বিলিয়ন ডলার! ফলে রিজার্ভ সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আইএমএফ-এর মতে স্বাভাবিক সময়ে ৫.৫ মাসের এবং অস্বাভাবিক সময়ে ১১ মাসের আমদানি ব্যয় রিজার্ভ থাকা উচিত। সেই হিসেবে দেশের রিজার্ভ পরিস্থতি আমাদের আগামীর সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারে অভয়
সামষ্টিক অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকের অবস্থা ভালো ইঙ্গিত না দিলেও জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ইতিবাচক থাকবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেকর্ড ৮.১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল, পরের অর্থবছরে করোনা মহামারীর কারণে তা ৩.৪৫ শতাংশে নেমে আসে। তবে মহামারীর ধাক্কা সামলে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৬.৯৪ শতাংশে। এছাড়া সদ্য সমাপ্ত অর্থবছর ২০২১-২২-এ এই প্রবৃদ্ধির হার ৭.২৫ শতাংশ হবে বলে ধারণা দিয়েছে বিবিএস। জিডিপির প্রবৃদ্ধির এই হার নানান শঙ্কার মধ্যে একটি ইতিবাচক দিক।
চলতি হিসাবের ভারসাম্যহীনতা
বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক এখন চলতি আয়ের ভারসাম্যহীনতা। দেশে সব সময় বাণিজ্য ঘাটতি থাকলেও প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি চলতি হিসাবকে সর্বদা ভারসাম্যপূর্ণ রেখেছে। তবে এখন পরিস্থতি ভিন্ন। আমদানি-রপ্তানির ৩৫ বিলিয়ন ডলারের ব্যবধান রেমিট্যান্স আয়ের ২১ বিলিয়ন ডলার দিয়ে পূরণ হবে না। ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসে চলতি হিসাবে বড় ঘাটতি তৈরি হবে এবং সামনে এই ভারসাম্যহীনতা ও ঘাটতি বাড়বে।
বিদেশী ঋণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি
বিদেশী উৎস থেকে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশী উৎস থেকে দেশের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫.৮১ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫ বছরে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৯৩.২৩ বিলিয়ন ডলারে পৌছেছে। যা টাকার হিসেবে প্রায় ৮ লাখ ৭৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় ২১ শতাংশ। স্বল্প সময়ের মধ্যে বিদেশী ঋণের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ভবিষ্যতে বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
দারিদ্রের হার বৃদ্ধির আশঙ্কা!
২০১৯ সালে বিবিএস বাংলাদেশে দারিদ্রের হার ২০.৫ শতাংশ এবং চরমা দারিদ্রের হার ১০.৫ শতাংশ জানালেও এরপরে আর নতুন কোন তথ্য জানায়নি। তবে সম্প্রতি আইএফপিআরআইয়ের ‘বাংলাদেশ: ইম্প্যাক্ট অব দি ইউক্রেন অ্যান্ড গ্লোবাল ক্রাইসিস অন পভার্টি অ্যান্ড ফুড সিকিউরিটি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে খাদ্যপণ্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণে নতুন করে অন্তত ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে পতিত হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে। সে হিসেবে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ৩.৩ শতাংশ বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বর্তমানে দেশের রপ্তানি সূচক ছাড়া অর্থনীতির আর কোনো সূচক ইতিবাচক অবস্থানে নেই। মূল্যস্ফীতি এখন ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড করেছে; প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধির পরিবর্তে কমেছে; রপ্তানি বাড়লেও বাণিজ্যঘাটতির রেকর্ড হয়েছে; রিজার্ভ পরিস্থিতি ও চলতি হিসাব দিনদিন ভারসাম্য অবস্থা হারাচ্ছে; অব্যাহত ডলার সংকটে দিন দিন টাকার মান কমছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ভালো নেই। বলা যায়, অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সূচকই আগামীর সংকট, অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির ইঙ্গিত দিচ্ছে। আর্ন্তজাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, চলতি ২০২২ সাল সামনে আরও কঠিন হবে, সামনের ২০২৩ সাল হবে আরও কঠিন হবে। এর মধ্যে আগামী বছর যোগ হতে পারে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। ফলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও সংকট মোকাবেলায় সরকারকে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। এই সংকট মোকাবেলায় শুধু অথনৈতিক পদক্ষেপ নিলে হবে না, দরকার রাজনৈতিক সংহতি ও ঐক্য বির্নিমাণের পদক্ষেপ। আমরা আশা করছি, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সরকার ও সরকারি দল সুষ্টু রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করবে; অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবে; জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করবে
লেখক: এম ফয়সাল আকবর, শিক্ষক ও কলামিস্ট