ডা. আজিজুল হাকিম বাপ্পা: কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য’ প্রতিপাদ্য বি নিয়ে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ‘১৭ পালিত হচ্ছে। ১৯৯২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালিত হওয়া দিবসটির এবারের ফোকাস বেশ চমকপ্রদ। ফেডারেশন অফ মেন্টাল হেলথ জানাচ্ছে বিশ্বে অন্তত ৭০ মিলিয়ন কর্মজীবী মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। এর আগে এ বছরের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়ও ছিল “ডিপ্রেশন: লেট’স টক”। কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলাপের আগে যে প্রশ্নটি অনিবার্যভাবে উঠে আসে তা হল- কর্মক্ষেত্রে আসলেই কী আপনাকে মানুষ জ্ঞান করা হয়? কর্মক্ষেত্রে অধিকাংশকেই মেশিন অথবা সুপারম্যান ভেবে নেয়া হয়। তাই তাদের মানসিক স্বাস্থ্য অনেকটা ব্যাঙের আবার সর্দি। বিশেষ করে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় মানুষকে টাকা উৎপাদনের যন্ত্র মনে করা হয়। তাই কর্মক্ষেত্রে কেউ ডিজেবল হলেও মানবিক
কারণে চাকরিতে বহাল থাকেনা। প্রসূতি নারীকর্মী দুইমাসের বেশি বেতনসহ ছুটি পায়না।
কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের আলোচনায় আমরা বারবার শ্রমিক-মালিক পক্ষকে উস্কে দেই। অবশ্যই তা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করে কিন্তু কলিগদের সাথে আচরণ, লোয়ার স্টাফদের সাথে মিথস্ক্রিয়াও খতিয়ে দেখতে হবে। পরিবেশ মানসের উপর প্রভাব ফেলে। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কতটুকু শ্রমবান্ধব তাও আমলে নিতে হবে। কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন হয়রানি হয়। যৌন হয়রানি যতটা স্পটলাইটে আসে তার চেয়ে ধর্মীয় হয়রানি, শ্রেণী হয়রানি, সংখ্যালঘু ও আঞ্চলিকতার হয়রানি নেহায়েত কম নয়। এসব চলকের নৃতাত্ত্বিক অবস্থানগত ব্যাখ্যা মানসিক সমস্যা ও স্বাস্থ্য নিরূপণে সামনে আনতে হবে।
কর্মক্ষেত্রে একজন এমপ্লয়ি বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারেন। কিছু নমুনা দেয়া যেতে পারে।
১. জেনারেলাইজড এনজাইটি ডিজঅর্ডার- ফিটনেস, যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার অভাবে এমনটি হতে পারে। কিছু নির্দিষ্ট কাজের ব্যাপারে ব্যক্তির অনাগ্রহ, ভয় ও এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা কাজ করতে পারে। যেমন পারদর্শী নয় এমন কারও কম্পিউটার সংক্রান্ত কাজে এমনটি হতে পারে।
২. প্যানিক ডিজঅর্ডার: পারসোনালিটির উপর নির্ভর করে
অনেকের সেমিনার, প্রেজেন্টেশন, পাবলিক স্পিচ, বিদেশি প্রতিনিধি দলের সাথে ইংরেজিতে কথোপকথন ইত্যাদি বিষয়ে প্যানিক অবস্থা কাজ করতে পারে।
৩. স্ট্রেস ডিজঅর্ডার: বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গিয়ে দু ধরণের স্ট্রেস কাজ করতে পারে। একটা হল ইথিকাল স্ট্রেস- ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়া। কর্তৃপক্ষীয় চাপ ও নিজের আভ্যন্তরীণ বিবেকের তাড়না। অন্যটি লজিকাল স্ট্রেস অর্থাৎ ওয়ার্ক লোড যার কারণ সময়, জনশক্তি বা উপকরণ স্বল্পতা। লজিকাল স্ট্রেস বা বার্ডেন থেকে জন্ম নেয় মেজাজের ভারসাম্যহীনতা।
৪. মেজাজের ভারসাম্যহীনতা: খিটখিটে মেজাজ, অল্পতে চটে যাওয়া, দূর্ব্যবহার ইত্যাদির জন্য কর্মক্ষেত্রে বহুমুখী চাপই অন্যতম। পারসোনালিটির ব্যাপার তো থাকেই।
৫. হতাশা বা ডিপ্রেশন : চাওয়া পাওয়ার মাঝে আসমান-যমিন ফারাক থেকে হতাশা আসে। আমরা অনেক সময় স্কুল-কলেজে ছাত্রদের স্বপ্ন দেখিয়ে সেলফ এস্টিমকে তুঙ্গে তুলে দেই। কিন্তু কর্মক্ষেত্রের চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা মিলিয়ে নিতে হবে। জব স্যাটিশফেকশন একটা ভেগ টার্ম। মানুষের চাহিদা অফুরান। চাহিদার সীমা নির্ধারণে ব্যর্থ হলে ডিপ্রেশন অনিবার্য।
কর্মক্ষেত্রে যা চলে জহির রায়হান তুলে ধরেছেন চৌকষভাবে। কাজ, তোয়াজ আর ফাঁকি আর কী আছে বাকি? ফাঁকি দেয়ার অভ্যাস বাঙালির মজ্জাগত। নিজের পেশাকে ভালোবাসতে না পারলে আপনি পিছিয়ে পড়বেন। আপনার যোগ্যতা, নিষ্ঠা ও দক্ষতা আপনাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। আপনার অদক্ষতা আপনাকে ফাঁকিবাজ করবে। আর যদি পাওয়ার এক্সারসাইজের স্থানে থাকেন তবে আপনার অযোগ্যতা আপনাকে রূঢ় ও দূর্নীতিবাজ তৈরি করবে। কাজকে ভালোবাসুন। কলিগদের সাথে হাসিখুশি থাকুন। শেয়ার করুন সমস্যা ও অভিজ্ঞতা। কাজ ভাগাভাগি করুন। অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন। আপনি যদি মালিকপক্ষ হোন সহকর্মীদের সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি করুন। সুবিধাদি নিশ্চিত করুন। কর্মক্ষেত্রে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে স্টাফদের সাথে আলাপ করুন, পরামর্শ নিন। সম্ভব হলে সিদ্ধান্তে অংশীদার করুন। অন্যের অবস্থানকে সমীহ করুন।
কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ নেয়ামক। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক হুমকি বা লোভ এটাকে ব্যাহত করে। মালিকপক্ষকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রম আইন অনুযায়ী সুষ্ঠু ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।