ভাইরাস হতে সুরক্ষা দিতে সক্ষম বিশেষ পোশাক, মাস্ক, গ্লাভস, জুতো ও হেলমেট মিলে ডাক্তারদের পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই)। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় এটা থাকার কথা। বাংলাদেশের যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও চর্চা সে অনুযায়ী এসব আমাদের ঠিকমত নেই। এখন করোনা ভাইরাসের কারণে বিষয়টা সামনে এসেছে। আমরাও অনেকে বিষয়টা প্রথমবার শুনেছি।
ডাক্তাররা এটা দাবি করলেন। খুবই ন্যায্য। কারণ, সেবাটা তাঁদেরই দিতে হবে সামনে থেকে। প্রথমে সরকার বললো, দেওয়া হবে। কয়দিন পর এমন জিনিস দিল তা দেখে হাসি কান্না একযোগে সম্প্রচারিত হলো। রান্নার শেফের যেরকম পোশাক সেরকম একচিলতে হলুদ কাপড়, মাথায় দেওয়ার হলুদ একটা ক্যাপ, খাঁটি সুতি কাপড় দিয়ে বানানো একটা মাস্ক!!! এসব পিপিই??? করোনার মতো মহামারী ও সংক্রামক ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সামলানোর জন্য??? ডাক্তাররা উষ্মা প্রকাশ করলেন। তখন সরকারের পক্ষ হতে বলা হলো, এর বেশী আর নেই। ডাক্তাররা যেন নিজ দায়িত্বে পিপিই’র ব্যবস্থা করে। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রী এও বললেন, এই মুহূর্তে পিপিই’র অতো দরকার নেই!!! কিন্তু প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা যাদের এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা ডাক্তারের চেয়ে কম তারা পিপিই পড়ে ফেসবুকে ছবি দিচ্ছে!!! অথচ অলরেডি দেশে কমিউনিটিতে এইরোগ ছড়িয়ে পড়েছে, সরকারি হিসেবে সাতাশজন আক্রান্ত, চারজন মারা গেছে (যদিও আসল হিসেব অন্যরকম বলেই বেশীরভাগ মানুষের ধারণা)। এই অবস্থায় বুয়েটের সাবেক কিছু শিক্ষার্থীরা পিপিই দেশে বানানোর উদ্যোগ নিলেন। সহযোগিতা করলো একটা বড় গার্মেন্টস কোম্পানি মার্ক এন্ড স্পেন্সার। তারা ডিজাইন বানিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালেয়ের অনুমতি নিয়েছেন এবং উৎপাদন শুরু করেছেন। চট্টগ্রামের স্মার্ট জিন্স নামের এক গার্মেন্টসও একলাখ পিপিই সরবরাহ করার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন নামের শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠন হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিছু ডাক্তারদের কাছেও দিয়েছেন। আরো কেউ কেউ দেশে বিদেশে থেকেও এভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করছেন।
এসবই হলো চ্যারিটি। বেসরকারী ও ব্যাক্তি উদ্যোগ। দায়িত্বটা কিন্তু রাষ্ট্রের, সরকারের। সেই সরকার তার দায় সেরে ফেললো কয়েকটা ক্যাপ আর সুতি কাপড়ের মাস্ক দিয়ে, আর দেওয়া সম্ভব নয় বলে নোটিশ দিয়ে, নিজেদের মতো ব্যবস্থা করো বলে!!!
আমাদের দেশে যখনই কোন বড় বিপদ এসেছে সাধারণ মানুষ বা বেসরকারী উদ্যোগগুলোই তা সামলে নিয়েছে। সরকার যা করে তা প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য। এবারও তাই হচ্ছে। এটার একটা খারাপ দিক আছে। তা হলো চ্যারিটি পেতে পেতে ও দেখতে দেখতে সরকার ও জনগণ উভয়েরই চরিত্র খারাপ হয়ে গেছে। সরকার ধরে নেয় মানুষ ও বেসরকারী উদ্যোগ এসব সামলাবে। আমরা হুম-হাম করলেই চলবে । আর মানুষ ধরেই নিয়েছে এসব সরকারের নয়, এরকম ব্যক্তি ও বেসরকারী উদ্যোগেই হবে। এর ফলে রাষ্ট্র ও সরকারকে যে প্রশ্ন করা যায়, এরা যে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ, তা আমরা সাধারণ মানুষরাই ভুলে গিয়েছি। তাই দেখা যাচ্ছে অনেকেই ডাক্তারদের নিজেদেরকে পিপিই’র ব্যবস্থা করার কথা বলছেন। অনেকে বলছেন ডাক্তারদের আয় অনেক। তারা চাইলে এটার ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে এমন নয়। এই পিপিই ভ্যানে করে বিক্রি হচ্ছে এমন নয়। খেয়াল করে দেখেন, মার্ক এন্ড স্পেন্সার যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ হতে অনুমতি নিয়েছে ডিজাইন জমা দিয়ে। আমার জানা মতে বিদেশে অবস্থানরত কয়েকজন চেষ্টা করছেন লন্ডন হতে পাঠানোর জন্য। কিন্তু সরকারের নিয়মের জটিলতায় তা আদৌ হবে কি না জানি না।
একটা ভালো দিক হলো, এবার ডাক্তাররা বুঝবে যে এই সরকার তাদের নিরাপত্তা নিয়ে মোটেও চিন্তা করে না। কি জানি! এটাও না হতে পারে।
গত কয়দিন আগে দুজন সরকারি কলেজের শিক্ষক (ময়মনসিংহের গফরগাঁও সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাকিয়া ফেরদৌসী এবং বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজের দর্শন বিভাগের প্রভাষক সাহাদাত উল্লাহ কায়সার) এই বিষয়ে ফেসবুকে লিখেছেন। তাঁরা এটার সমালোচনা করেছেন। এই কারণে তাঁদেরকে সাময়িক বরখাস্ত করে বুধবার আদেশ জারি করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ।
পাশাপাশি সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী কেন তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে জানাতে নোটিসও পাঠানো হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন স্বাক্ষরিত এক আদেশে বুধবার তাদের সাময়িক বরখাস্ত করে শোকজ করা হয়।
কাজী জাকিয়া ফেইসবুকে লিখেছিলেন, “খা সব খেয়ে ফল (ফেল)। শিক্ষা খেয়েছিস, ছাব্বিশটা ক্যাডার খেয়েছিস, সরকারকে খেয়েছিস, সরকারের সুনাম, অর্জন, স্বপ্ন সব খেয়েছিস। এবার পিপিই খা। সব তোরাই খা। আমাদের লাগবে না। মুখে মাস্ক দিয়ে বসে থাক সব নির্লজ্জ, রাক্ষসের দল। বিপদে পড়লে কোন অরক্ষিত ডাক্তারের কাছে যাবি না, যদি সামান্য লজ্জা থাকে। আর দেশের সবাই মরে গেলে নিজেরা ঝাড়ুদার ক্যাডারে এবজর্বড হয়ে যাস, আর সেল্ফি দিস।”
সাহাদাত উল্লাহ লিখেছিলেন, “করোনার ভয়ে চাকুরি ছাড়ার সংবাদটা বুলগেরিয়ার। বাংলাদেশের ডাক্তার ভাইয়েরা আপনার নিজের জীবন আগে, তারপর আপনার পরিবার, ছেলে মেয়ে, স্ত্রী তারপর অন্যসব। যে দেশ আপনার পেশার মূল্যায়ন করে না সে দেশের জন্য কাজ করে কী হবে। সেখানে তিন দিনের ইউএনও ৫৫ বছরের একজন প্রফেসর ডাক্তারের নিয়ন্ত্রক থাকে, যে কিনা ডাক্তারির ‘ড’ ও জানে না।”
শিক্ষা ক্যাডারের এসব কর্মকর্তাদের আচরণকে ‘সরকারি ব্যবস্থাপনা ও জনস্বার্থবিরোধী এবং শৃঙ্খলা পরিপন্থি’ আচরণ উল্লেখ করে একে অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
প্রথমে খেয়াল করেন আপনি/আপনারা/আমি/আমরা কি পরিমাণ নজরদারি ও খবরদারির মধ্যে আছি। ফেসবুক স্ট্যাটাসও সরকারের এতো উপরমহলে এতো দ্রুত চলে যায়। আর তার অ্যাকশন আরো দ্রূত হয়। অথচ তিন মাস সময় পেয়েও এই সরকার ও তার আমলারা করোনা মোকাবেলার নূণ্যতম ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই, কিল দেওয়ার গোঁসাই!
দ্বিতীয়ত, বিষয়টা প্রশাসন ক্যাডার ও অন্যান্য ক্যাডারের মধ্যে চিরাচরিত দ্বন্দ্ব। আর এর সাথে যোগ হয়েছে উপনিবেশ আমলের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া আমলাতন্ত্র ও তার প্রকৃতি। নইলে ”ডেপুটি কমিশনার”র বাংলা আমরা ”জেলা প্রশাসক” করি? খাস-কামরাসহ নানা লাটসাহেবি ব্যবস্থা বজায় রাখি? এসবের ফলে বিশেষতঃ প্রশাসন ক্যাডারের লোকজন সাধারণ মানুষকে মনে করে তাদের চাকর। আর অন্যান্য ক্যাডারের লোকজনকে মনে করে মাইনর। সরকারও তার ক্ষমতার স্বার্থে এদের লাই দেয়। তাই আজকের এই অবস্থা। শুনেছিলাম এরশাদের সময়ে ফেনীতে এক ইউএনও সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সেখানকার এমপিকে ধাক্কা দিয়েছিলেন। তারপর হালকা হেসে সরি বলেছিলেন। এমপি’র কিছুই করার ছিলনা। কারণ, ভোট ও নির্বাচিত হওয়ার সিস্টেম আমলাদের হাতেই ছিল। এখনও তাই। তো, এক্ষেত্রে এঁরাতো “কলেজের মাস্টার মশাই”।
এই দুজন শিক্ষক যে সমালোচনাটুকু করেছেন তা কি মিথ্যা? তা কি অন্যায্য? একদম না। সমস্যাটা সেই গোড়ায়। সেই মূলে। ব্যবস্থায়। রাষ্ট্র পরিচালনায়। সেটা পাল্টান। এসব আমলারাও পাল্টে যাবে। প্রশ্ন তোলেন, প্রশ্ন করেন। আপনার অধিকার নিয়ে। প্রতিটি মৌলিক অধিকার নিয়ে। হিসাব নিন আপনার দেওয়া ভ্যাট ও ট্যাক্সের প্রতিটি পয়সার। সংবিধান অনুযায়ী দেওয়া প্রতিটি দায়িত্বের। আপনার ব্যক্তিগত সার্বভৌমত্বের অধিকার রাষ্ট্রের কাছে দিয়েছেন মানে আপনি দাস হয়ে যানননি। আপনি মালিক হয়েছেন। প্রজাতন্ত্রের সব আমলা ও এমপি মন্ত্রীরা আপনি সাধারণ জনগণের সুযোগ-সুবিধা দেখার জন্য।
নেদারল্যান্ডসে বিরোধী দলের নেতাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ভাবুনতো একবার! ট্রাম্পের সমালোচনাও তার সামনাসামনি করছে সবাই। এমনকি সাধারণ মানুষও। আমাদের দেশে একবার ভাবুন! কোনটা “সরকারি ব্যবস্থাপনা ও জনস্বার্থবিরোধী এবং শৃঙ্খলা বিরোধী” তা নির্ণয় করতেই এই আমলাগুলো ব্যর্থ। এই পিপিই ছাড়া ডাক্তার অচল। একই সমান্তরালে রোগীরা বিপদে, সাধারণ মানুষ বিপদে। আর তারা আসছে সরকারি শৃঙ্খলা নিয়ে! ফাজলামোর মাত্রা থাকা উচিত। অবিলম্বে এই সাময়িক বরখাস্ত আদেশ ও শোকজ নোটিশ বাতিল পূর্বক এই দুই সম্মানিত শিক্ষকের সসম্মানে পূর্বপদে পূণর্বহাল দাবি করছি।
লিখেছেন: নুর মোহাম্মদ ফেরদৌস, ডেভেলপমেন্ট প্রফেশনাল, একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থায় কর্মরত।