করোনা পরিস্থিতি, বাংলাদেশের অর্থনীতি ও আশার দিক
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয়। সমগ্র বিশ্বের জন্য এটি একটি বিস্ময়। কিন্তু করোনা মহামারির কারনে বাংলাদেশের অর্থনীতির যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠা কষ্টকর হবে। শুধু আমাদের নয়, সমগ্র বিশ্বকে দাঁড় করিয়েছে এমন এক বাস্তবতায় যেখানে মানুষের সমস্ত ক্ষমতা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে অতি ক্ষুদ্র এই অনুজীবের কাছে।
আমাদেরকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বড় রকমের ধাক্কা সামলাতে হতে পারে। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে কিংবা অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকাতে কতটুকু সফল হবে তা বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনার ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় থেকে উদ্ধার পেতে দলমতের উর্ধ্বে উঠে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান তিনটি খাত হলো সেবাখাত, শিল্পখাত ও কৃষিখাত। এছাড়াও আছে রেমিটেন্স ও রপ্তানী আয়। Bangladesh Bureau Of Statistics (BBS) এর তথ্যমতে ২০০১-২০০২ অর্থবছরে GDP তে কৃষির অবদান ছিল ২০%, শিল্পে ২৩.৮%, এবং সেবায় ৫৬.২০% যা ২০১৮-২০১৯ A_©eQ‡র যথাক্রমে ১৩.৭%, ৩৪.৪% এবং ৫১.১৯%। গতবছর আমাদের রেমিটেন্স আয় হয়েছে ১৮ বিলিয়ন ডলালের বেশি। সাথে সাথে গত A_©eQ‡র ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলালের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।
BBS এর তথ্যমতে ২০১৯ সালে দেশের দারিদ্র হার ২০.৫% এ নেমে এসেছে যার ভিতর অতিদরিদ্র সাড়ে দশ শতাংশ। আশংকা করা হচ্ছে করোনা মহামারির কারণে দেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ অর্থাৎ ৪০ শতাংশের বেশি হয়ে যেতে পারে এবং হতদরিদ্রের হারও সে হারে বেড়ে ২০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারে। হতদরিদ্রের অনেকে ভিক্ষা করে খায়। তারা সরকারের ত্রাণ নিয়ে জীবনযাপন করতে পারবে। কিন্তু দরিদ্রের যে শ্রেনিটা মোটের উপর অস্বচ্ছল নয় তাদের জন্য সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা এবং যাদের মাধ্যমে ঐ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হচ্ছে তাদের নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। যারা ত্রাণ বন্টনে জড়িত তাদের সবাই খুব নিবেদিত প্রাণ, নিঃস্বার্থ, এবং সৎ মানুষ তা বলা যাবে না। ইতোমধ্যে ত্রাণ চুরির অসংখ্য ঘটনা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সেদিক বিবেচনায় ত্রাণের জন্য যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়।
করোনা মহামারিতে প্রতিনিয়ত দরিদ্র মানুষ তৈরি হচ্ছে। গত আড়াই মাসে নতুন দরিদ্র মানুষ তৈরি হয়েছে। সামনে আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। আগামী এক বা দুই মাসের মধ্যে এই মহামারির অবসান ঘটবে তা নয়। এক্ষেত্রে অভাবগ্রস্থ ঐসব মানুষদের দীর্ঘদিন ত্রাণের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা কতটুকু সম্ভবপর হবে?
আমাদের দেশে করোনা রোগী শনাক্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ এখনও চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেনি। সেটি কোথায় গিয়ে পৌঁছবে তা এখনও নিশ্চিত নয়। এমতাবস্থায় অর্থনীতির উপর চাপ বাড়ছে। বিশ্বব্যাংক বলছে করোনার কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২ থেকে ৩ শতাংশে নেমে যেতে পারে যেখানে সরকার বছরের শুরুতে লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ৮.২ শতাংশ।
এরইমধ্যে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমে গেছে। বিদেশে অনেকে চাকরী হারাচ্ছে। তারা দেশে ফিরে বেকার হয়ে পড়বে। অন্যদিকে নাজুক কর্মসংস্থানের (আনুষ্ঠানিক চুক্তিহীন কাজ) কারণে অনেকে বেকার হবে। বর্তমানে বেকারত্বের হার ৪.২৯%। নিঃসন্দেহে এই বেকারত্ব বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের উপর ৪০ থেকে ৫০ লক্ষ লোক নির্ভরশীল। লকডাউনের কারনে ইউরোপ ও আমেরিকার ব্যবসা বাণিজ্য, মানুষের কেনাকাটা কার্যত বন্ধ। এসব দেশের বিভিন্ন ব্রান্ড আমাদের দেশ থেকে পণ্য আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। কয়েকশো কোটি ডলারের কার্যাদেশ বাতিল করেছে। এর প্রভাবে গত এপ্রিল মাসে রপ্তানি আয় কমে ৫২ কোটি ডলারে ঠেকেছে যা আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ৮২.৮৫% কম। অন্যদিকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হিসাবমতে চলতি বছর সারা বিশ্বেই আমদানিরপ্তানি বাণিজ্য ৩২ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে।
উপরে উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী ক্ষতির গভীরতা অনেক বেশি হলেও প্রকৃত তথ্য কেউ এখনও দিতে পারছে না; কারণ কেউ জানে না এ সমস্যা কতদিন থাকবে। তবে এ কথা ঠিক বেকারত্ব বাড়বে, দারিদ্র বাড়বে, ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হবে, মানুষের আয় কমবে, রপ্তানি আয় কমবে, সার্বিকভাবে দেশের প্রবৃদ্ধি কমবে।
তাহলে কি আমাদের আশার কোন জায়গা নেই? আমরা কি আশা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকব?
বিশ্বের অনেক দেশে আক্রান্তের হার কমে আসার কারণে লকডাউন ক্রমাগতভাবে উঠে যাচ্ছে। বাংলাদেশও সেদিকে হাঁটছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করতে এরইমধ্যে পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে আয় প্রবাহ শুরু হবে। তার সঙ্গে সরকারি প্রণোদনার টাকাও বাজারে ঢুকে যাবে। পরিবার প্রতি যে ২৫০০ টাকা সরকারি ক্যাশ প্রনোদনা সেটাও মানুষের হাতে। স্বল্পমূল্যে রেশনিং এর ব্যবস্থাও আশার আলো দেখাচ্ছে। সীমিত আকারে দোকানপাটও শপিংমল চালু করা হয়েছে। সরকার অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য কিছু নির্দেশনা দিয়ে ৩১মে থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সবকিছু খুলে দিচ্ছে। সেবাখাতের অবস্থাও আস্তে আস্তে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে।
যেহেতু বাংলাদেশের রিপেমেন্ট করার ইতিহাস ভালো সেহেতু বৈদেশিক ঋণ পাবার জন্য আবেদন করলে ঋণ পাওয়া যাবে। এ ঋণের প্রবাহ হলে দেশের তারল্য কমে যাবে। সেবাখাতসহ অন্যান্যখাত চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
সরকারের ও ব্যক্তিখাতের অপচয় কমাতে হবে। সরকারের উন্নয়ন কাজ কিছু কমাতে হবে। আমাদের বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করে সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হবে।
সর্বোপরি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অর্থাৎ স্বাস্থ্যবিধি সম্পূর্ণরূপে মেনে নিজের জীবনকে শঙ্কামুক্ত করে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক সুমন সেন
পরিসংখ্যান বিভাগ
পশ্চিম বাঁশখালী উপকূলীয় ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম