করোনা চলে যাবে, উন্মোচন করে যাবে অনেকগুলো মুখোশ!
— রেজাউল করিম
শুরুটা হয়েছিল এক ইতালি প্রবাসীর মুখে স্বদেশকে গালি দেওয়া শুনে! এয়ারপোর্টে যথেষ্ট অব্যবস্থাপনার কারণে ইতালি প্রবাসীদের বিক্ষোভ দেখেছে পুরো দেশবাসী। প্রবাসীদের করোনা পরীক্ষা করার মতো যথেষ্ট ব্যবস্থা এয়ারপোর্টে ছিলনা এবং নানা অনিয়মের মাধ্যমে এয়ারপোর্ট থেকে ঘুষের বিনিময়ে বের হওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া না দেওয়া নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। ফলে করোনার প্রাদুর্ভাব এখান থেকেই ছড়িয়ে পড়ে।
দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ই মার্চ, তাও এক প্রবাসীর শরীরে। জার্মানি ফেরত ফয়সল শেখ নামের এক তরুণের শরীরে প্রথম এই করোনা শনাক্ত হয়। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় রোগীও প্রবাসী অর্থাৎ ইতালি ফেরত! তাহলে বোঝা যায় প্রবাসীরাই দেশে এই করোনা আমদানি করেছে। তাদের ব্যাপারে শুরু থেকেই কঠোর হলে আজ আমরা এমন দূর্যোগ পরিস্থিতিতে পড়তাম না।
১৮ই মার্চ থেকে সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কোচিং সেন্টার বন্ধের ঘোষণা আসে। সেখানেও কিছু কোচিং সেন্টার খোলা রাখতে দেখেছি, যা সরকারের দমন করতে হয়েছে। অথচ যারা কোচিং সেন্টারে পড়ায় তারা ফেসবুকে নীতিবাদী বুলি ছড়ায়!
২৬ মার্চ থেকে শুরু হলো সাধারণ ছুটি, যেখানে সকল ধরনের সরকারী-বেসরকারী অফিস, আদালত, ব্যাংক-বীমা, ট্রেন, যানবাহন, আকাশপথ, সড়কপথ, জলপথ ইত্যাদি বন্ধ থাকবে। নামানো হলো সেনাবাহিনী। ঘোষণা করা হলো দুর্যোগময় পিরিয়ড।
এরমধ্যে দেখতে হলো যশোরের মনিরামপুরে দুই বয়স্ক ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটের পাওয়ার পাওয়া এক এসিল্যান্ড কর্তৃক কান ধরিয়ে উঠ-বস করানোর ছবি। ফেসবুকে ঘৃণার পারদ জমেছিল সেই এসিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। প্রজাতন্ত্রের চাকরি করে প্রজাদের কান ধরিয়ে অপমানিত করার দায়ে সেই এসিল্যান্ডের প্রত্যাহারও দেখেছি।
ট্রেন-বাসসহ সবধরনের যানবাহন বন্ধ রেখে হঠাৎ গার্মেন্টস শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিয়ে গিয়ে সরকারের দ্বিমুখী আচরণ দেখেছে পুরো দেশবাসী। গার্মেন্টস যার নির্দেশেই খোলা হোক কিশোরী, বয়স্ক মহিলারা বাচ্চা কোলে করে মাইলের পর মাইল হেঁটে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে গেলেন। এমন করুন দৃশ্য দেখে আমাদের হৃদয় নাড়া দিয়েছে।
সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে যারা দিনমজুর, শ্রমিক, অসহায় অর্থাৎ দিনে এনে দিনে খায় তাদের জন্য সরকারের দেওয়া ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব যাদের দেওয়া হয়েছে তাদের আচরণ! যাদেরকে বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে কিছু কুলাঙ্গার রয়েছে, যাদের ঘরে এবং বিছানার নিচে চাল-তেল পাওয়া গেছে। মর্মাহত হওয়ার কারণ হচ্ছে, তারা জনপ্রতিনিধি অর্থাৎ জনগণের ভোটে নির্বাচিত। তাদের পোস্টারে লেখা ছিল, ন্যায় বিচারক এবং জনদরদী সহ নানা উপাধি। অথচ দিনশেষে তারা চোর, ভাবা যায়?
সারাদেশ লকডাউন; সরকারের কোটি কোটি ডলার দৈনিক লস হচ্ছে জেনেও জনগণের স্বার্থে সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক হুজুরের জানাজায় লাখো মানুষের ঢল! জানাজায় কয়েকজনের মধ্যে করোনা থাকলে তা সবার মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে তা ইতোমধ্যে সবার জানার কথা। কিন্তু প্রশাসন এই উৎসুক জনতাকে আটকাতে পারেনি, ফলে প্রত্যাহার হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল সার্কেল এএসপি ও সরাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। অথচ জানাজাতে গিয়ে করোনা হলে নিজের জানাজা পড়তেও কেউ আসবেনা, সেই চিন্তা তারা করেনি।
সবশেষে কীট নাটক! গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যখন কীট তৈরি করছে, সেটি নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছে কিছু অসাধু কীট। কারণ আমদানিতে তারা যে আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে তা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কীট সরবরাহ করলে পাবেনা এমন তথ্য উঠে এসেছে। চিন্তা করতে পারেন? আমরা কতোটা ভয়ংকর হয়ে গেছি!
ব্যবহার করা গ্লাভস ধুয়ে বিক্রি, মাস্কের দাম বাড়তি, রং মিশিয়ে সেনিটাইজার বিক্রি সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম বাড়িয়ে এই কঠিন মুহূর্তে আমরা অমানুষের পরিচয় দিয়েছি। এমনকি ইউনিলিভারের মতো প্রতিষ্ঠান ৭৫ টাকা দামের হ্যান্ডওয়াস ৯৫ টাকায় বিক্রি করতে দেখেছি!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দক্ষতার সাথে করোনা মোকাবিলায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন, ঘোষণা করেছেন প্রণোদনা সহ বিভিন্ন কর্মসূচি। দেশের এই পরিস্থিতিতে কাউকে যেনো খাদ্যের অভাবে পড়তে না হয় সেজন্য বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে খাদ্য বিতরণ করছেন। কিন্তু রন্দ্রে রন্দ্রে বসে আছে কিছু কুলাঙ্গার, যাদের কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এখানে প্রতিটি কর্মে যারা জড়িত, তারা কারা? তারা তো আমরাই!
প্রবাসী, গার্মেন্টস কর্মী, ব্যবসায়ী, জনতা, জনপ্রতিনিধি, পুলিশ, ডাক্তার সবাই তো আমরা; যে কোনোভাবেই একে অপরের আপনজন! তবুও আমরা লোভের কারণে অমানুষ হয়ে যাই।
আমরা নিজেরা যতদিন সচেতন হবোনা, সৎ হতে পারবোনা ততোদিন এই দেশের সিস্টেমে কেউ পরিবর্তন আনতে পারবেনা।
লেখক: ব্যাংকার