BanshkhaliTimes

কবি ফররুখ আহমদের জন্মশতবার্ষিকী আজ

বিটি ডেস্ক: আজ ১০ জুন, বাংলাদেশের ইসলামী রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদের ১০০তম জন্মবার্ষিকী। তিনি এমন মানুষ ছিলেন, যাঁর বিশাল চোখ দেখে সবাই বিস্মিত হয়ে যেতেন। অবশ্য এ বিস্ময়ের পেছনে অনেক কারণও ছিল।

তার চোখে ছিল স্বপ্ন, লেখায় স্বপ্ন, সর্বত্র স্বপ্ন। তিনি নিজে যেমন স্বপ্ন দেখতেন, তেমনি মানুষকে স্বপ্ন দেখাতেন। আর বলতেন সমুদ্রের কথা, সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে বহুদূর যাবার কথা।

তার কবিতায় নীল সমুদ্রের গর্জন, অচেনা বন্দর, লবঙ্গ দ্বীপ, সবুজ পাতার নারঙ্গী বন, নোনা পানির জোয়ার, পাল তোলা জাহাজের যাত্রা আমাদের ব্যাকুল করে তোলে।

কবি ফররুখ ইসলামী রেনেসাঁর কবি হিসেবে পরিচিতি পেলেও তিনি ছিলেন মানবতার কবি, ফুল-পাখিদের কবি, ছোট-বড় সবার কবি। কবি ফররুখ আহমদের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রেডিও তেহরানের রংধনু আসরে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়েছে।

কবি ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ জুন তৎকালীন যশোর জেলার মধুমতি নদীর তীরে অবস্থিত মাঝআইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শৈশবে গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে ও কৈশোরে কোলকাতার তালতলা মডেল হাইস্কুল এবং পরে খুলনা জিলা স্কুলে ভর্তি হন।

সেখানে ভর্তি হবার পর তিনি লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে অনেক ছড়া কবিতা লিখেন। রূপসা নদীর মাছের খেলা আর মধুমতির ছলাৎ ছলাৎ পানির ঢেউ কবির মনকে দোলা দিতে থাকে। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ কবিকে পাগল করে তুলতো। তাই তো তিনি স্কুলের দেয়াল পত্রিকাতে লিখেন-
বিষ্টি পড়ে রিমঝিমিয়ে
রিমঝিমিয়ে রিমঝিমিয়ে
টিনের চালে গাছের ডালে
বিষ্টি ঝড়ে হাওয়ার তালে।
বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
বিষ্টি যেন মিষ্টি মধুর।

বৃষ্টির দিনে বকেরা বাঁশ ঝাড়ের আগায় বসে কক্ কক্ শব্দ করে আর শীতে কাঁপতে থাকে। বাঁশ বনের ভেতর ওরা এদিক-ওদিক উড়ে যায়। এসময় দুষ্ট ছেলেরা বকের ছানা ধরার জন্য বাশঁঝাড়ে উঁকিঝুঁকি মারে। কবি এ দিকটি ফুটিয়ে তুলেছেন তার বৃষ্টি ছড়ায়।

কবি স্কুল পড়া অবস্থায় লেখালেখি শুরু করলেও কলেজে ভর্তি হবার পর তিনি সেসব লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পাঠাতে শুরু করলেন। তার লেখা ছাপা হতে লাগলো মোহাম্মদী, বুলবুলসহ নানান পত্রিকায়। পাঠক মহলে তরুণ কবি ফররুখে কবিতা নতুন পদধ্বনি তুলতে লাগলো। সবাই সাহিত্য পত্রিকার পাতায় পাতায় খুঁজতে লাগলো ফররুখের নতুন কবিতা।

পত্রপত্রিকায় নিজের লেখা ছাপা হতে দেখে ফররুখের আনন্দের যেন শেষ নেই। এ সময়কার একটি ঘটনা কবির উৎসাহকে কয়েকগুন বাড়িয়ে দিল। ঘটনাটি হচ্ছে, একদিন কলেজে আসার পথে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। তিনি বৃষ্টিতে ভিজে ক্লাসে এসে হাজির হলেন। পরণে ভেজা জামার কারণে তিনি কিছুটা সংকোচ করে পেছনের বেঞ্চে গিয়ে বসলেন।

ক্লাসে এলেন অধ্যাপক প্রমথ নাম বিশী। তিনি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর লেকচার দিচ্ছেন; ছাত্ররা তা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। কিন্তু ফররুখ বুঝতেই পারলেন না যে, ক্লাসে স্যার এসেছেন। ফররুখ তখন চলে গেছেন কবিতার জগতে। হঠাৎ প্রমথ নাথ বিশীর দৃষ্টি গেল ফররুখের দিকে। তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন ফররুখের কাছে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত। আচমকা স্যারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফররুখ ঘাবড়ে গেলেন। তিনি খাতাটি লুকানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু প্রমথ নাথ বিশীর দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারলেন না।
তিনি ফররুখকে কোন বকুনি না দিয়ে খাতাটি হাতে তুলে নিলেন। বিশী খাতায় লেখা কয়েকটি কবিতা মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। কবিতা পড়ে তিনি খুবই মুগ্ধ হলেন এবং ক্লাস শেষে খাতাটি শিক্ষক কমনরুমে নিয়ে গেলেন। কমন রুমে গিয়ে ফররুখের কবিতাগুলো তিনি সকল শিক্ষককে পড়ে শোনালেন। অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসু কবিতাগুলো শুনে অভিভুত হলেন। পরে তিনি কবিতাগুলো নিয়ে তার কবিতা পত্রিকায় প্রকাশ করলেন। সে সময় সাহিত্য মহলে একটি কথা প্রচলিত ছিল আর তা হলো, পত্রিকায় যার কবিতা ছাপা হবে সে-ই বাংলা সাহিত্যে কবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবে। আর তাইতো পরবর্তীতে দেখা গেল ফররুখ বাংলা সাহিত্যে কবিতা বন্যা বইয়ে দিলেন।

কবি ফররুখ ছিলেন ছোট-বড় সবার কবি। তাই বড়দের পাশপাশি তিনি ছোটদের জন্যও অনেক কবিতা লিখেছেন। ছোটদের জন্য লেখা প্রতিটি কবিতাই যেন আন্তরিকতায় ভরপুর। কবি তার কবিতা অসত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তিনি শিশুদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। আর তাইতো কবির শিশুরা ঘোষণা করে-
শুনবো না আর পিছন টান
মানবো না আর বান তুফান
ডাকছে খুন রক্তারুণ
ভবিষ্যতের পথ উজ্জ্বল
সামনে চল সামনে চল।

কবির এ আহবানের পর কি শিশুরা ঘরের কোণে বসে থাকতে পারে? কক্ষনোই না। তাইতো কবি লিখেছেন-
নতুন আলোকে গড়েছি আমরা
নয়া জামাত
মানবো না আর অথৈ পাথার
ঝড়ের রাত ।
নয়া জামাতের মাঝে আমাদের
লাভটা এই
আছে দুর্জয় সাহস পরাণে
শংকা নেই।
আমরা বাচ্চা তবু সাচ্চা
মুসলমান
পাহাড় যদিও টলে যায় তবু
টলে না প্রাণ।

কবি ফররুখ ছড়া ও কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য অনেক গানও লিখেছেন। তার একটি বিখ্যাত গান হচ্ছে-
তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে
খোদার মদদ ছাড়া
তোরা পরের ওপর ভরসা ছেড়ে
নিজের পায়ে দাঁড়া ।

কবি নিজে যেমন সৎ পথে চলতেন, সত্য কথা বলতেন তেমনি তিনি ছোটদেরকেও আল্লাহর পথে ডাকতেন। তিনি সব সময় নবীর দেশে যাবার প্রত্যাশা করতেন। তবে তিনি একা নন, বিশ্বের সকল দেশের শিশুকে নিয়ে তিনি নবীর দেশে যেতে চাইতেন। কবি লিখেছেন-
আমরা সকল দেশের শিশু যাবো নবীর মদীনায়,
তোরা সঙ্গে যাবি আয়
আয় আয় আয়
তোরা সঙ্গে যাবি আয়

কবি ফররুখ আল্লামা ইকবালের বেশ কিছু গানের অনূবাদ করেছিলেন। যেমন- উঠো! দুনিয়ার গরিব ভুখারে জাগিয়ে দাও ধনিকের দ্বারে ত্রাসের কাঁপন লাগিয়ে দাও।

বাংলা ভাষার ওপরও তিনি ছোটদের উপযোগী গান লিখেছেন। তার একটি গান হলো-
ডালে ডাকে পাখির বাসা
মিষ্টি মধুর পাখির ভাষা
সাত সাগরে নদীর ভাষা
কুলু কুলু নদীর ভাষা
হাজার সুরে হাজার ভাষায়
এই দুনিয়ায় ঘেরা
আর মাতৃভাষা বাংলা আমার
সকল ভাষার সেরা।

কবি প্রচুর পড়াশুনা করতেন। লেখাপড়ার ক্ষেত্রে তাঁর কোন ধরাবাঁধা সময় ছিল না। যখন মন চাইতো তখনই বসে যেতেন কাগজ-কলম নিয়ে। তাই বলে তিনি সংসার, ছেলেমেয়ে সম্পর্কে কখনো উদাসীন ছিলেন না। গৃহকর্তা হিসেবে, পিতা হিসেবে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেনসতেচনভাবে। অভাব-অনটন থাকলেও কবির সংসার সুখ ছিল।

কবি খুবই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। মহানবী (সা.) যেমন তালি দেয়া জামা পরতেন, কবিও তালি দেয়া জামা-কাপড় পছন্দ করতেন। গরিব, দুঃখী ও সাধারণ মানুষকে ভালবাসতেন বলেই তাদের নিয়ে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। ১৯৪৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় বহু মানুষের লাশ পড়ে থাকতো রাস্তায় রাস্তায়। মানুষের দুঃখ, বেদনা ও মৃত্যু কবিকে ব্যাকুল করে তোলে। এ সময় তিনি ‘লাশ’ নামক একটি কবিতা লেখেন। বিখ্যাত এ কবিতার কিছু অংশ এরকম-
যেখানে প্রশস্ত পথ ঘুরে গেল মোড়
কালো পিচঢালা রঙে লাগে নাই ধূলির আচঁড়
সেখানে পথের পাশে মুখগুঁজে পড়ে আছে জমিনের পর
সন্ধ্যার জনতা জানি কোন দিন রাখে না সে মৃতের খবর।
হে জড় সভ্যতা !
মৃত সভ্যতার দাস স্ফীত মেদ শোষক সমাজ !
মানুষের অভিশাপ নিয়ে যাও আজ;
তারপর আসিলে সময় বিশ্বময় তোমার শৃঙ্খলগত মাংস পিন্ডে পদাঘাত হানি
নিয়ে যাব জাহান্নাম দ্বারপ্রান্তে টানি;
আজ এই উৎপীড়িত মৃত্যু-দীর্ঘ নিখিলের অভিশাপ ধ্বংস হও, তুমি ধ্বংস হও।

কবি এ কবিতা সভ্যতা বা সমাজের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে তা ধ্বংস হতে বলেছেন। কবির এ ক্ষোভের কারণ হচ্ছে, যে সমাজে মানুষ না খেয়ে মঃলাশ হয়ে পড়ে থাকে রাস্তায়, সে সমাজের কিছু মানুষ বড় দালানে আরাম-আয়েশে দিন কাটায়। এই ধনীক শ্রেণীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও ঘৃণার কথাই ফুটে ওঠেছে লাশ কবিতায়।

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *