এয়ারপোর্টে পিসিআর স্থাপন নিয়ে গড়িমসি, রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সাথে উপহাস
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় আঘাতের মধ্যেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। মহামারির এই পরিস্থিতিতেও একক মাস হিসেবে গত এপ্রিলে ২.০৬ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার সমপরিমাণ ২০৬ কোটি ডলার অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত বছরের একই মাসে আসা অর্থের দ্বিগুণ। গত বছরের একই মাসে ১০৯ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে; এই অংকের অর্থ গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে ৮৯.১১ শতাংশ বেশি, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো একক মাসে রেমিটেন্স প্রবাহে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি।
এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি প্রমাণ করে যে প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ গত ১৮ মাসে দুই তৃতীয়াংশ কমে বর্তমানে ২.৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে; পরিমাণটা এতই কম যে দেশটির ব্যবসায়ীরা আমদানী মূল্য পরিশোধ করতে পারছে না। বাংলাদেশ সরকার কয়েক মাস আগে শ্রীলঙ্কাকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে, রিজার্ভ থেকে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতির কারণে সরকার গত কয়েকদিন আগে সেখানে জরুরী অবস্থা ঘোষনা করতে বাধ্য হয়েছে। করোনা ও অর্থনৈতিক মন্দার এই বাস্তবতায়ও আমাদের রিজার্ভ এখন ৪৬/৪৭ বিলিয়ন ডলার, যার মৌলিক অবদান আমাদের প্রবাসীদের ভাই/বোনদের।
মধ্যপ্রাচ্যের যে সকল দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীরা কর্মরত আছেন তন্মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত অন্যতম, সংখ্যায় সাত লক্ষাধিক – সৌদী আরবের পরে সবচেয়ে বেশী। এই বছরের জুলাই পর্যন্ত আরব আমিরাত থেকে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন প্রায় ১৬০ মিলিয়ন ডলার, টাকায় যার পরিমাণ ১,৩৬৩ কোটি টাকারও বেশী; গত বছর আমিরাত প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ২.৪৪ বিলিয়ন ডলার। করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশসহ আরো কয়েকটি দেশ থেকে সেখানে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয় আমিরাত।
তবে আগস্ট মাসেই এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয় এবং আরব আমিরাত ভ্রমণের পূর্বে যাত্রীদের নতুন করে ৬ ঘণ্টা ব্যবধানের একটি ‘র্যাপিড পিসিআর টেস্ট’ করার নিয়ম বেঁধে দেয়। দেশের বিমান বন্দরগুলোতে র্যাপিড পিসিআর টেস্ট ল্যাব না থাকায় আটকে পড়া প্রায় ৭,০০০ প্রবাসীরা পড়েছেন বিপাকে। তারা দেশের বিভিন্ন জেলায় মানববন্ধন, সভা, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিয়েও কোনো ফল পাচ্ছেন না; অনেকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে, ফলে চাকরি হারানোর প্রবল শঙ্কা আছে।
যাদের ব্যবসা আছে, তারাও অর্থনৈতিক ক্ষতি গুণবেন; এটা সামগ্রিকভাবে আমাদের অর্থনীতিতেই আঘাত হানবে। এই সরকার প্রতিনিয়ত পাকিস্তানের সাথে আমাদের দেশের অবাস্তব ও অপ্রাসঙ্গিক তুলনা টানে; অথচ পাকিস্তানের অনেক বিমানবন্দরেই Rapid PCR বুথ বসানো হয়েছে, ভারতেও আছে; কিন্তু আমাদের দেশে আমরা একটা গড়িমসি দেখতে পাচ্ছি এবং এই গড়িমসির বৈধতাও কর্তৃপক্ষ নির্মাণ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের এক কর্মকর্তা একটি পত্রিকাকে বলেছেন, ‘আরব আমিরাত বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় রেখেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়েছে, ফলে এই তালিকা থেকে সরিয়ে প্রবেশের অনুমতি যেন সহজ করা হয়- এমন কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হচ্ছে। একটি ল্যাব স্থাপন ব্যয়বহুল, এছাড়া এটি পরিচালনার ও ব্যবস্থাপনার জন্যও প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে; ফলে হুট করে ল্যাব স্থাপন করার পর আরব আমিরাত ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশকে না রাখলে এসব ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।
এই বুথ স্থাপন ব্যয়বহুল অজুহাতে তারা গড়িমসি করছেন। দেশের বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতি যেখানে নিত্যসঙ্গী, যেখানে মেডিকেলের পর্দা, কর্মকর্তার অফিসের বালিশ ওঠানো-নামানোর ব্যয় দেখানো হয় আকাশচুম্বী(!), সেখানে এক Rapid PCP Test বুথ বসানোতে যদি ‘ব্যয়বহুল’ অজুহাতে গড়িমসি করা হয়, তাহলে এটাকে লুটের রাজনীতি ও প্রশাসননীতি ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন অথরিটি বলছে, বাংলাদেশের কোন বিমানবন্দরে র্যাপিড পিসিআর ল্যাব স্থাপন করার মতো কোন যায়গা নেই; স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় বলছে বেশি জায়গার প্রয়োজন নেই, আর প্রবাসী মন্ত্রণালয় বলছে এক মাসেও এটা করা সম্ভব হবে না। অথচ ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে পিসিআর ল্যাব তৈরী করা হয়েছে, যার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব তৈরী করা যেত বলে মনে করে প্রবাসীরা। অথবা ঢাকা বিমানবন্দরের সন্নিকটে যে কোন হাসপাতালের পিসিআর ল্যাব প্রবাসীদের জন্য ২৪ ঘন্টা সেবা প্রদানের জন্য উন্মুক্ত করে দেবার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি । দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে যারা বিদেশে কাজ করে যাচ্ছেন, তারা দেশের মাটিতে নেমে এয়ারপোর্টেই প্রথম ধাক্কা খান। ইমিগ্রেশন পুলিশ আর কর্মকর্তাদের হেনস্থার শিকার হয়ে স্তব্ধ হয়ে যান অনেকে; প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা দেয়ার পরও এই হেনস্থা-হয়রানি বিন্দুমাত্র কমেনি। চলমান সংকটকে দূর করতে পারেনি যারা, তারা যে বুথ স্থাপনে গড়িমসি করবে এটাই অনুমেয়। লক্ষ লক্ষ প্রবাসীদের হাজার হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স ভোগ করা আরাম, তবে তাদের জন্য বিমানবন্দরে দুইটা Rapid PCR Test বুথ বসানো ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য! হীরক রাজার দেশে লুটেরাদের অবিশ্বাস্য গল্প!
লেখক
এস এম আব্দুল্লাহ আল মোরশেদ
এডভাইজার, বাংলাদেশ বিজনেস ফোরাম, দুবাই
ম্যানেজার, আল দিয়াফা (ইমিগ্রেশন সেক্টর) দুবাই, ইউএই