মুহাম্মদ মিজান বিন তাহের: বাঁশখালী উপজেলার লক্ষাধিক জেলের জীবন-জীবিকার অন্যতম অবলম্বন হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। উপকূলের বিভিন্ন স্থানের সৈকতজুড়ে শুঁটকিপল্লি। রুপালি বালুর মধ্যে কালো জাল ফেলা। সেই জালের ওপর কালো পলিথিনের মুখবন্ধ ব্যাগ সারি ধরে রাখা আছে। সাগর থেকে মাছ ধরে শুকানোর পর তা দেশের বাজার ছাড়াও রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুদের দৌরাত্ম্যে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জেলেদের জীবন। তারপরেও থেমে নেই তারা। জীবনের তাগিদে ঝুঁকি নিয়ে সাগর থেকে মাছ আহরণ ও তা শুকিয়ে শুঁটকি বানিয়ে জীবন নির্বাহ করছেন তারা। বর্ষা মৌসুমে শুঁটকি শুকানো কঠিন। শুষ্ক মৌসুমই শুঁটকি শুকানোর উপযুক্ত সময়।
তবে সম্প্রতি বর্ষা শেষ না-হতেই এসব এলাকায় শুঁটকি শুকানোর ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে শুরু হওয়া শুঁটকি আহরণ ও শুকানোর এ কাজ চলবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তাই এখানকার জেলে পল্লীগুলো কর্ম ব্যস্ততায় মুখর হয়ে উঠেছে।
পাশাপাশি দুই শতাধিক নৌকা সমুদ্র থেকে মাছ আহরণ ও আনা-নেওয়ার কাজ করছে।
সব মিলিয়ে প্রায় ৫/৭ হাজার শ্রমিক এসব কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সমুদ্র থেকে আনা মাছ আহরণ, শুকানোসহ বিভিন্ন কাজে এলাকার বহু মানুষ জড়িয়ে পড়ায় এলাকায় কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
বাঁশখালী ছাড়া অন্য এলাকার জেলেরা ইউরিয়া সার, লবণ ও বিষাক্ত পাউডার মিশিয়ে কাঁচা মাছ শুকিয়ে শুঁটকি বানিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ওইসব শুঁটকি খেতেও তেমন স্বাদ নয়। কিন্তু বাঁশখালীর সমুদ্র উপকূলের জেলেরা কোনো কিছু মিশ্রণ ছাড়াই রোদের তাপে মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করেন। তাই বাঁশখালীর শুঁটকি খুবই সুস্বাদু এবং জনপ্রিয়। বাঁশখালীর জেলে পল্লীগুলোতে হাজার হাজার মণ শুঁটকি ক্রয় করতে চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ ও চকবাজারের গুদাম মালিকরা দলে দলে হাজির হচ্ছেন এবং অনেকেই জেলেদের অগ্রীম টাকা দিয়ে যাচ্ছেন। সূত্র জানায়, বাঁশখালীর শুঁটকির মধ্যে লইট্যা, ছুরি, রূপচান্দা, ফাইস্যা, মাইট্যা, কোরাল, রইস্যা, পোঁহা ও চিংড়ি শুঁটকি অন্যতম। এসব শুঁটকি এখন রপ্তানি হচ্ছে দুবাই, কাতার, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ওমান, কুয়েত ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে। শুঁটকি রপ্তানি করে কোটি কোটি টাকা আয় করছে খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই ও চকবাজারের বড় বড় গুদাম মালিকরা। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্বও। সাগর থেকে জেলেদের আহরণ করা মাছ আধুনিক পদ্ধতিতে শুকানোর কোনও ব্যবস্থা না-থাকায় প্রতিবছর সাগর উপকূলে লক্ষ লক্ষ টাকার মাছ নষ্ট হয়।
প্রায় ২৫ প্রজাতির মাছ রোদে শুকিয়ে তৈরি করা হয় শুঁটকি। এর মধ্যে রূপচাঁদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্ট্যা, পোপা অন্যতম। বাঁশের মাচায় রেখে তা শুকানো হয়। বর্ষার কয়েক মাস ছাড়া বছরের বাকি সময়ে মোটামুটি হলেও সবচেয়ে বেশি শুঁটকি তৈরি হয় শীতে। আর এ শুঁটকি মহালে কাজ করে জীবিকা চালান হাজারও শ্রমিক।
কেউ কেউ সাগর থেকে আনা মাছ শুকাচ্ছেন, কেউ শুকানো মাছ কুড়াচ্ছেন। আর কেউ শুকানো মাছ বাছাই করছেন। পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি নারী ও শিশু শ্রমিককে এসব কাজ করতে দেখা গেছে।
ছনুয়া খুদুকখালি এলাকার এক নারী শ্রমিক হোসনে অারা বেগম মাছ বাছতে বাছতেই বললেন, ‘দৈনিক ৪-৫ শ টাকা মজুরিতে কাজ করছি। সংসার চলে এই টাকায়।’
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক মাছ ব্যবসায়ী আসেন এই মৌসুমে বাঁশখালীতে। তাঁদের একজন হাটহাজারী এলাকার ব্যবসায়ী মুনিরুল আজাদ বলেন, আমি বিগত ৮-১০ বছর যাবৎ ধরে শুঁটকির ব্যবসা করে আসছি চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায়। তবে প্রতিবছর বেশীর ভাগ সময় এই মৌসুমে বাঁশখালী ও কুতুবদিয়া এসে শুটঁকি ক্রয় করে তা চট্টগ্রামের চাক্তাইসহ বেশ কয়েক জায়গায় পাইকারী দামে বিক্রয় করি। প্রতি বছর এ মৌসুমে আমরা মজুরি ও খরচ বাদ দিয়ে একেক ব্যবসায়ীর ৩ থেকে ৪ লক্ষ টাকা লাভ হয়।শেখেরখীল শুঁটকি ব্যবসায়ী আরিফ, শাহজাহান,
রাশেদ জানান, এখানে উৎপাদিত মাছ চট্টগ্রাম নগরের চাক্তাই পাইকারি বাজারে বিক্রি করা হয়। আমাদের শুঁটকিতে কোনও ধরনের মেডিসিন ব্যবহার করা হয় না, তাই আমাদের শুটকিগুলো খুব সুস্বাদ এবং মানসম্মত হয়।
শুঁটকির কাজে নিয়োজিত জেলেরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরো ব্যাপক হারে শুঁটকি উৎপাদন করার মাধ্যমে তা বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হতো বলে তিনি জানান।