ইসলামে অমুসলিমদের গুরুত্ব
————————————
ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী
————————————
ইসলাম শান্তির ধর্ম, উদার এবং অসাম্প্রদায়িক ধর্ম। মুসলমান নামধারি কিছু লোকের কর্মকাণ্ডে অনেক ক্ষেত্রে ইসরামের সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে, হচ্ছে। মহান আল্লাহ পাককে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে ‘রাব্বুল আলামীন’ (মহাবিশ্বের প্রভু)। ‘রাব্বুল মোসলেমিন’ (মুসলমানদের প্রভু) বলা হয়নি। তিনি মুসলমানদের প্রভু নয়, সবধর্মের মানুষের এবং সকল সৃষ্টির রব। মহান আল্লাহ পাকের প্রেরিত রাসুল হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ (মহাবিশ্বের রহমত)। এখানে ‘রাহমাতুল্লিল মোসলেমিন’ (মুসলিমের জন্য রহমন) বলা হয়নি। তিনি সব ধর্মের মানুষ এবং সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমত হিসেবে প্রেরিত। পবিত্র কোরআনে মহাগ্রন্থ কোরআন সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘হুদাল্লিন নাস’ মানুষের হিদায়তের জন্য। ‘হুদাল্লিল মোসলেমিন’ বা মুসলমানদের জন্য শুধু হিদায়ত করবে তা বলা হয়নি। এসব সর্বজনীন ঘোষণার মাধ্যমে বুঝাযায় ইসলাম উদার এক ধর্মের নাম।
ইসলামে রয়েছে অমুসলিমদের অধিকার ও গুরুত্ব। মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘অমুসলিমদের রক্ত আমাদের রক্তের মত নিরাপত্তার দাবি রাখে। তাদের ধন সম্পদ আমাদের ধন সম্পদের মত নিরাপত্তার দাবি রাখে।
পবিত্র ইসলামের বিশ্বাসী হলে ধর্ম বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে পক্ষপাত মূল বিচার না করার নির্দেশ মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে প্রদান করেছে। ইরশাদ হয়েছে ‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেনো সুবিচার ত্যাগে প্ররোচিত না করে। তোমরা সুবিচার করবে, এটি তাক্ওয়ার নিকটতম’। (সূরা মাইদা, ৮)
প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন, মনে রাখবে, যে ব্যক্তি মুসলমান রাষ্ট্রের অমুসলমান নাগরিকের ওপর অত্যাচার করবে তার বিরুদ্ধে কেয়ামতের দিন অত্যাচারিত অমুসলিমের পক্ষে আমি বাদি হবো। (আবু দাউদ)
ইসলামের সৌন্দর্য যেন মানুষের কাছে পৌঁছানো সহজ হয় এ লক্ষ্যে অমুসলমানদের নিরাপত্তা দানের কথা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুশরিকদের কোন ব্যক্তি যদি তোমাদের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে, তোমরা আশ্রয় দাও, যাতে সে আল্লাহর কথা শুনতে পারে, অতঃপর তাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছিযে দাও’ (সূরা তওবা : ৬)
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেম প্রীতি সৌহার্দ্য সম্প্রীতির মাধ্যমে একটি কল্যাণকর সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ইতিবাচক পদ্ধতি ‘দাওয়াত’ দ্বারা মানুষের কাছে ইসলামের মহান শিক্ষা তুলে ধরেছিলেন।জোর করে শক্তি প্রদর্শন দ্বারা মানুষের হৃদয় জয় করা যায় না।করতে গেলে শান্তি আসে না নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। একজন মানুষ হত্যা সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস করার সমতুল্য অপরাধ। কেউ যখন এক ব্যক্তিকে হত্যা করে তখন মানুষ বলে একব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। সাক্ষি, আইনজীবী, বিচারক সবাই বলে এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে।মহান বিচারক আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘কাউকে কেউ হত্যার অপরাধ ছাড়া এক ব্যক্তিকে হত্যা করলো (সে যে ধর্মের হোক) সে যেন সমগ্র মানব জাতিকে হত্যা করলো। আর যদি কেউ কারো প্রাণ বাঁচালো সে যেন সমগ্র মানব সম্প্রদায়কে বাঁচালো। (সূরা মায়িদা, আয়াত: ৩২)
এ ধরনের মানবতাবাদী ঘোষণা কোন ধর্মের গ্রন্থে লেখা আছে কিনা তা আমার জানা নেই।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “দুনিয়া ধ্বংস করে দেওয়ার চেয়েও আল্লাহর নিকট ঘৃণিত কাজ হলো মানুষ (যে ধর্মের লোক হোক) হত্যা করা।” (তিরমিজী)
মাহবুবে খোদা হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাফিরগণ রাত দিন গালি দিত। যারা প্রকাশ্যে তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল, অনেক সাহাবায়ে কেরামকে শহীদ করেছিল, সেসব কাফির বদর যুদ্ধে বন্দি হলে তিনি কাউকে হত্যা বা আঘাত করেননি। তাদের সাথে যে ধরনের আচরণ করেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এসব কাফিরগণ মক্কায় ফিরে বলেছিলেন, “মদিনাবাসী (মুসলমানরা) সুখে থাক, তারা নিজেরা পায়ে হেঁটে আমাদের উটে চড়তে দিয়েছে, আটা যখন ফুরিয়ে আসে তখন তারা খেজুর খেয়েছেন আর আমাদের রুটি খেতে দিয়েছেন।”
কয়েকটি কারণে মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদায় হজ্বের ভাষণ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জীবনে লক্ষাধিক মানুষের সামনে কোন হাদিস বর্ণনা করেননি। জীবনে হজ করেছিলেন একবার। লক্ষাধিক হাজীদের সামনে পবিত্র দিনে (শুক্রবার ও হজের দিন) পবিত্র মাসে (যে মাসে যুদ্ধ সংঘাত হারাম) পবিত্র শহরে (পবিত্র মক্কা) প্রদেয় ভাষণ একটি ঐতিহাসিক ভাষণ। মুসলমানদের জন্য নবীজীর পূর্বের কথার চেয়ে পরের বাণীর গুরুত্ব অধিক। তাঁর কর্মের চেয়ে কথার গুরুত্ব আমাদের জন্য বেশি। বিদায় হজের ভাষণ ছিল তাঁর জীবনের শেষ কালের বাণী, তাই এ ভাষণের গুরুত্ব ব্যাপক। এই গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে তিনি মানব জাতিকে উদ্দেশ্য করে বার বার বলেছেন, “ইয়া আইয়ুহান নাস” (হে মানবমণ্ডলী) অর্থাৎ হে সর্বধর্মের মানুষ! আল্লাহ্ তোমাদের ওপর এদিন, এ মাস ও এ শহরের মতো চিরদিনের জন্য একে অন্যের রক্তপাত,সম্পদ ও সম্মানহানি হারাম করেছে। (সহিহ বোখারী)
বিদায় হজের বিদায় বেলার অমর বাণীর মাধ্যমে কেয়ামত পর্যন্ত একে অপরের রক্তপাত হারাম ঘোষণা করেছে। যুদ্ধ সংঘাত কোনদিন কেউ আর বৈধ করতে পারবে না।
পবিত্র কোরানে মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ পরিবর্তে যাদের ডাকে তাদের গালমন্দ করোনা কারণ অজ্ঞতাবশ তারা আল্লাহ্কে গালি দিবে। (সূরা আনআম, আয়াত : ১০৮)
মহান আল্লাহ্ পাক যেখানে মূর্তি পূজারীদের গালমন্দ করতে নিষেধ করেছেন সেখানে জঙ্গিরা ধর্মের অভ্যন্তরে পরস্পর ঝগড়া ফ্যাসাদ সৃষ্টি করছে।
মুসলমানদের মনে রাখতে হবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম সর্বধর্মের মানুষের সেবক তারপর ধর্ম প্রচারক। মক্কায় ধর্মপ্রচারক মদিনায় রাষ্ট্রনায়ক।
মদিনার রাষ্ট্রের প্রথম পর্যায়ে মুসলমান ছিল মাত্র কয়েক ভাগ (দুইশতজন)। বাকি সবায় অমুসলিম। তিনি ছিলেন প্রথম অমুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক (পরবর্তীতে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়)। তিনি সর্বধর্মের মানুষের সেবা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলেই অমুসলিমগণ তাঁকে আজীবন রাষ্ট্রনায়ক নিয়োগ করেছিলেন।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর অনেক অত্যাচার , অবিচার হয়েছে, তবু তিনি কোনদিন গালি দেননি, অভিশাপ দেননি, প্রতিশোধ নেননি, কাউকে আঘাত করেননি, কারো বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেননি, ক্ষতি সাধন করেননি, শুধু উচ্চারণ করেছেন, ‘আল্লাহুম্মা ইহদি কাউমি ফাইন্নাহুম লা ইয়ালামুন’। অর্থাৎ হে আল্লাহ তুমি তাদের হিদায়ত কর, তারা আমাকে বুঝেনি।
হযরত ওমর ফারুক (রা.)’র রক্ষী ছিলেন ইয়ারফা নামক এক খৃস্টান ধর্মাবলম্বী। তিনি বলেছেন, আমিরুল মোমেনিন আমাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করতেন কিন্তু সামান্যতম জোর করেননি। এই হলো ইসলামের সৌন্দর্য। আমরা তাঁদের স্মরণ করি কিন্তু অনুসরণ করতে পারি না। তাই মুসলমানদের আজ এত অধগতি।
লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক
