অনেকটা আকস্মিকভাবেই ব্যাঙ্গালোর যাবার আয়োজন। দীর্ঘ ১৫ দিনের ভিসা প্রাপ্তির জটিলতা কাটিয়ে অবশেষে ভিসা হাতে পেলাম। প্রথমবারের মতো বিদেশ ভ্রমণ তাও আবার বিমান জার্নিতেই সব মিলে কৌতূহল চূড়ান্তে ভর করছে। ভিসা পাওয়ার দিনেই দেরি না করে ট্রাভেল এজেন্সীতে ঢুঁ মারলাম বিমান টিকেটের জন্য। কারণ অভিজ্ঞদের কাছ থেকে শুনা ছিল বিমান ভাড়া ফিক্সড থাকে না, আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার ফলে এটা উঠানামা করে, তাছাড়া আগে বিমান টিকেট বুকড করা গেলে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় টিকেট পাওয়া সম্ভব। কয়েকটা এজেন্সী যাচাই করে আল হেরা ট্রাভেলস থেকে কাটলাম চট্টগ্রাম টু ঢাকা রিজেন্ট এয়ারওয়েজ এবং কলকাতা টু ব্যাঙ্গালোর জেট এয়ারওয়েজের টিকেট। ফ্লাইটের দিন এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। মামা, খালু এবং অন্যান্য আত্মীয় স্বজন প্রবাসী হওয়ার কারণে বিভিন্ন সময় এয়ারপোর্টে আসা হলেও বিমানের যাত্রী হিসেবে এই প্রথম! যে বিমান এক নজরে দেখার জন্য টিকেট কেটে উপরে গ্যালারীতে উঠেছিলাম সে বিমানে চেপে একটু পর আকাশে উড়বো ভাবতেই অন্যরকম লাগেছে।
কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লাম। ঘন্টাখানেকের আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে শেষ হলো ইমিগ্রেশন ও বোডিং পাস। এরপর সোজা বিমানে উঠে আমার নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসলাম। ঠিক ১০ মিনিট পর বিমানের চাকা ঘুরতে শুরু করলো, প্রথম গাড়ীর মতো টান দিয়ে দ্রুত বেগে ছুড়তে লাগলো। বুঝতে পারছিলাম এই বুঝি উড়াল দিবে। যেই ভাবা সেই। বিমানের সামনের অংশ হালকা উর্ধ্বমুখী হয়ে উপরের দিকে উঠা শুরু করলো। উঠার সাথে সাথে বিমান তার চাকা গুটিয়ে মেলে দিলো তার দৈত্যাকার পাখনা দু’টি! আমার আসন জানালার পাশে হওয়াতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম চিরচেনা শহরটি আকাশ সীমানা থেকে। বিমান উপরে উঠার সমানুপাতিকহারে ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতর হতে লাগলো গোটা শহর। দৃষ্টির সীমানায় খেলা করছে সাগর-নদী-শুভ্র মেঘের মিতালি। একটু পর বিমানবালা নাস্তার প্যাকেট দিয়ে গেলো। ঠিক ৪৫ মিনিট পর পৌঁছলাম কলকাতা এয়ারপোর্টে।
কলকাতা টু ব্যাঙ্গালোর কানেকটিং ফ্লাইট সন্ধ্যা ৬টায়। জেট এয়ারওয়েজের বিমানের জন্য দুই ঘন্টা অপেক্ষার পালা। দেখা হয়ে গেলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টির শ্রদ্ধেয় স্যার প্রফেসর শেখ সিরাজুল ইসলাম স্যারের সাথে। কথাবার্তা বলতে বলতে সময় হয়ে গেলো পরবর্তী ফ্লাইটের। যথারীতি বোডিং পাস কমপ্লিট করে বিমানে উঠলাম। যাওয়ার পথে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছানোর ঠিক ঘন্টাখানেক আগে বিমানে টেকনিক্যাল ত্রুটি দেখা গেল। হায়দারবাদ এয়ারপোর্টে এমার্জেন্সি ল্যান্ডিং এর ঘোষণা আসার সাথে সাথে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। আল্লাহর নাম নিতে নিতে অবশেষে বিমান নিরাপদে মাটি স্পর্শ করলো। হায়দারাবাদে তখন সময় প্রায় ৯ টা। বিমান অথরিটি ১১ টার মধ্যে আরেকটা ফ্লাইট ম্যানেজ করে দেয়ার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয় নি। সকল যাত্রীদের পার্শ্ববর্তী হোটেলে রাতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করলো তারা। আমার পাশের সীটের যাত্রী ছিলেন এক ইন্ডিয়ান নাম শীষ, তাঁর বাড়ি ব্যাঙ্গালরে। তিনি সহ আমরা মোট ৬ জন উঠলাম হোটেল হায়দারাবাদ গ্রান্ডে। পরদিন ভোর ৫ টার ফ্লাইটে হায়দারাবাদ থেকে গন্তব্য ব্যাঙ্গালোর এয়ারপোর্ট।
কয়েক দিন আগে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছলেন ফটিকছড়ির ডাক্তার হামেদ ভাই। উনার সাথে আগে থেকে কন্টাক্ট করাতে উনি হোটেল ড্রীম লজে রুম বুকিং দিয়ে রাখছিলেন এবং এয়ারপোর্ট থেকে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি ক্যাব পাঠিয়ে দিলেন। সকাল ৯ টায় হোটেলে গিয়ে পোঁছলাম। সপ্তাহখানেক ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত ছিলাম। আব্বুর ট্রীটমেন্ট চলছিল বম্মাসন্দ্রা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল এরিয়ায় অবস্থিত নারায়ণা হসপিটালে। প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে বের হলাম ব্যাঙ্গালোর শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে। ইচ্ছে ছিল মাইসোরে অবস্থিত টিপু সুলতানের প্রাসাদে যাবো কিন্তু দীর্ঘ জার্নি ও সময় স্বল্পতার কারণে কেন্সেল করতে হলো।
ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার বুকে কর্ণাটকের রাজধানী বেঙ্গালুরু। ১৬ শতকে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধিপতি কেম্পেগৌড়ার হাতে পত্তন হয় বান্দা-কালোরু বা সেদ্ধ-বিনের শহর। কালে কালে বান্দাকালোরু হয় বেঙ্গালুরু। পরবর্তীসময়ে হায়দার আলি-টিপু সুলতানের হাত ঘুরে ব্রিটিশদের হাতে যায় এই শহর। ব্রিটিশদের দেওয়া ব্যাঙ্গালোর (Bangalore) আবার এখন পূর্বনামে ফিরেছে। ‘গার্ডেন সিটি’ নামে খ্যাত এই শহর এখন তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের জন্যও বিখ্যাত। শহরের সাজসজ্জা, জীবনধারার মানও তাই বেশ উন্নত।
শহরের প্রধান আকর্ষণ বিশাল কুব্বন পার্ককে ঘিরে বিধানসৌধ, হাইকোর্ট, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, অ্যাকোরিয়াম, সরকারি মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালারি এবং বিশ্বেশ্বরাইয়া শিল্প ও কারিগরি মিউজিয়াম। বিলেতের উইন্ডসর প্যালেসের অনুকরণে তৈরি ব্যাঙ্গালোর প্রাসাদটিও দর্শনীয়।
শহরের দক্ষিণে আছে দ্রাবিড়শৈলীতে তৈরি নন্দীর মন্দির বুল টেম্পল (Bull Temple)। গ্র্যানাইট পাথর কুঁদে তৈরি নন্দী মূর্তিটিও নান্দনিক। শহরের দক্ষিণভাগে আরেক দর্শনীয় স্থান লালবাগ বোটানিক্যাল গার্ডেন। সিটি মার্কেটের দক্ষিণে টিপু সুলতানের দুর্গ ও প্রাসাদ। বেঙ্গালুরু থেকে মহীশূরের পথে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে নন্দী হিলসের ওপরে টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ, নিচে চালুক্য রাজাদের আমলের নন্দীমন্দির পর্যটকদের মূল আকর্ষণ।
ব্যাঙ্গালোর শহরের ছয়টা দর্শনীয় স্পট ঘুরার জন্য টেক্সী নিলাম। সুবিধা হল ড্রাইভার ইংলিশ বুঝে ও মোটামুটি বলতে পারে। বম্মাসন্দ্রা থেকে ব্যাঙ্গালোর সিটি অর্থাত মেজেস্ট্রিক সিটি দেড়/দু’ঘন্টার পথ, দুরত্বে ৭০/৮০ কিলোমিটার। যাওয়ার পথে পড়লো লাল বোটানিক্যাল গার্ডেন। টিপু সুলতানের পিতা হায়দার আলী খান প্রায় ২০০ বছর আগে এ পার্ক প্রতিষ্ঠা করেন। হেঁটে এ পার্ক ঘুরতে গেলে দুই/তিন ঘন্টা অনায়াসে লেগে যাবে। তাই ১০/১২ সিটের বিশেষ ছোট কারে করে গোটা পার্ক ঘুরে দেখানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কারটির ড্রাইভার গাইডের ভুমিকা পালন করেন। যেতে যেতে হিন্দিতে সে আশে পাশের সবকিছুর বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিজন ১০০ টাকার টিকেট কেটে এই গাড়িতে উঠতে হয়। ঢুকামাত্র বিশাল পাথরের পাহাড় যেন সাদরে সম্ভাষণ জানাচ্ছে পর্যটকদের। সাদা রঙের পাথরের পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়ালে ব্যাঙ্গালোর শহরের প্রায় ২০% দেখা যায়। বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন গাছ থেকে শুরু করে সহস্রাধিক বিরল প্রজাতির গাছ রয়েছে। কৃত্রিমভাবে বিভিন্ন গাছকে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রানীর আকৃতি। রয়েছে বিশাল লেক, চারপাশে সবুজবৃক্ষের মহা সমারোহ। শীষমহল, মাটির সাথে লাগানো বিশাল ঘড়ি, রোজ গার্ডেন, ব্যান্ড স্পট, প্রাণী মূর্তি, মাটির সুউচ্চ ভাস্কর্য, পানির ফোয়ারা প্রভৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গার্ডেনের আনাচে কানাচে। (চলবে)