আরকানুল ইসলামের গল্প ‘টস’

আমার যে বিরানি পছন্দ তা ও বেশ জানে। তাই হঠাৎ দু’প্যাকেট বিরানি নিয়ে হাজির ও! আমি তো হতবাক! কিছু না-বলেই নিয়ে এলো। আসার আগে কল দিয়ে বলল, আপনি কই? আমি আমার অবস্থান জানালে সে বলল, ওখানেই থাকুন, আমি আসছি।

 

ও আমাকে আপনি ক’রেই সম্বোধন করে। আমারও ভালো লাগে এই ‘আপনি’ ডাক। ও আমাকে আপনি করে ডাকার আরও একটা সুবিধা হচ্ছে, আপনি করে ডাকা ব্যক্তিদের ওপর কোনো সময় ঠিকঠাক মতো গরম হওয়া যায় না। মানে, তুমি, তুই বললে যেরকম রাগ দেখাতে পারে আপনিতে সেই সুযোগ কম। এই সুযোগটা আমি নিই, তাই তাকে কোনোদিন বলিনি যে, তুমিও আমাকে তুমি করে ডেকো!

 

আমাকে ফোন করার বিশ মিনিটের মধ্যে সে হাজির। এমনিতে মেয়েরা যা স্লো, সে হিসেবে ও দ্রুতই এসেছে। বিরানির প্যাকেট হাতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, বিরানি নিয়ে কই যাবা?

– কই যাব মানে? আমরা খাবো, আমাদের জন্য! আপনি খাবেন না?

– খাবো না তো বলিনি!

– তাহলে এত কথা বলছেন কেন? আপনি যে বিরানিপাগল সে আমি বেশ জানি। দুপুর হয়ে গেল তো, তাই ভাবলাম, খেয়ে নিই।

আমিও বিরানি দেখে আর কথা বাড়ালাম না। বিরানি জিনিসটা আমার কাছে এত প্রিয় যে, কেউ যদি একসাথে একটা পারফিউম ও এক প্যাকেট বিরানি থেকে যেকোনো একটা বেছে নিতে বলে তো আমি ডানহাতে বিরানির প্যাকেটটাই নেব।

 

আমি যেখানে ছিলাম তার পাশেই ছোট্ট একটা পার্ক। লোকজন তেমন নেই। এই ভরদুপুরে ক্লান্ত কয়েকজন ফেরিঅলা, দুটো বুড়ো আর কিছু টোকাই ছাড়া বলতে গেলে আর কেউ নেই। অবশ্য কয়েকটা কাক আছে, কা কা করছে।

আমরা বড় একটা গাছের ছায়ায় গিয়ে বসলাম। বসার পর দেখে নিলাম উপরে কোনো কাক-টাক আছে কি-না, যদি খাওয়ার মাঝখানে আবার ইয়ে-টিয়ে করে বসে!

বসতে-বসতে তাকে বললাম, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে!

– এতক্ষণে মনে হলো সেটা?

– না, আরো আগেই বলতে চেয়েছি, কিন্তু অন্য কথাগুলো বলতে-বলতে আর বলা হয়ে উঠল না।

 

সে ‘থেঙ্কস্’ বলে বিরানির প্যাকেট খোলায় ব্যস্ত হয়ে উঠল। প্যাকেট খোলার সময় ঠোঁটে ঠোঁটে চাপ পড়াতে ওর গালের টোলটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে! ভারি সুন্দর লাগে তখন। আমি তার দিকে চে’য়ে আছি। সে বলল, কী দেখছেন অমন করে?

– তোমাকে দেখছি, তোমার টোল দেখছি!

– অমন করে টোল দেখলে টোল দেখার ওপর ‘টোল’ বসাব কিন্তু! বলেই নিজে-নিজে হেসে দিলো। হাসলে তাকে আরও দারুণ লাগে, আরও ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। ওর হাসিতে যেন আমার ভালোবাসার কোষগুলো অনুরণন হতে থাকে!

 

ও বলতে গেলে একেবারে ফর্সা। আজ প’রেছে হালকা গোলাপি রঙের থ্রি-পিস। পায়ে বেল্ট লাগানো সাদা হিল। ফর্সা মেয়েদের এই হিলে বেশ মানায়, ঠোঁটে লিপস্টিক দিলে যেমন আঁকড়ে ধরে তেমনি এই হিলও তার গোড়ালিকে কামড়ে আছে!

ফর্সা মেয়েদের দুটো সময় খুব সুন্দর ও নিষ্পাপ মনে হয়। এক, যখন তারা লজ্জায় অবনত হয় তখন। দুই, যখন তারা ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে আসে বা গোসল সেরে আসে। অবশ্য পুরোটা নির্ভর করে তাদের শ্রী’র ওপর। কারণ, ফর্সা মানেই সুন্দর- এমনটা আমি মনে করি না।

ততক্ষণে ও প্যাকেট দুটো খুলে একটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। তার পর ওর ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে হাত ধুইয়ে দিলো। আমি আশেপাশে তাকালাম কেউ আমাদের দিকে তাকাচ্ছে কি না। না, সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত।

ও এতক্ষণ এতকিছু করছে দেখে আমি প্রথমে ওকে খাইয়ে দিলাম, সে হা করে গালে পুরতে পুরতে বলল, থেঙ্কস্।

 

আমি তাকে বললাম, এখন এত কেয়ার করছ, বিয়ের পরও করবে তো?

– না, করব না!

– কেন?

বিয়ের পর আপনি করবেন কেয়ার, তার জন্য আমি বিয়ের আগে কেয়ার করছি!– বলেই সে হাসল, হাসিতে যোগ দিলাম আমিও।

ওর হাসি দেখলে আমি আর ঠিক থাকতে পারি না, কেমন যেন হয়ে যাই। ও খাচ্ছে আর আমি ওর দিকে চে’য়ে আছি। খাওয়ার সময় ওর দুই ঠোঁটে যতবারই চাপ পড়ে ততবারই টোল বেরিয়ে আসছে, আমি খাওয়া বন্ধ করে ওর টোল দেখা শুরু করছি। এমন সময় তিন-চারটা ছেলে আমাদের দিকে আসতে দেখে ও বলল, দেখেন তো, ওরা এদিকে আসছে কেন?

আমি প্যাকেটটা হাত থেকে রেখে ওকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে গেলাম। কাছাকাছি আসতেই ওদের একজন দ্রুত পেছন ফিরে চলে গেল। বাকি তিনজন এসে বলল, বাহ, খুব আনন্দে আছেন দেখছি! বাইরে বসে বিরানি খাচ্ছেন!

আমি তার কথার জবাব দিলাম না।

সে বলল, মোবাইল, মানিব্যাগ যা আছে দিন, আমাদেরও বিরানি খেতে হবে!

– কেন? তোমাদের দেবো কেন? দেখে তো স্টুডেন্ট মনে হচ্ছে!

– স্টুডেন্টই তো, বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র! বলে ওদের আরেকজন হো হো করে হেসে উঠল।

আমার বাহু আঁকড়ে ধরে আড়াল হয়ে আছে ও। আমি তাদের বললাম, বিরানি খাবে তো টাকা নাও, মানিব্যাগ-মোবাইল কেন?

– ওগুলো বেচেই তো বিরানি খাবো, শুধু বিরানি খেলে হবে? টিরানিও যে খেতে হবে!

ওর কথায় বাকি সঙ্গি দুজন হো হো করে হেসে উঠল। হাসি থামার আগেই ওদের একজনের মোবাইলে কল এলো, মিনিটখানেক কথা বলে ফোন রেখে বলল, থাক। বিরানি খাওয়াতে হবে না, যাচ্ছি।

আমি বললাম, বিরানি খাওয়ার টাকাটা নিয়ে যাও…

তারা উত্তর দেওয়ার সময় পেল না, দ্রুত প্রস্থান করল।

 

ওরে চলে গেলে বাকি খাবার না-খেয়ে আমরা উঠে দাঁড়াই। হাত ধুয়ে ফ্রেস হয়ে ও বলল, ওরা এভাবে চলে গেল কেন?

– আমার মনে হয় অাগে চলে যাওয়া ছেলেটা ফোন করেছে চলে যাওয়ার জন্য। সে মনে হয় আমাকে চেনে, তাই দূর থেকে দেখে চলে গিয়ে এদের ফোন করেছে চলে যাবার জন্য!

– আপনি কি তাকে চেনেন?

– দূর থেকে দেখে বুঝতে পারিনি, তবে আমার কোনো স্টুডেন্ট হয়ে থাকতে পারে! যাকে সন্দেহ হচ্ছে খোঁজ নিলে জানতে পারব।

– আপনার স্টুডেন্ট? এত পচা স্টুডেন্ট?

– পচা কেন? ভালোই তো!

– মানে?

– মানে, ভালো স্টুডেন্ট বলেই আমাদের কাছ থেকে কিছু না-নিয়ে চলে গেল আবার সঙ্গিদেরও নিষেধ করে দিলো! ভালো না!

– আপনি পারেনও বটে! আপনার লেখালেখি করা দরকার ছিল।

– আমার বই কে পড়বে? আজকাল অনেক নামকরা লেখক পর্যন্ত নিজের খরচে বই প্রকাশ করছে! আমার বই বের করলে অবশ্য বাদামঅলারা খুব খুশি হবে!

– কেন?

– কারণ, ওরা কেজি দরে বইগুলো প্রকাশকের কাছ থেকে কিনে নিতে পারবে, সস্তায়!

এবার ওর হাসি আরও বেড়ে গেল। ও বলল, শুনেছি এবারের বইমেলায় কোন লেখকের নাকি তেষট্টিটা বই প্রকাশ হয়েছে! সত্যি নাকি?

আমি বললাম, হতে পারে, আমিও শুনেছি সেরকম।

– তাহলে তো সে লেখকদের ইমাম!

– বই বের করলেই কি ইমাম হয়ে যাবে? মুসল্লি কয়জন আছে দেখতে হবে না? থাকলেও তারা আদৌ কাতার ধরে কি না সেটাও তো দেখায় বিষয়!

আমার কথা শুনে সে আবার হাসতে লাগল। এতক্ষণে আমাদের বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারত, অথচ আমরা হাসছি!

ও বলল, আপনি এরকম স্টুডেন্ট পড়াতেন?

– এটা তো আমার দোষ না, ওদের পরিবারের দোষ, অভিভাবকদের দোষ। ওরা ওদের ছেলের খবর রাখে না বলেই এভাবে বখে যাচ্ছে। আমি পড়াতাম মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টা, বাকি সময়টুকুতে তো আমি পাহারা দিয়ে রাখিনি!

– তা অবশ্য ঠিক।

চলো যাই বলে দুজনেই সামনে হাঁটা দিলাম।

 

তিনদিন পর ওর কল এলো। এই তিনদিনে আমাদের কোনো যোগাযোগ হয়নি। ও কল দিয়ে বলল, জরুরি কথা আছে, ফ্রি আছেন?

– তোমার জন্য সবসময় ফ্রি, বলো…

– একটা কাণ্ড ঘটে গেছে। বড় মামা আমার জন্য পাত্র ঠিক করে ফেলেছেন, এমনকি তাকে বাসায় পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। অথচ বাসায় আনার আগে কাউকে কিছু জানায়নি পর্যন্ত।

– তো, তোমার পছন্দ হয়েছে?

-হ্যাঁ, খুব পছন্দ, ঠিক আপনার মতোই।

ও একথা বলার সাথে সাথে আমার কণ্ঠ ছোট হয়ে আসতে থাকে, যদিও তাকে বুঝতে দিচ্ছি না। ওর সাথে আমার দীর্ঘ আট বছরের প্রেম। প্রথম পাঁচ বছর শুধু দূর থেকে দেখেই গেছি। সে-ও দেখত, আমিও দেখতাম। কেমন আছ, ভালো আছি ছাড়া তেমন কথা হতো না। এভাবে পাঁচটি বছর কেটে গেল। ও তখন ক্লাস সিক্সে পড়ত। পাঁচ বছর পর একদিন তাকে মনের কথাটা বলে ফেললাম। জানতাম, সে এগ্রি করবে। পাঁচবছর একটা মানুষকে ফলো করে গেলে এমনিতেই একটা আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়ে যায়, আমাদের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

 

ও যখন ইন্টারমিডিয়েটে তখন থেকে নিয়মিত দেখা করি, কথা বলি। এখনো সেটা বজায় আছে। আজকের আগ পর্যন্ত তাকে বিয়ে দিতে চায় বা তার জন্য বিয়ের অফার আসছে এমন কোনো কথা সে বলেনি। আজ এমন কথা বলাতে আমার বুক ধুক করে উঠল। সেটা সামলে নিয়ে বললাম, তো, বিয়ে কবে তোমাদের?

– এত সিরিয়াস হচ্ছেন কেন? জানি, রাগে ভেতরে-ভেতরে জ্বলছেন!

– জ্বলবই তো!

– শোনেন, ওকে দেখার পর থেকে কম্পেয়ার করে যাচ্ছি দুজনকে।

– রেজাল্ট কী পেলে?

– রেজাল্ট পাচ্ছি না বলেই তো আপনাকে কল দিলাম।

– তো, এর সমাধান কি আমার কাছে আছে? সমাধান তো তোমার হাতে!

– রেগে কথা বলছেন কেন? আমি কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারছি। আপনি রাগছেন, রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেও পারছেন না। শুনুন, আগে রাগ থামান, শান্ত হোন। একটা আইডিয়া বের করুন।

– আমার কোনো আইডিয়া আসবে না এখন।

– জানি তো, রাগলে কারোরই ভালো কোনো আইডিয়া আসার কথা না। আমি আধাঘণ্টা পরে কল দিচ্ছি।

 

আধাঘণ্টা পরে সে কল দিলে রিসিভ করলাম। সে বলল, কোনো আইডিয়া এসেছে?

– না, তোমার কী আইডিয়া এসেছে বলো।

– আমি এর মধ্য ওর সাথে কথা বলেছি। তাকে আপনার কথা বলেছি, আমাদের রিলেশনের কথা বলেছি। সব শুনে সে বলল, আমরা তিনজনে মিলে কোথাও বসে ঠিক করার জন্য।

তাকে বললাম, এক কাজ করো, দুজনকে যেহেতু সমান ভালো লাগে তো, একসাথে দুজনকে বিয়ে করে ফেলো!

আমার কথা শুনে সে হাসতে-হাসতে বলল, বিকেল পাঁচটার সময় “জুম রেস্টুরেন্টে” আসুন, ওকেও আসতে বলি। সব কথা ওখানে হবে।

 

আমি ঠিক পাঁচটায় রেস্টুরেন্টে পৌঁছে যাই। মিনিট দশেকের মধ্যে তারাও এসে পৌঁছে। জানলাম, ছেলেটার নাম মিশুক, একটা হাসপাতালে চাকরি। পরিচয়ের পর কুশল শেষে কথা শুরু হয়। মিশুক বলল, ভাইয়া, ও আমাকে সব বলেছে। আমারও ওকে খুব পছন্দ, ওরও আমাকে পছন্দ হয়েছে। আবার আপনাকেও ওর সমান পছন্দ। আমি জানি না আমাকে আপনার কেমন লাগছে, কিন্তু দেখামাত্রই আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। বিষয়টা এমন পর্যায়ে আছে যে ডিসিশন নেওয়াটাও জটিল!

আমি চুপ মেরে আছি, সে-ও চুপ মেরে আছে। মিশুক বলল, ভাইয়া, এক কাজ করলে কেমন হয়?

– কী? আগ্রহ দেখিয়ে বললাম।

– টস করি। যে জিতবে সে-ই ওকে বিয়ে করবে।

– টস দিয়ে সারাজীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারণ? একটু ছেলেমানুষী হয়ে যায় না?

– কী করবেন ভাইয়া? আর তো উপায় দেখছি না। তবে, আমাদের দুজনকে যেহেতু ওর সমান পছন্দ তাহলে টস করতে তো সমস্যা নেই!

ঠিক আছে, টস করি- বলে সে পকেটে হাত দিলো। না, অনেক খুঁজেও কোনো কয়েন পেল না টসের জন্য। আমি আমার পকেট হাতালাম, আমার পকেটেও কোনো কয়েন নেই। ও ওর পার্সে খুঁজে দেখল। না, তাতেও নেই। সবাই একটু অবাকই হলাম বটে।

আমি ক্যাশে গিয়ে একটা কয়েন চাইলাম। তারা বলল, তাদের কাছে কোনো কয়েন নেই। টেবিলে এসে বসতে যাব এমন সময় আরেক টেবিলের একটা মেয়ে বলল, এক্সকিউজ মি ভাইয়া, এই নিন, আমার কাছে একটা দু’টাকার কয়েন আছে। তাকে থেঙ্কস্ জানিয়ে সেটা নিয়ে টেবিলে এসে বসলাম। কয়েনটা ওর হাতে দিয়ে বললাম, নাও, তোমার ভাগ্য তুমি নির্ধারণ করো।

সে কয়েনটা হাতে নিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলের মাথায় রেখে উপরের দিকে ছুঁড়ে মারল, ততক্ষণে আমি বললাম, শাপলা, মিশুক বলল, সবার জন্য শিক্ষা। ও কয়েনটা এত জোরে উপরে ছুঁড়ল যে সেটা একটা ঝাড়বাতির ভেতরে আটকা পড়ে গেল, পাশ থেকে কয়েন দেওয়া মেয়েটি ফিক করে হেসে উঠল!

আমরা হতবাক হয়ে চারটা চোখের দিকে পরস্পরের চোখ মিলাতে লাগলাম।

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *