আরকানুল ইসলামের গল্প ‘জ্যোতি’

জ্যোতি

 

জন্মের দু’বছরের মাথায় যে এমন বিপদ নেমে আসবে জ্যোতির জীবনে সেকথা কে জানত? জ্যোতির বাবা-মা, চাচা-খালা নাকি পাড়া-প্রতিবেশি? কেউ জানত না। অথচ কত সুন্দরভাবেই না বেড়ে উঠছিল শিশুগাছের মতো! আজ এরকম তো কাল ওরকম, পরশু সেরকম।

 

ঘর আলো করেই এসেছিল জ্যোতি। বাবা-মা’র প্রথম সন্তান হয়ে সত্যি আলোকিত করেছিল জ্যোতি। ফজরের আলো ফোটার শুভক্ষণে তার জন্ম হয়। যদিও তার বাবা-মা’র এমন কোনো সামর্থ্য ছিল না যে তার জন্মের পর সোনার চামচ মুখে দিয়ে মধু পান করাবে। না-ছিল ছাগল জবাই করে আকিকার আয়োজন, না-ছিল ঘরে-ঘরে মিষ্টি পাঠানোর সামর্থ্য। তবুও খুশিতে জ্যোতির বাবা এতিম-মিসকিন ডেকে সামর্থ্যানুযায়ী একদিন দুপুরবেলা ভরপেটে খাইয়েছে। জ্যোতির বাবা জানত, বড়লোকদের জন্য বিশাল আয়োজন ক’রে খুশি করা যতটা কঠিন তারচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে মিসকিন খাওয়ানো। তারা একথা-ওকথা বলবে না, খেয়ে মন থেকে দোঅা করবে জ্যোতির জন্য, জ্যোতির বাবা-মা’র জন্য।

 

জ্যোতির জন্মের পর থেকে মধ্যে নানা রকম প্রতিভার লক্ষণ দেখতে পায় তার বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশি। খুব অল্প সময়ে স্পষ্টভাবে কথা বলতে শিখেছে, কোনো কথা একবার শুনলেই দ্রুত শিখে যাচ্ছে, দ্রুত জবাব দিচ্ছে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দেওয়ার পাশাপাশি হাতে ইশারা দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। মাত্র নয় মাস বয়সেই এসব লক্ষণ দেখে জ্যোতির বাবা-মা তো মহাখুশি। নিজেরা পড়ালেখা না-করলেও তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে, যেকোনোভাবে মেয়েকে পড়ালেখা করাবে, উচ্চশিক্ষায় সুশিক্ষিত করবে। কিন্তু সেই খুশি বেশিদিন স্থির হয়নি, দু’বছরের মাথায় বেদনায় রূপ নেয়।

 

একদিন দুপুরবেলা হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ পড়ে যায় জ্যোতি। তার মা দৌড়ে এসে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে থাকে। মায়ের মনে হলো জ্যোতির চঞ্চলতা যেন কমে এলো। প্রতিদিন কোলে নিলে যে জ্যোতির অনুভূতি পায় আজ সেরকম মনে হলো না। এই অনুভূতি মায়ের চেয়ে বেশি বোঝে এমন কেউ পৃথিবীতে নেই। মা জিজ্ঞেস করল, জ্যোতি মা, তোর কী হলো? খারাপ লাগছে?

– হুম, কেমন জানি লাগছে!

– কোথায়?

– গলা ও পেটে!

জ্যোতির গলা ও পেট ধরে দেখল মা। একটু গরম মনে হলো। মনে হলো গায়ে হালকা জ্বর আসছে। তাই মা জ্বরের ওষুধ খাইয়ে দিলো তাকে। এভাবে সপ্তাহখানেক যাওয়ার পর জ্যোতি অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করলে জ্যোতির বাবাকে অবহিত করল। বাবা বলল, জ্বরের ওষুধ খাওয়াও, সেরে উঠবে।

– কী বলো! এক সপ্তাহ ধরে ওষুধ খাওয়ালাম, কিছুর কিছুই তো হলো না, আমার ভয় করছে। উপজেলা সদরে ডাক্তারখানায় নিয়ে গেলে হয় না?

– উপজেলায় নিয়ে ডাক্তার দেখানোর মতো টাকা আমার কাছে নেই, তোমার থাকলে তুমি যাও! একপ্রকার বিরক্তির সুরে বলল জ্যোতির বাবা।

জ্যোতির মা বলল, আমার হাতে অল্প কিছু টাকা আছে, এই টাকা দিয়ে সদরের একজন ডাক্তার দেখাও, লক্ষণ কিছুতেই ভালো ঠেকছে না আমার। একটা মাত্র মেয়ে আমার!

“একটা মাত্র মেয়ে আমার”- কথাটা শুনে জ্যোতির বাবারও যেন মায়ায় টান পড়ল। মেয়েকে কোলে নিয়ে বলল, তুমি রেডি হও, এক্ষুণি মেয়েকে নিয়ে সদরে যাব। জ্যোতির বাবার হঠাৎ এমন পরিবর্তনে জ্যোতির মায়ের চোখ ছলছল করে উঠল।

 

উপজেলা সদরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর সিরিয়াল পেতে অনেক কষ্ট হয়। আগে কোনো সময় আসেনি বলে কীভাবে কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না জ্যোতির বাবা। চৌদ্দ-পনেরো বছরের এক মেয়েকে দেখে জ্যোতির বাবা বলল, মা, আমার মেয়েটা খুব অসুস্থ। এখানে আগে কোনোদিন আসিনি, তাই কী করতে হবে, কোথায় যেতে হবে বুঝতে পারছি না, তুমি একটু সাহায্য করবে?

মেয়েটি হেসে বলল, আপনারা একটু দাঁড়ান, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

একটু পরেই ফিরে এসে মেয়েটি জ্যোতির বাবা-মাসহ ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকল।

জ্যোতিকে দেখে ডাক্তার বললেন,  মেয়ের যে অসুখ আপনারা জানতেন না?

– জানতাম। গত ক’দিন ধরে পেটব্যথা, গলাব্যথা বলছিল। আর গায়ে জ্বর ছিল বলে জ্বরের ওষুধ খাইয়েছি। জ্যোতির মা বলল।

– শুধু জ্বরের ওষুধ খাওয়ালে হবে? লক্ষণ দেখে তো মনে হচ্ছে এই মেয়ের টাইফয়েড হয়েছে!

– কী বলেন! অবাক হয়ে বলল জ্যোতির মা। পাশে জ্যোতির বাবা হতাশা নিয়ে বসে আছে।

– হুম, টাইফয়েডের মতোই মনে হচ্ছে। দুটো রক্তপরীক্ষা দিচ্ছি, রিপোর্ট এলে বুঝতে পারব।

ডাক্তারের কক্ষ থেকে বের হয়ে জ্যোতিকে নিয়ে রক্তপরীক্ষার জন্য নিয়ে গেল, সাথে থাকা মেয়েটি সবকিছু দেখিয়ে দিয়ে বলল, কাল এসে রিপোর্টটি নিয়ে ডাক্তার সাহেবকে দেখাবেন। তিনি সব বলবেন।

জ্যোতির বাবা বলল, মা, কাল কি আবার টাকা নেবে?

মেয়েটি হেসে বলল, না, নেবে না। অনেক ডাক্তার রিপোর্ট দেখার জন্যও টাকা নেন, ইনি নেন না, ভালো ডাক্তার।

জ্যোতির মা মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, তুমিও অনেক ভালো মেয়ে, তুমি না-থাকলে আমাদের অনেক কষ্ট হতো।

মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়াতে মেয়েটি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল।

পরদিন রিপোর্ট আনার জন্য উপজেলা সদরে গেল জ্যোতির বাবা। রিপোর্ট দেখার পর ডাক্তার বললেন, কাল যেটা ধারণা করেছিলাম সেটাই। আপনার মেয়ের শরীরে টাইফয়েড ধরা পড়েছে।

এখন থেকে আপনার মেয়ের সবসময় পরিষ্কার পোশাক পরতে হবে। নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি পান করাবেন, অবশ্যই হাত ভালোভাবে ধুয়ে নেবেন। ঘরের জিনিসপত্র নিয়মিত পরিষ্কার রাখবেন এবং আপনার মেয়ের ব্যবহৃত জিনিসপত্র আলাদা করে রাখবেন।

– জি আচ্ছা। জ্যোতির বাবা বাধ্য ছেলের মতো করে বলল।

– পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে। খাবার গরম করে খেতে হবে। বাইরের কোনো খাবার খাওয়াবেন না। অপরিষ্কার শাক-সবজি ও কাঁচা-ফলমূল খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। আর যা ওষুধ দিয়ে তা নিয়মিত খাওয়াবেন।

– হ্যাঁ, তা-ই করব।

– টয়লেট পরিষ্কার আছে? পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করতে হবে। লক্ষ রাখবেন কোনোভাবেই যেন টয়লেটে ময়লা বা পানি জমে না থাকে।

– গরিবের টয়লেট, পরিষ্কার-অপরিষ্কার আবার কী! তবু গিয়ে সাফ করে ফেলব।

ডাক্তার বললেন, এবার যান। মেয়ের প্রতি যত্ন নিন।

জ্যোতির বাবা বের এলো।

 

ঘরে ফিরতেই জ্যোতির মা দৌড়ে এসে বলল, মেয়েটির গায়ে লালচে দাগ দেখা যাচ্ছে।

– হুম, ডাক্তারও তো তা-ই বলল। টাইফয়েড ধরা পড়েছে।

শুনে জ্যোতির মায়ের চেহারাটা আষাঢ়ের আকাশের মতো মলিন হয়ে গেল।

দুইদিন পর, সকালে ঘুম থেকে উঠে জ্যোতি মাকে ডাকতে লাগল। মা কাছে এলে জ্যোতি বলল, মা, সবকিছু ঝাপসা-ঝাপসা লাগছে কেন?

– ঘুম থেকে উঠলি তো মাত্র, তাই এমন মনে হচ্ছে।

– না, মা। আস্তে-আস্তে সব অন্ধকার লাগছে!

জ্যোতির মা খেয়াল করল, গতকালের জ্যোতির গায়ের লালচে দাগগুলো কালো হয়ে উঠেছে এবং ছড়িয়ে পড়েছে পুরো গায়ে! চোখের আশেপাশেও!

পুরো গায়ের এমন অবস্থা দেখে জ্যোতির মায়ের বুকটা কেঁপে উঠল। জ্যোতিকে কোলে নিয়ে পুরো গায়ে গরম পানির সেঁক দিলো।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত, রাত গড়িয়ে ভোর এলো কিন্তু জ্যোতির চোখের কোনো পরিবর্তন হলো না। এমন অবস্থা দেখে হু হু করে শব্দ করে কেঁদে দিলো জ্যোতির মা! অনেক্ষণ কাঁদল। জ্যোতির বাবা নির্বাক হয়ে গেল। এমন একটা ফুটফুটে চঞ্চল মেয়ে যে হঠাৎ জ্যোতিহীন হয়ে পড়বে তারা কল্পনাই ভাবেনি!

জ্যোতি সব বুঝতে পেরে মাকে বলল, আমি আর কোনোদিন পৃথিবীর অালো দেখব না, তাই না? তোমাকে দেখতে পাব না, বাবাকে দেখতে পাব না, কোনো কিছুই দেখতে পাব না, তাই না মা?

কথাগুলো শুনে জ্যোতির মায়ের সাথে জ্যোতির বাবাও কান্না আর ধরে রাখতে পারেনি। চোখের বাঁধ ভেঙ্গে দিলো নিমিষেই।

 

পৃথিবীর নিয়মে পৃথিবী চলে। কেউ কারো জন্য থেমে থাকে না। পৃথিবীর নিয়মকে মানিয়ে নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। তেমনি জ্যোতির জীবন এগিয়ে গেছে। দেখতে-দেখতে জ্যোতির বয়স যখন পাঁচ-এ পড়ল, সে স্কুলে যেতে চাইল। কারণ সে শিশু, ক্লাস ওয়ানের সব বই মুখস্থ করে ফেলেছে বহু আগেই। তার মুখস্থশক্তি দেখে অবাক না-হয়ে উপায় নেই। শুধু তা-ই নয়, সে তার মাকে গেরস্থালির কাজে নিত্য সহযোগিতা করে যায়, যেমনটি অন্য স্বাভাবিক মেয়েরা করে। অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, জ্যোতি নিজে নিজে চুলোয় আগুন জ্বালিয়ে ভাত রাঁধতে পারে! দূরের কেউ বেড়াতে এলে তার এমন সব কাজে হতবাক হয়ে যায়। একে তো চোখে দেখে না, তার ওপর বয়সও কম– মাত্র ছয় বছর!

 

জ্যোতির জোরাজুরিতে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো। সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়টা একটু দূরে ও প্রধান সড়ক পার হয়ে যেতে হয় বলে তাকে বাড়ির পাশের একটা এনজিওচালিত স্কুলে ভর্তি করানো হলো। প্রথম কিছুদিন তাকে তার মা, বাড়ির পাশের পরিচিতজন স্কুলে দিয়েও এলেও পরবর্তীতে কারো সাহায্য ছাড়া সে নিজে-নিজে স্কুলে যেতে থাকে। রাস্তায় গাড়ি আসার ব্যাপার দূর থেকে দ্রুত অনুধাবন করতে পারে।

প্রথম শ্রেনি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠার সময় ওর রোল নম্বর হয় ‘এক’। জ্যোতিহীন জ্যোতির সাফল্যে স্কুলের স্যারেরা তো খুশি, তার বাবা-মাও পুলকিত। অন্ধ হলেও তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে তারা বাবা-মাসহ স্কুলের শিক্ষকরা।

কিছুদিন আগে জ্যোতির এক খালা ওদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। কথায়-কথায় সে জ্যোতির মাকে বলল, এভাবে অন্ধ একটা মেয়েকে এভাবে ঘরে রেখে কী হবে? কোথাও অনাথ-আশ্রমে দিয়ে এসো, মাঝেমধ্যে গিয়ে দেখে আসবে আরকি!

কথাটা শুনে জ্যোতির মায়ের গায়ে জ্বালা ধরে গেল। একপ্রকার রেগে গিয়ে বলল, জ্যোতি আমার সন্তান, আমার নাড়ির সাথে নাড়ির সম্পর্ক। সে অন্ধ হোক, বোবা হোক, বধির হোক সে-ই আমার একমাত্র কলিজার টুকরা। তাকে অনাথ-আশ্রমে রেখে আসার কথা কীভাবে আমাকে বলতে পারলে? তুমি কি তোমার কোনো সন্তানকে এভাবে এতিমখানায় রেখে আসবে?

– আসলে আমি সেভাবে বলিনি। মেয়েটা চোখে দেখে না, তোমাদের কষ্ট হচ্ছে বলেই বলেছি। জ্যোতির খালা বলল।

– আমি কি কাউকে বলেছি, এই মেয়ের কারণে আমাদের কষ্ট হচ্ছে? অন্য ঘরের মেয়েরা যা করে না, করতে পারে না, তারও বেশি কাজ আমার মেয়ে আমাকে করে দিচ্ছে। আল্লাহ চোখের জ্যোতি নিয়ে গেলেও আমার মেয়ের প্রতিভার জ্যোতি, বুদ্ধির জ্যোতি তো কম দেয়নি!

খালা অবশ্য পরে আর কিছু বলেনি এব্যাপারে।

 

এনজিওচালিত স্কুল বলে মাঝেমধ্যে বিদেশিরা স্কুল পরিদর্শনে আসে। স্কুলে খবরাখবর নেয়, বাচ্চাদের সাথে দিনব্যাপী খেলাধূলায় অংশ নেয়, খেয়েদেয়ে দিনশেষে চলে যায়।

সেদিনও এরকম একটা বিদেশি পরিদর্শক টিম এসেছিল। পুরোটাই দিনটা বাচ্চাদের সাথে হেসে-খেলে আনন্দে কাটিয়েছে। এরই মধ্যে তারা জ্যোতির প্রতিভার খবর জেনেছে। তাদের টিমটা জ্যোতিকে অনেকক্ষণ সময় দিয়েছে, জ্যোতির সাথে কথা বলেছে। কথা বলতে গিয়ে জ্যোতির ব্যাপারে যখন তারা নিজেরা-নিজেরা ইংলিশে কথা বলছিল তখন জ্যোতি তাদের বলা ইংলিশ কথাটা হুবহু তুলে ধরে বলল, এটার মানে কী?

বিদেশি টিম তো হতবাক! একটুকুন একটা মেয়ের ধারণশক্তি এত প্রখর হয় কীভাবে?

তাদের মাঝে থাকা এক জাপানি জাপানি ভাষায় কথা বলা শুরু করলে জ্যোতি বলল, এটা কী ভাষা?

পাশের এক স্যার বলল, জাপানি ভাষা। তুমি পারবে নাকি বলতে?

হুম, পারব বলেই জ্যোতি লোকটি যা যা বলেছে সব উগরে দিলো। জাপানি লোকটার এবার বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে গেল। তারা জ্যোতির ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, জ্যোতি জন্মান্ধ নয়। অসুখের কারণে চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে।

বিদেশি টিমটা নিজেরা-নিজেরা কিছু কথা বলল। তারপর হেডস্যারকে ডেকে বলল, ওর বাবা-মায়ের সাথে আমরা দেখা করতে চাই।

 

জ্যোতির বাবা-মা এলে হেডস্যারসহ বিদেশি টিমটা বসল। তারা জ্যোতির বাবা-মাকে বলল, আপনাদের এমন একটা সম্পদ আছে যা পৃথিবীর অনেকেরই নেই। আবার পৃথিবীর অনেকেই যেটা আছে সেটা আপনাদের মেয়ের নেই। কিন্তু আপনাদের মেয়ের যে মেধা, যে প্রতিভা আছে তাতে যদি তার দৃষ্টিশক্তিও যোগ হয় তাহলে বিরাট একটা ব্যাপার হবে। বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে রেটিনায় অপারেশনের মাধ্যমে এরকম দৃষ্টি হারোনোদের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনা কিছুটা সম্ভব হচ্ছে। পুরোপুরি না-দেখলেও কিছু-কিছু দেখতে পাবে। যার সাহায্যে অন্য সবার মতো তার জীবনও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। আমরা আপনাদের মেয়েকে সেই অপারেশনটা করাতে চাই। স্রষ্টা যদি চায় তো আপনাদের মেয়ে আবার তার দৃষ্টি ফিরে পাবে।

দৃষ্টি ফিরে পাবার কথা শুনে আনন্দে চোখ বড় হয়ে গেল জ্যোতির বাবা-মা’র। জ্যোতি বলল, আমি কি আবার দেখতে পাব সবকিছু?

হেডস্যার বললেন, হ্যাঁ, দেখতে পাবে।

– ডাক্তার মার্ক হুমায়ুন ১৯৮৮ সালে দৃষ্টিশক্তি হারানো একজন মানুষের চোখে রেটিনার নার্ভ গ্যাংলিয়াকে কৃত্রিমভাবে বৈদ্যুতিক পালস দিয়ে উত্তেজিত করে আলোর অনুভূতি আনার ব্যবস্থা করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ এনার্জির পৃষ্ঠপোষকতায় হুমায়ুন নিজেই পরিচালনা করছেন “আর্টিফিশিয়াল রেটিনা প্রজেক্ট”। এদিকে অপ্টোবায়োনিক্স নামক একটা কোম্পানি “আর্টিফিশিয়াল সিলিকন রেটিনা” (ASR ) তৈরি করে ফেলেছিল সেই ২০০৭ সালেই। (ASR) আসলে দু’মিলিমিটার প্রস্থের একটা চিপ, মানুষের একটা চুল যতটা পুরু তার থেকেও কম পুরু সেটা। সেখানে রয়েছে সাড়ে তিন হাজার আনুবীক্ষণিক সৌরকোষ। বাড়ির ছাদে লাগানো সৌরকোষ যেমন আলোকে বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরিত করে, এর কাজও তেমনটা। সূক্ষ্ম সার্জারিতে রেটিনায় ASR বসিয়ে দিলে চিন্তা শেষ। কারণ, চোখে প্রবেশ করে আলো যখন রেটিনার ASR-এ পড়বে তখন তা থেকেই ফোটোইলেকট্রিক পদ্ধতিতে পাওয়া যাবে শক্তি। ফলে আবার দেখতে শুরু করে চোখ। জ্যোতির জন্য আমরা সেই পদ্ধতিতেই কাজ করব। বিদেশি টিমের একজন একটানা বলে থামল।

বিদেশি টিমের আরেকজন বলল, আপনারা যদি রাজি থাকেন আমরা অল্প কিছুদিনের মধ্যে আপনাদের মেয়েকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাব।

জ্যোতির বাবা বলল, রাজি না-হওয়ার কী আছে, আমাদের মেয়ে আবার নতুন করে সবকিছু দেখবে, এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কী আছে!

জ্যোতি বিদেশি টিমের কাছে এসে তাদের একজনের হাত ধরে চুমু দিতে লাগল। বিদেশি লোকটা জ্যোতির আনন্দটা বুঝতে পারল। জ্যোতিকে তিনি জড়িয়ে ধরলেন নিজের সন্তানের মতো। সেটা দেখে জ্যোতির বাবা-মা দুজনেই কেঁদে দিলেন, হেডস্যারের চোখও ছলছল করছে।

জ্যোতি বলল, আমি আবার সবকিছু দেখতে চাই, আমার বাবা-মাকে দেখতে চাই, আমার স্যার-ম্যাডামদের দেখতে চাই, আমার সহপাঠীদের দেখতে চাই, আমি সুন্দর পৃথিবীটা দেখতে চাই…

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *