কৈশোরের সমাজদর্শন ও জ্বিনরাজ্যের সাতকাহন
আবু ওবাইদা আরাফাত
কিশোর মনের অদ্ভুত সব কৌতুহল ও সমাজদর্শনকে তুলে ধরে পাঠকমহলকে রীতিমত চমকে দেয়ার কাজে নেমেছেন ঔপন্যাসিক আরকানুল ইসলাম। বরাবরের মত বিষয় ও কাহিনী নির্বাচনে রেখেছেন দক্ষতার স্বাক্ষর। অশুদ্ধতার ভীত বেঁকে উপন্যাসের শরীরে এঁকেছেন শুদ্ধতার আলপনা। কিশোর মনের মনস্তাত্তিক গ্রহে বিচরণ করে তাদের আচার-আচরণকে নিরীক্ষা করেছেন নিবিড়ভাবে। কেবল সুখপাঠ্য কাহিনীর সুখের পেছনে না-ঘুরিয়ে পাঠককে কাহিনীর অন্দরে টেনে মুখোমুখি করিয়েছেন সমাজের নিগুঢ় সত্যের কাছে।
তিন জন কিশোরের দলে এক জ্বিনবন্ধুর সম্পর্কের নানাদিক উন্মোচন করে লেখক জ্বিনজাতির মতো স্বভাব কৌতুহলোদ্দীপক বিষয়কে টানটান উত্তেজনার সাথে উপন্যাসের অলিতে গলিতে ভ্রমণ করিয়েছেন দক্ষ নাবিকের ন্যায়।
উপন্যাসের ধর্ম মেনে শুধু একটি কাহিনীর মধ্যে আবদ্ধ না-থেকে লেখক বিভিন্ন কাহিনীর সমাবেশ ঘটিয়েছেন প্রাসঙ্গিকতা অটুট রেখেই। তিন কিশোরের নানা দু:সাহসিক কর্মকাণ্ডগুলো অত্যন্ত সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কোনো রাখঢাক না-রেখে। ধর্মব্যবসা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মানবিক দুর্বলতা, জ্বিনদের জীবনাচার, পরোপকারে বিরতিহীন আন্তরিক প্রচেষ্টা, ভালো কাজে ঐক্যের শক্তি সর্বোপরি ডানপিটে কিশোরের চোখে কিশোর মনের এক স্বাপ্নিক ভূবনকে তুলে এনেছেন লেখকের সহজাত ঢঙে।
পাঠকদের গড়পড়তা দৃষ্টিতে কিশোর উপন্যাস হলেও কৃষ্ণমূর্তি উদ্ধারের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান, কক্সবাজার যাওয়ার পথে চুনতির গহীন অরণ্যে এক গৃহে আটকে পড়া, জীবন ঝুঁকির মধ্য দিয়ে পুলিশকে গোপনে তথ্য দিয়ে ডাকাতদের পাকড়াও করা এসব টানটান উত্তেজনার দৃশ্যগুলো অনেকটা গোয়েন্দা উপন্যাসের স্বাদে ভরপুর।
“আর প্রত্যেকটা মানুষের কাছে একটা করে জ্বিন থাকে” এমন সব চমকপ্রদ লাইনের গাঁথুনী দিয়ে ঝরঝরে মুক্তোর মত শব্দগাঁথুনী দিয়ে কাহিনী টেনে নিয়েছেন। বুড়োবুড়িদের আদিকথাও বাদ যায়নি লেখকের সুক্ষ্ম সমাজদর্শন হতে। লিখেছেন- “পানিতে নিখোঁজ সন্তানকে মায়ে ছুঁলে নাকি সন্তানকে বাঁচানো সম্ভব হয় না”।
চিরায়ত হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অবতারণা করতে গিয়ে বলেন- “মুসলিম পাড়ার লোকজন তখন কবিরাজদের চাপাকল থেকে পানি আনতে যায়। বাচ্চারা পানি আনতে গেলে গোপালের মা নিজ হাতে তাদের পানি তুলে দেয়। মিনারদেরকেও অনেকসময় গাছের বিভিন্ন ফল-ফলাদি দিত”।
জ্বিন হাজিরের কৌশল বর্ণনা করেছেন এভাবেই – “জিহবাকে মুখের তালুর উপরের অংশে চেপে ধরে আল্লাহ আল্লাহ করে জিকির করতে লাগল আর বুকের বামপাশে ইশারা করতে লাগল, যেখানটায় ক্বলব তথা হৃদপিণ্ডের অবস্থান। একপর্যায়ে তার মনে হলো, সে ভূমি থেকে যেন কিছু উপরে উঠে গেলে।” গায়ে লোম কাঁটা দিয়ে উঠার মতোই বর্ণনশৈলীতে ঋদ্ধ লেখনী পাঠককে শেষ পর্যন্ত আটকে রাখবে।
আরকানুল ইসলাম মূলত ছড়াকার হিসেবে ব্যাপক সমাদৃত, উপন্যাসেও ছড়ার মানুষের রেশ রাখার স্বাভাবিক কাজটাই করলেন অসাধারণভাবে। চতুর্দিকে ভেজালের ছড়াছড়ি নিয়ে ছড়া কাটলেন-
“অরেঞ্জ জুসে কমলা নেই, ম্যাঙ্গু জুসে আম
মিষ্টি কুমড়া দিয়েই যত দুনম্বরি কাম!”
প্রয়োজনের তুলনায় মানসম্মত কিশোর উপন্যাসের যথেষ্ট ঘাটতির সময়ে ধারাবাহিকভাবে কিশোর উপন্যাস নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির হবার মতো দুঃসাহসিক প্রয়াস দেখিয়েছেন ঔপন্যাসিক আরকানুল ইসলাম।
উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের কিশোর উপন্যাসের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করবে বলেই বিশ্বাস আমাদের।
চট্টগ্রামের শব্দশিল্প প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদ করেছেন ফারজানা পায়েল। ৮০ পৃষ্টা বইয়ের মূল্য রাখা হয়েছে ১৩০ টাকা।
বইটি চট্টগ্রামের বাতিঘর, চকবাজারের ঘুণসহ অভিজাত বইবিপনীগুলো থেকে সংগ্রহ করা যাবে।