আমি মানুষ নই, বেকার!

আমি মানুষ নই, বেকার
আকাশ দে

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে
যখন উত্তাল সারাদেশ তখন একটা শ্রেণীর মানুষ
গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।
সরকার গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে ছিল বলে
মানুষের ঢল শব্দটা মানুষ বলতে পেরেছিল।
কোটা সংস্কারের জন্য ছাত্র সমাজ মাঠে
নেমেছে। আর এর বিরুদ্ধে আছে
একশ্রেণীর মানুষ। বাঙালী মারাত্মক
সুবিধাবাদী একটা জাতি। প্রতিটা আন্দোলনকে এই
দেশের রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিতে
কাজে লাগায়। আমি হিন্দু পরিবারে জন্ম নেওয়া
একজন সাধারণ ঘরের ছেলে। আমি
আওয়ামীলীগ, বিনএনপি, জামাত, বাম-ডান
এসবের কোনটার পক্ষে নই। আমি সাধারণদের
পক্ষে। আমি বাংলাদেশের পক্ষে। তবু অন্ধ
লোকটিও বলবে আমি আওয়ামীলীগের
লোক, আমি নৌকার লোক। কারণ আমি হিন্দু
পরিবারে জন্ম নেওয়া একজন সাধারণ জনগণ। হ্যাঁ,
আমি সাধারণ জনগণ। তার মাঝে আবার সংখ্যালঘু শব্দটা
যুক্ত আছে। অথাৎ, সাধারণ সংখ্যালঘু জনগণ।
মুক্তিযুদ্ধাদের প্রতি আমার ভক্তি শ্রদ্ধা ঠিক ততটুকু
যতটুকু আমি আমার মা বাবাকে ভালোবাসি। আমার দাদু
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাত রান্না করে নিয়ে
যেতো গভীর পাহাড়ে। আমার পাশের
বাড়িতে একজন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা আছে উনার
সাথে থাকতো আমার দাদু। যুদ্ধ চলাকালীন
রাজাকার আর পাকিস্তানী হায়নাদের অত্যাচারে
আমার ঠাম্মারা রাতে ঘুমাতে পারতো না বাড়িতে।
আমাদের গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান আর
পুকুর ভরা মাছ সবই ঐ শকুনীদের দখলে ছিল।
শেষ পর্যন্ত আমাদের বাড়িটা পুড়িয়ে দেওয়া
হয়। যুদ্ধ শেষে আমাদের অবস্থা খারাপতর হয়ে
যায়। জায়গা সম্পত্তি যা ছিল তা বিক্রি করে পেট চালায়
দাদু ঠাম্মারা। বাবা ছোট ছিল। তারপর আর পড়াশোনা
করা হয়নি বাবাদের। মানুষের বাড়িতে কাজ করে
পেট চালিয়ে বড় হতে থাকে বাবারা। আমাদের
আর কিছু রইলনা ততদিনে। এখন ১ গন্ডা বা ৪৩২.৬
বর্গফুটে আমার বাবা এবং কাকারা আছে।
যুদ্ধচলাকালীন এইদেশের সংখ্যালঘুরা
কীভাবে ছিল সেই ইতিহাস শুনলে
শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়।
ভেতর থেকে একদলা কান্না ঠেলে
বেরিয়ে আসে। যুদ্ধের সময় এদেশের
সংখ্যালঘুরা যেভাবে নির্যাতিত হয়েছে সেটা
বিবেচনা করলে এদেশের প্রতিটি হিন্দু পরিবারও
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে।
দাদু মারা গেল প্রায় তের বছর হলো। আমাদের
পরিবারে মোটামুটি স্কুল কলেজে একটু আধটু
যাওয়া আসা করা ছেলেটি আমি। আর সেজন্য
আমার কয়েকটা সার্টিফিকেটও আছে।
অনেকগুলো চাকরিতে এপ্লাই করেছি। টিউশন
করে যা পেতাম তা চাকরীতে আবেদন করা
এবং ঢাকায় গিয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়ে ফুরিয়ে
যায়। অথচ আমার চাকরী হয়না। ভাবলাম আমি তো টু
ডামিশ লেভেলের স্টুডেন্ট তাই হয়তো
হচ্ছেনা চাকরি। এবার আমি অষ্টম শ্রেণী পাস
শিক্ষা যোগ্যতার পোষ্টগুলোতে এপ্লাই
করতে থাকি। স্নাতক পাস একটা ছেলের অষ্টম
শ্রেণী পাসের যোগ্যতাও কি নাই?
ডাইরেক্ট ভাইবা দিয়েছি অনেকগুলো অফিস
সহায়ক বা পিয়নের পোস্টে। কারণ আমার একটা
চাকরি দরকার। শরীরের অবস্থা ভালো না।
বেসরকারী চাকরীতে অনেক পরিশ্রম এবং
অনিশ্চিয়তা থাকে বিধায় আমি সরকারী চাকরি খুঁজে
মরেছি। কিন্তু এখনো আমার চাকরি হয়নি ভাই। পঁচিশ
বছর বয়স চলছে। বাবা গাছের কাজ করে। গাছ
কাটতে যখন উঁচু গাছে উঠে আমার আমিটা মরে
যায়। আমার ভিতরে আর কোন শক্তি অবশিষ্ট
থাকেনা। দিনকে দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। যে
বয়সে মানুষটা ছেলের রোজগার খাবে
সেই বয়সে…!
দেশে চাকরীর ক্ষেত্রে কতটুকু
দুর্নীতি হচ্ছে সেটা বলে শেষ করা
যাবে। ঘুস ব্যতীত যে চাকরি হয়না সেটা সবাই
জানি। কিন্তু কাকে বলবো এসব? কীভাবে
প্রমাণ করবো যে দুর্নীতি হচ্ছে? আর
প্রমাণ করলেই বা কি হবে? তাতে কি আমার চাকরি
হবে? উল্টো আমার এবং আমার পরিবারের উপর
চাপ আসবে। যেখানে দুইবেলা ঠিক মতো
খেতে পারিনা সেখানে লাখ টাকা দিবো
কোথা থেকে? আর লাখ টাকা থাকলে চাকরি
খুঁজতাম না, ব্যবসা করতাম। আমাকে পাড়ার বড় ভাইরা
উপদেশ দেয় এসব নিয়ে না লিখতে। এসব
নিয়ে লিখলে নাকি পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। ভাই,
নিয়ে গেলে নিয়ে যান। আমরা তো মানুষ না,
তেলাপোকা। প্রাণ নামক যে বস্তুটি আমার ভিতর
আছে সেটা রোজ রাতে মরে যায়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আমরা কি বুঝি? একটা
শ্রেণীর মানুষ অতিরিক্ত সুবিধা পাবে এটায় কি
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়বস্তু। একটা চাকরি,
স্রেফ একটা চাকরী। মরতে বসা একটা
পরিবারকে বাঁচাতে পারে। একজন বেকার
ছেলেই জানে বেকারত্ব কি জিনিস। প্লীজ
বাঁচতে দিন। জানি এসব অনর্থক বকবক্। সাধারণ
মানুষের কথা কেউ শুনে না। আমার তো
কোন কোটা নেই। যদি থাকতো তবে
আমার অবস্থান অন্যরকম হতো। বিশ্বাস করুন,
আজকাল মানচিত্রটা খেয়ে মরে যেতে
ইচ্ছে করছে…..

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *