আমাদের বিয়ে
জামশেদুল আলম চৌধুরী
বিয়ে একটি ইবাদাত। রাসূলুল্লাহ স. নিজে বিবাহ করেছেন এবং এর প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে বলেছেন, “আমি বিবাহ করি। (তাই বিবাহ আমার সুন্নত) অতএব যে আমার সুন্নত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সে আমার দলভুক্ত নয়।” [বুখারী /৫০৬৩, মুসলিম /৩২৯৪, আলহাদিস এন্ড্রয়েড এপ]
বর্তমানে মুসলমানদের বিয়েতে কিছু অমুসলিম সংস্কৃতি যোগ হয়ে গেছে যা শরিয়তের দৃষ্টিতে অবশ্য বর্জনীয়। এখানে উল্লেখযোগ্য কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
গায়েহলুদ:
————–
বিয়ের সময় বর ও কনেকে চাকচিক্যময় পোষাকে সাজানো ও তাদের গায়ে হলুদ মাখানো ইসলামী শরিয়তে সম্পূর্ণ যায়েজ। ইসলামে হলুদ একটি পছন্দনীয় রঙ। বিয়ের সময় গায়ে হলুদ মাখানো, হলুদ রঙের জামা পরা এবং সুগন্ধী দেয়াকে উৎসাহিত করা হয়েছে। একদা হযরত আবদুর রহমান ইবন আওফ র. রাসুল স. এর দরবারে এলেন। তখনো তার গায়ে হলুদের চিহ্ন ছিল। রাসুল স. তাকে কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন তিনি এক আনসার মহিলাকে বিয়ে করেছেন। রাসুল স. এটা অপছন্দ করেন নি।
আমাদের সংস্কৃতি ছিল বিয়ের দিন দুপুরে গোসলের আগে বরকে মাহরাম মহিলারা (মা, দাদী, নানী, ফুফু, খালা প্রমুখ) গায়ে হলুদ লাগিয়ে দিতেন, এরপর পুরুষরা তাকে গোসল করাতেন। আর কনেকে হলুদ লাগানো এবং গোসল করানো সব মহিলারাই করতেন। তখন এটাই ছিল গায়েহলুদ।
বিয়ের সময় দফ (বাংলায় বলা হয় খঞ্ছনী/তম্বুরা, ইংরেজীতে বলা হয় tambourine। এটা এক ধরণের একমুখওয়ালা বাদ্যযন্ত্র) বাজানো এবং নির্দোষ গান-গীত গাওয়া “অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের” জন্য যায়েজ। শুধু যায়েজ বললে কম বলা হবে, এটা সুন্নতও বলা যেতে পারে। অনেক বিশুদ্ধ হাদীসে এর প্রমাণ রয়েছে। রসুল স. বলেছেন, “তোমরা বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যাপক প্রচার কর, এর অনুষ্ঠান মসজিদে সম্পন্ন কর এবং এসময় (বাইরে) দফ বাজাও।” অপর এক বর্ণনায় এসেছে, এক বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পর্কে রাসুল স. কে জানানো হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি সে বিয়েতে কোন মেয়ে পাঠাও নি, যে বাদ্য বাজাবে আর গান গাইবে?” তবে দফ বাজানো ও গান গাওয়া শুধু নাবালিকা মেয়েদের জন্য যায়েজ।
কিন্তু বর্তমানে যেভাবে গায়ে হলুদ করা হয়, সেটা সম্পূর্ণ নাযায়েজ। মোমবাতি জ্বালানো, বেমাহরাম দ্বারা গায়ে হলুদ লাগিয়ে দেয়া, নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা, যুবতীদের সাজগোজ় করে সৌন্দর্য প্রদর্শন, নিষিদ্ধ বাদ্য বাজানো, অশ্লীল গান এসবই হারাম।
[পরিবার ও পারিবারিক জীবন, মাওলানা আবদুর রহীম]
সনাতন ধর্মীয় আচারে অধিবাস রাতের সন্ধ্যায় এই অনুষ্ঠান করা হয় বলে ওদের ভাষায় একে ‘হলুদ সন্ধ্যা’ বলা হয়। কেউ কেউ এর বদলে অনুরূপ একটি অনুষ্ঠান করে থাকে। একে বলা হয় ‘পুষ্প চন্দন’ বা ‘চন্দন সন্ধ্যা’। এক্ষেত্রে হলুদের পরিবর্তে চন্দন ব্যবহার করা হয়। শরিয়া বিবর্জিত ক্রিয়াকলাপের কারণে বর্তমানে হলুদ সন্ধ্যা ও গায়েহলুদ একাকার হয়ে গেছে।
বরযাত্রা:
———–
বরযাত্রা একটি মারাত্মক অপসংস্কৃতি আমাদের ওপর চেপে বসেছে। কুষ্টিয়া ইসলামিক ইউনিভার্সিটির আল-হাদিস বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীরকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছেন, “এটি যৌতুক ও চাঁদাবাজির একটি অংশ। ইসলামি বিয়েতে মেয়ের বাবার জন্য মোহর, ওয়ালিমার ন্যায় কোন ব্যয়ভার শরিয়াহ নির্ধারণ করেনি। একান্তভাবে যারা না গেলে হয় না, তারাই কন্যা আনতে যাবে। বরযাত্রীর সংখ্যা নিয়ে জোরাজুরি কষাকষি তো দূরের কথা, কন্যার অভিভাবকের ইচ্ছার বাইরে একজনও যদি বেশি যায় তবে তা হবে পিস্তল ঠেকিয়ে টাকা আদায়ের মত।”
হাদিস শরীফে নবীজী স. ঘোষণা করেছেন, “কেউ আমাদের এ শরিয়াতে নাই এমন কিছুর অনুপ্রবেশ ঘটালে তা প্রত্যাখ্যাত।” [সহীহ বুখারী/ ২৬৯৭] এরপরও যদি কোন কন্যার বাবা বলে, “আমি সানন্দে বরযাত্রীদের খাওয়াচ্ছি, সুতরাং সমস্যা কোথায়?” তবে তাকে প্রশ্ন করা উচিত, নবী স. এর কাছে যা বর্জনীয় তা আপনার কাছে পছন্দনীয় হলো কেন? হ্যাঁ, আপনি যদি কন্যাদায়গ্রস্ত হন, আর পরিস্থিতি আপনাকে বাধ্য করে ফেলে, তবে সেক্ষেত্রে আপনি মজলুম। তাই সমাজের সব ছেলের গার্ডিয়ানকেই আগে বুঝতে হবে।
ওয়ালিমা:
————-
ইসলামে ওয়ালিমাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নবী স. বলেছেন, “যে বিনা কারণে ওয়ালিমার দাওয়াতে সাড়া দিল না, সে আল্লাহ রাসুলের অবাধ্যতা করল।” [বুখারি/ ৫১৭৭, মুসলিম]
ইমাম আবু হানিফা, আহমদ বিন হাম্বল, শাফেয়ী রহ. সহ অধিকাংশ মুজতাহিদের মতে ওয়ালিমা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। পক্ষান্তরে মালেকী, সানআনী, শাওকানী, আলবানী রহ. প্রমুখ বলেছেন ওয়াজিব। আকদের/ সহাবস্থানের পর বর সাধ্যানুযায়ী ওয়ালিমার আয়োজন করবে। বিত্তবান আত্মীয় স্বজন এই খরচে শরিক হওয়া মুসতাহাব। হযরত সাফিয়া রহ. এর সাথে রাসুলুল্লাহ স. এর বিয়েতে তিনি এর নজির দেখিয়েছিলেন।
আরেকটি কথা মনে রাখা আবশ্যক, যে ওয়ালিমায় শুধু ধনী ও প্রভাবশালী লোকদের দাওয়াত দেওয়া হয়, গরীব-মিসকিনদের দাওয়াত দেওয়া হয় না, সে ওয়ালিমাকে হাদিসে নিকৃষ্টতম ওয়ালিমা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সুতরাং এ ধরণের ওয়ালিমা আয়োজন থেকে বিরত থাকা উচিত। [বুখারি/ ৫১৭৭, মুসলিম/ ১৪৩২, আবু দাউদ/ ৩৭৫৪]
ওয়ালিমায় গরু ছাগল জবাই কিংবা খুব উঁচুমানের খাবারের ব্যবস্থা করা জরুরী নয়। বরং সামর্থানুযায়ী খরচ করাই সুন্নত আদায়ের জন্য যথেষ্ট। অহমিকাবশতঃ লোকদেখানো জৌলুস করে নিজেকে আল্লাহর রহমত বঞ্চিত করার মানে কী! বিয়েশাদিতে বেশি খরচ হয় অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডগুলোতেই। অথচ বিয়ে অনুষ্ঠান যত অনাড়ম্বর হবে, খরচ যত কম হবে ততই তা বরকতপূর্ণ হবে। রাসুলুল্লাহ স.বলেন, “সর্বাধিক বরকতপূর্ণ বিয়ে হচ্ছে, যাতে খরচ হয় সবচেয়ে কম ও সহজ।” [মুসনাদে আহমাদ /২৪৫২৯] কারণ অপব্যয় ও অপচয়কারীকে পবিত্র কোরআনে শয়তানের ভাই বলা হয়েছে।
কোন কোন অনুষ্ঠানে বেহায়াপনা ও গর্হিত কাজ চলে। তাতে অংশগ্রহণ করা যাবে কিনা এ বিষয়ে গবেষক আলেমগণের মতামতগত বিশ্লেষণ রয়েছে। অধিকাংশ হানাফি, মালেকী ও হাম্বলী আলেমের মতে ওই রকম অনুষ্ঠানে চলমান অপকর্ম বন্ধ করার সামর্থ থাকলে যেতে হবে ও বন্ধ করতে হবে। আর সেই সক্ষমতা না থাকলে ঐ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া হারাম। শাফেয়ী রহ. এক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, সামর্থ না থাকলেও দাওয়াত গ্রহণপূর্বক ঐ অনুষ্ঠানে যেতে হবে এবং অপকর্ম বন্ধ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে।
আল্লাহ, আমাদের মেনে চলার হিম্মত দাও।
লেখক: সহকারি অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ