BanshkhaliTimes

আমাদের কি আদৌ মানবতাবোধ আছে?

BanshkhaliTimesআমাদের কি আদৌ মানবতাবোধ আছে?আরকানুল ইসলাম

করোনা উপসর্গ নিয়ে ইউএসটিসিতে মারা যান বাঁশখালীর পুঁইছড়ি ইউনিয়নের মদন কান্তি সুশীল। কিন্তু তার প্রতিবেশিরা গ্রামে শবদেহ আনতে দেয়নি, শেষকৃত্যের সৎকার করতে দেওয়া হয়নি তার পরিবারকে, উলটো শবদেহ না আনতে নানা অপমান ও সমাজচ্যুত করার হুমকি দেওয়া হয়েছে তার সন্তানকে! এটা আমাদের বাঁশখালীরই একটি চিত্র মাত্র!

করোনা এসে মানুষ মানুষকে চিনতে শুরু করেছে। সারা দেশে এরকম বহু ঘটনা ঘটে গেছে অলরেডি। করোনাক্রান্ত পিতাকে হাসপাতালে ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে সন্তান, পিতার লাশ গ্রহণ করেনি সন্তান, চা দোকানি ভাইকে নিয়ে হাসপাতালের পাশে রেখে পালিয়ে গেছে বোন, প্রতিবেশিরা করোনাক্রান্তের লাশ বাসায় আনতে দেয়নি। এই চিত্র কি সহ্য করার মতো? আমরা নিজেদেরকে মানবতাবাদী বলে দাবি করি! বিভিন্ন দিবস এলে রাস্তায় নেমে মানবতা দেখাই, নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে ছবি দিই, স্লোগান তুলি, বিরাট বিরাট কলাম লিখি- আমাদের মানবতা ঐ অতটুকুই!
আবার হাসপাতালের ফ্রন্টে বিরাট করে লিখে রেখেছি ‘সেবাই ধর্ম’! কিন্তু সেই হাসপাতালের গেট থেকে প্রতিদিন ফিরে যাচ্ছে শত শত রোগী! টাকা দিয়েও ‘সেবা’ নামক এই বুলিটি নিতে পারছে না সাধারণ মানুষ। অক্সিজেনের সিলিন্ডার হাতে করে ঘুরতে হচ্ছে এই হাসপাতাল থেকে অই মেডিকেলে! কিছু ডাক্তার সত্যিকারের মানবিকতা প্রদর্শন করলেও অধিকাংশই ঘাপটি মেরে আছে এই প্রাকৃতিক মহাদুর্যোগকালে, অথচ এদের জন্য ‘ফ্রন্ট লাইনার’ হয়ে মানবসেবা করার এটাই শ্রেষ্ঠ সময়। আবার কিছু ডাক্তারের এমন হামবড়া ভাব এদের মুখের ভাষা যদি এরকম হয় তাহলে সিলেটের মানবসেবী ডাক্তারকে তো আমরা ‘ফেরেশতা’ বলে ডাকতে পারি। তিনি সেবা দিয়েছেন বটে, কিন্তু নিজেও সুচিকিৎসা পাননি। এটা পুরো জাতির জন্য বিরাট আফসোস। প্রতি বছর বাজেটে হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয় চিকিৎসাসেবার পেছনে, কিন্তু সেই টাকা কোথায় যায়, কারা খায় ঠিক আমাদের জানা নেই। এত হাজার কোটি টাকা বাজেট হলেও সারা দেশ মিলে ১ হাজার আইসিউই নেই, নেই ভেন্টিলেটর! অথচ এরাই দেশের সেবা করার ওয়াদা দিয়ে মানুষের কাছে ভোট চায়, মানুষের কাছে ভোটভিক্ষার কাকুতিমিনতি করে!

এদের মুখের এই মানবিকতা বা মানবতাবাদ আমেরিকার মানবতাদের মতোই, কেবল মুখেই সীমাবদ্ধ! বিশ্বে আজ সবচেয়ে বেশি মানবতাবাদী র‍্যালি, কর্মসূচি, শ্লোগান হয় আমেরিকায়, কিন্তু পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে মানবতাবিরোধী কাজ তারাই করছে। তারা নিজেরা যুদ্ধ করছে, অন্যদের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে উভয়পক্ষের কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে। বিগত কয়েক শতাব্দীতে এই পশ্চিমাসভ্যতা যা করেছে, পৃথিবীর হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে এরকম মানবতার লঙ্ঘন আর হয়নি।

সত্যিকারের মানবতা আছে কেবল ইসলাম ধর্মে। পবিত্র কোরআনে মানবতার শ্রেষ্ট সবক দিয়ে দেওয়া হয়েছে সুস্পষ্টভাবেই। কিন্তু ক’জন মুসলিম সেটা মানে? ক’জন মুসলিম নিজের চালচালনে এটাকে গ্রহণ করে নিয়েছে? আর আমরা সেই কোরআনকেই দূরে সরিয়ে রেখে মানবরচিত মতবাদকে গ্রহণ করছি। যার ফলাফল আজকের এই বৈশ্বিক অবস্থা। আমরা যা বলি তা করি না। কিন্তু রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হলেই মানবতার প্রকৃত রূপ মানবজাতি দেখতে পেয়েছে।
এই ইসলাম যখন কার্যকরণে প্রকৃত ইসলাম ছিল- অর্থাৎ বিশ্বনবীর (সা.) কাছ থেকে যারা সরাসরি শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন তাদের অন্যতম, দ্বিতীয় খলিফা ওমরের (রা.) সময় একবার দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। যতদিন দুর্ভিক্ষ ছিল ততদিন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ যেমন অর্ধাহারে অনাহারে থাকে তিনিও তেমনি থাকতেন। ওমর (রা.) প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যতদিন না জনসাধারণ এমন অবস্থায় পৌঁছবে যে, তারা ভালো করে খাবার পরও উদ্বৃত্ত থাকবে ততদিন তিনি গোশত-মাখন এমনকী দুধ পর্যন্ত খাবেন না এবং তিনি খানও নি। তিনি বলতেন “আমি যদি ঠিকমত খাই তবে আমি কী করে বুঝব আমার জাতি কী কষ্ট সহ্য করছে?” এই অর্ধাহারে অনাহারে থেকে খলিফা ওমরের (রা.) মুখ রক্তশূন্য ও চুপসে গিয়েছিল।

সেই বছর চুরির জন্য হাত কাটার বিধান পর্যন্ত ওমর (রা.) স্থগিত করেছিলেন। এর চেয়ে মানবিক আর কী হতে পারে?
অথচ আমরা কী করছি? জিনিসপত্রের দাম তিনগুণ-চারগুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিচ্ছি। যে মাস্কের দাম সাত টাকা সেটা বিক্রি করতেছি বিশ-পঁচিশ টাকায়, যে পালস্ অক্সিমিটারের দাম চৌদ্দশ টাকা সেটা বিক্রি করতেছি আড়াই হাজার-তিন হাজার টাকায়! এমনিভাবে এই সময়ের প্রয়োজনীয় ওষুধ, চিকিৎসা-সরঞ্জামের দাম বাড়িয়ে বহুগুণ লাভে বিক্রি করতেছি।

কিন্তু এই লাভের টাকা কে খাবে? সামান্য একটা ভাইরাসের ভয়ে যেখানে সারা বিশ্ব নাকাল, যেখানে পুত্র তার পিতামাতাকে ফেলে চলে যাচ্ছে, বোন তার ভাইকে ফেলে চলে যাচ্ছে সেখানে এই বাড়তি দামে বিক্রির টাকা কে খাবে? হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়া সহজ। কিন্তু মৃত্যু থেকে পালানো কি সহজ? কিয়ামত আসতে আরো বহু দেরি আছে। কিন্তু পিতা-পুত্র-ভাই-বোন পরস্পরকে যেভাবে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে, হাসপাতার কর্তৃপক্ষ যেভাবে রোগীদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে, প্রতিবেশিরা যেভাবে লাশ কবর দিতে দিচ্ছে না বা গ্রামে আনতে দিচ্ছে না- এতো কিয়ামতের মাঠের নমুনাদৃশ্য আমরা পৃথিবীতেই দেখে যাচ্ছি! এ-ই কি আমাদের মানবতাবোধ? এটাই কি আমাদের মানবিকতা?

আমরা যারা মুসলিম তাদের জন্য তো পরকালে জবাবদিহিতার একটা ব্যাপার আছে। আমরা কি পরকালের এই জবাবদিহিতা থেকে মুক্তি পাব? আমরা নিজেকে আগে শুধরে নিই। আগে নিজে শুধরাতে পারলে পরিবার শোধরাবে, সমাজ শ্রধরাবে, রাষ্ট্র শোধরাবে। একদিন পুরো বিশ্ব মানবতার চাদরে আবৃত হবে। মানুষ সত্যিকারের মানবতাবোধ দেখতে পাবে সেদিন।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাঁশখালী টাইমস

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *