আদব-কায়দা ও সালামের প্রচলন
রায়হান আজাদ
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যেকটি বিষয় ইসলামে সুস্পষ্টভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। ধর্মীয়ভাবে ইসলামী নিয়ম-কানুন মেনে চললে যেমনিভাবে অসীম সাওয়াবের অংশীদার হওয়া যায় তেমনি এ নিয়ম-কানুন একজন সহজ-সরল শান্তিপ্রিয় মানুষের জন্য বিজ্ঞানসম্মত ও সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। ইসলামী আদব-কায়দা মত জীবন গড়ে তুলতে পারলে সামাজিক ক্ষেত্রে নেমে আসবে শান্তি, সৌহার্দ, ভ্রাতৃত্ব ও গভীর মুহব্বত। তাই আমাদের প্রথমেই জানতে হবে, ইসলামী আদব-কায়দা বা শিষ্টাচার বলতে কি বুঝায়? এ সম্পর্কে কবি দার্শনিক আল্লামা শেখ সাদী ( রহ:) বলেন, আদব বা শিষ্টাচার এমন একটি বিশেষ বিদ্যার নাম যা লিখিত কিংবা মৌখিক যে কোনভাবেই হোক আয়ত্ব করলে একজন মানুষ সর্বপ্রকার ব্যক্তিগত, সৃষ্টিগত কিংবা সমাজগত ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে নিরাপদ থাকতে পারে। কারণ, কল্যাণ অর্জন কিংবা কল্যাণ বিস্তার এই দুই বস্তুর সমন্বয়েই আদবের প্রকৃত বিকাশ সাধিত হয়। আল্লামা সয়ুতী রহ. বলেন, উত্তম চরিত্রে ভূষিত হওয়াকে আদব বলা হয় এবং ইহাই আদবের মূল। আবার কেউ কেউ বলেন, বড়দের প্রতি স্নেহ ও মমতা বিতরণ করাকেই আদব বলা হয়। মোটকথা আদব একটি মানবিক গুণ। এ গুণ থাকলে মানুষ অন্যের কাছে সম্মানের পাত্র হয়ে থাকে। এর বিপরীতে বে আদবকে কেউ পছন্দ করে না এবং বে আদব কথাটি আমাদের সমাজে কটুক্তি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
ব্যক্তির আদাব-কায়দার প্রশ্ন উঠলে প্রথমেই আলোচনায় আসে সালাম বা অভিবাদন প্রসঙ্গ। মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই একে অপরের সাথে সাক্ষাতের সময় প্রথম সম্ভাষণ হিসেবে বিভিন্ন জাতির মাঝে বিভিন্ন পদ্ধতিতে সালাম বা অভিবাদন জানানোর রীতি প্রচলন হয়ে আসছে। বিশ্বের প্রত্যেক দেশে প্রত্যেক সম্প্রদায় তাদের নিজ নিজ রুচি ও সংস্কৃতি অনুযায়ী ভাব বিনিময়ের পৃথক পৃথক রেওয়াজ রীতি লালন করছে। আরবে ইসলাম পূর্ব যুগে “আনআমাল্লাহু বিকা আইনা-আল্লাহ আপনার চক্ষু ঠান্ডা করুন,আনআমা ছবাহান-শুভ প্রভাত, আনআমা মাছাআন-শুভ সন্ধ্যা ইত্যাদি পদ্ধতিতে সাদর সম্ভাষণ জানানো হত। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স:) এসব শব্দ পরিবর্তন করে সালামের প্রবর্তন করেছেন। সালাম মানে শান্তি, নিরাপদে থাকা। আস্সালামু আলাইকুম অর্থ: আল্লাহ আপনাকে শান্তিতে রাখুন। ইসলামে আস্সালামু আলাইকুম বাক্যটি সার্বজনীন এবং বিশ্বব্যাপী। ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, সুস্থ-অসুস্থ, বিদ্বান-কম বিদ্বান, নেতাকর্মী, ছাত্র-শিক্ষক সবার মাঝে সমানভাবে প্রযোজ্য। অপরিচিত ব্যক্তির সাথে পরিচয় অর্জন, ভাব জমানো এবং আপন করে নেয়ার জন্য সুন্দরভাবে সালাম দেয়াই যথেষ্ট। সামাজিকভাবে সালামের ব্যাপক প্রচলন ঘটালে পারস্পরিক শত্রুতা দূর হয়, ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে। সবচেয়ে বড় কথা হল, সালাম ইসলামী সংস্কৃতির প্রথম নিদর্শন। রাসুলুল্লাহ (স:)‘র সুন্নাত। রাসুলে আকরাম ( স:) সবার আগে সালাম দিতেন। সালামের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব- অবশ্য কর্তব্য। সালামের গুরুত্ব সম্পর্কে কুরআন- হাদিসে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। “ কালামে পাকে রয়েছে“ ফাসফাহ আনহুম ওয়াকুল সালামুন, সালামুন আলাইকুম ত্বিবতুম ” প্রভৃতি আয়াতে কারীমা । রাসুলে আকরাম (স:) বলেছেন, আল্লাহ পাক হযরত আদমকে একটি স্বতন্ত্র আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। তার উচ্চতা ছিল ষাট হাত। তাকে সৃষ্টির পর আল্লাহ পাক বললেন, হে আদম যাও এবং অবস্থানরত ফেরেস্তাদের ঐ দলটিকে সালাম কর। আর তারা তোমার সালামের কি জবাব দেয় তা মনোযোগ দিয়ে শোন। কেননা ইহাই হবে তোমার এবং তোমার সন্তানদের সালামের জওয়াব। অত:পর আদম আ. সেখানে গিয়ে বললেন, আস্সালামু আলাইকুম। তারা জবাব দিলেন, আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। রাসুল সা. বলেন, তারা ওয়া রাহমাতুল্লাহ শব্দটি বৃদ্ধি করেছেন। অত:পর তিনি বলেন, যে ব্যক্তিই বেহেশতে প্রবেশ করবে সে হযরত আদম আ. এর আকৃতিতেই প্রবেশ করবে। সে উচ্চতায় হবে ষাট হাত লম্বা। তখন হতে অদ্যাবধি সৃষ্টিকুলের উচ্চতা ক্রমাগত হৃাস পেয়ে আসছে।- (ছহীহুল বুখারী ও মুসলিম) । অন্যত্রে হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি মহানবী সা. কে জিজ্ঞাসা করল, ইসলামের কোন কাজ সবচেয়ে উত্তম? তিনি বললেন, অপরকে তথা অভূক্ত-দরিদ্রকে খানা খাওয়ানো এবং চেনা অচেনা সবাইকে সালাম দেয়া (বুখারী মুসলিম)।
ইসলামী শরীয়তের অন্যান্য আমলের মত সালাম দেয়ারও কিছু নিয়মনীতি রয়েছে। অজু, নামাজ, খাবার ও পানাহাররত অবস্থায় সালাম দেয়া সমীচীন নয়। মলমূত্র ত্যাগে ব্যস্ত, কুরআন তেলাওয়াত, ওয়াজ-নসীহত, পড়াশোনা ও যিকির আয্কার করা অবস্থায় সালাম করা যাবে না। কেউ ভুলবশত করলে তার উত্তর দানও মাকরূহ বা অপছন্দনীয়। তবে সংশ্লিষ্ট কাজ হতে অবসর হয়ে জবাব দেবে এবং তাকে মাসআলাটি জানিয়ে দেবে।
পরিশেষে, বলা যায়, ইসলামী আদব-কায়দা সমূহের মধ্যে সালাম অন্যতম। আমাদের সামাজিক জীবন থেকে হিংসা-বিদ্বেষ, রাগ-উগ্রতা, রুক্ষতা, বদমেজাজ ও অহমিকা দূর করার জন্য ব্যাপকহারে সালামের প্রচলন ঘটাতে হবে। একটি সুখী, শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ দেশ গঠনে পারস্পরিক দেখা হওয়া মাত্র সালাম বা অভিবাদন জ্ঞাপন মোড় পরিবর্তনকারী ভূমিকা রাখতে পারে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সালামের গুরুত্ব ও সুফল বুঝার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি