বাঁশখালী টাইমস: ‘কে আসে কে আসে সাড়া পড়ে যায়- কে আসে কে আসে নতুন সাড়া/ জাগে সুষুপ্ত মৃত জনপদ জাগে শতাব্দী ঘুমের পাড়া, কিংবা রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?/এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?/সেতারা হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?/তুমি মাস্তুলে আমি দাঁড় টানি ভুলে;/ অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা হেরি…. এমন অসংখ্য কালজয়ী কাব্য পঙৃক্তির রচয়িতা কবি ফররুখ আহমদের জন্মশতবার্ষিকী আজ। ১৯১৮ সালের ১০ জুন তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার মাঝআইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। খানসাহেব সৈয়দ হাতেম আলী ও রওশন আখতারের দ্বিতীয় ছেলে ফররুখ আহমদ। কলকাতার বালিগঞ্জ হাইস্কুলের মেধাবী ছাত্র ফররুখ ১৯৩৭ সালে খুলনা জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা, ১৯৩৯ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে আই এ পাস করেন। কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজে ১৯৩৯ সালে দর্শন বিষয়ে, পরে ১৯৪১ সালে কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বিএ-তে ভর্তি হন। কিন্তু নানাবিধ কারণে এখানেই অ্যাকাডেমিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। ১৯৪৩ সালে আইজি প্রিজন অফিস ও ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাই অফিসে স্বল্পকাল চাকরি ছাড়াও বিভাগপূর্বকালে মাসিক মোহাম্মদীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
কবি ফররুখ আহমদের চিন্তাচেতনা দর্শন সবই ছিল এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাক্সার প্রতিফলন। তার কবিতা ছিল মানবতাবাদী দর্শনে পরিপূর্ণ। আশির দশকের কবি আসাদ বিন হাফিজ ফররুখ আহমদ সম্পর্কে কবিতায় যে ছবি এঁকেছেন তা এ রকম:
‘টানা টানা চোখ আর মায়া ভরা মুখ/সকলের প্রিয় কবি নাম ফররুখ/ ছোটদের বড়দের সকলের তিনি/ এই মাটি, এই দেশ তার কাছে ঋণী/….
কবি ফররুখ আহমদ জীবনের দীর্ঘ সময় রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা ও বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠান প্রযোজক ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসস্বীকৃত একজন অসাধারণ জননন্দিত কবি ফররুখ আহমদ। স্বপ্নরাজ্যের সিন্দাবাদ, ঐতিহ্যের কবি ফররুখ আহমদ বাংলা- সাহিত্যাকাশে এক উজ্জ্বল তারকা। ছন্দের কবি, সঙ্গীতঝঙ্কারের কবি ফররুখ আহমদের কাব্যে ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, স্বদেশ, সমকাল ফুটে উঠেছে সার্থকভাবে। অফুরান সৌন্দর্য, উধাও কল্পনা, রূঢ় বাস্তবতা, প্রদীপ্ত আদর্শ, সমুদ্রবিহার, রোমান্টিকতা, প্রেম প্রভৃতি তার কবিতার এক মৌলিক চরিত্র নির্মাণ করেছে। গানের ভুবনেও তার পদচারণা ছিল সর্বত্র। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে গীতিকার হিসেবে তার ছিল ব্যাপক খ্যাতি। শিশুসাহিত্য, নাটক, অনুবাদসাহিত্যেও তার অবদান উল্লেখযোগ্য।
তার প্রথম ও সেরা কাব্যগ্রন্থ সাত সাগরের মাঝি ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া আজাদ কর পাকিস্তান, সিরাজাম মুনিরা, নৌফেল ও হাতেম, মুহূর্তের কবিতা, হাতেম তায়ী, পাখির বাসা, হরফের ছড়া, নতুন লেখা, ছড়ার আসর, হে বন্য স্বপ্নেরা, ইকবালের নির্বাচিত কবিতা, চিড়িয়াখানা, কাফেলা, হাবেদা মরুর কাহিনী, কিস্সা কাহিনী, ফুলের জলসা, ফররুখ আহমদের গল্প প্রভৃতি তার অমর সাহিত্যকীর্তি।
সব্যসাচী লেখক ও গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছিলেন : ‘ফররুখ আহমদ ছিলেন অফুরানভাবে সৃষ্টিশীল। তার সৃষ্টিধারায় কখনো ছেদ বা বিরতি পড়েনি। সব মিলিয়ে তার সাহিত্য-শস্যের পরিমাণ বিরাট’। ফররুখ আহমদ জীবদ্দশায় এবং মরণোত্তর পর্বে দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কারে ভূষিত হন।
ফররুখ আহমদের সাহিত্য জীবনের শুরুতে ‘সওগাত’ পত্রিকায় ফররুখ সম্পর্কে আবু রুশদ লিখেছেন- ‘ফররুখ আহমদ রোমান্টিক কবি, অর্থাৎ তার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তব-বোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। তার কাব্যে সৌন্দর্যের জয়গান অকুণ্ঠ, সুদূরের প্রতি আকর্ষণও তার কাব্যের আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। তবুও তিনি নিঃসন্দেহে আধুনিক। তার একটি বলিষ্ঠ সজাগ তীক্ষè অনুভূতিশীল মন আছে যা সৌন্দর্যের অস্তিত্বকে স্বীকার করার সাহস রাখে, কিন্তু রোমান্টিসিজমের বিপদ সম্বন্ধে যা সর্বদা সচেতন’। এমনিভাবে প্রখ্যাত অনেক কবি সাহিত্যিক ফররুখ আহমদ সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন।
ফররুখ আহমদের লেখা গান আজও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে নতুন প্রজন্মকে ‘তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া, দূর দিগন্তের ডাক এলো, ঝড়ের ইশারা ওরা জানে, এমনি অসংখ্য গান-কবিতা আর সাহিত্যের মধ্য দিয়ে মানুষের হৃদয়ে যুগ থেকে যুগান্তরে বেঁচে থাকবেন কবি ফররুখ আহমদ। জীবনের শেষ দিকে কবি ফররুখ আহমদ রাষ্ট্রীয় বৈরিতার শিকার হন। ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকার ইস্কাটন গার্ডেনে ইন্তেকাল করেন এই মহান কবি।