আত্মহত্যার একটা উল্লেখযোগ্য কারণ আত্মগ্লানীতে দগ্ধ হওয়া। ‘আমি কেন এমন করলাম! আজ আমার জন্য এই অবস্থা, আমি কোন কাজের না, আমি বাবা-মায়ের বোঝা’ এরকম হাজার হাজার কারণ মনের মধ্যে সাপের মতো দংশন করতে থাকে। দূর্বল মনের যে কেউ এসব হতাশার কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। কারণ সে মনে করে এটাই একমাত্র মুক্তির পথ।
এখানে একটা ব্যাপার চলে আসতে পারে, আত্মহত্যা করতে কেউ প্রলুব্ধ করেছে কিনা। বা কারো উপর্যুপরি তিরস্কার হতাশাকে বাড়িয়ে আত্মহত্যার পথ সৃষ্টি করেছে কিনা। এমন কিছু হলে সে ব্যক্তিকে দোষারোপ করা যায়। তবে চট করেই উপসংহারে যাওয়ার আগে ঘটনাটি ভালোভাবে পর্যালোচনা করা উচিত।
ভিকারুন্নেছা স্কুলের ছাত্রীর ঘটনাটি নিয়ে পুরো দেশে তোলপাড় চলছে। হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়েছেন প্রিন্সিপাল।
প্রথমে আমরা ভুলে যাই, ঘটনাটি ভিকারুন্নেছা স্কুলে ঘটেছে। মনে করি, আমাদের পাশের স্কুলের ঘটনা। যেখানের ছাত্রী আমার মেয়ে, বা আপনার মেয়ে। আমার/আপনার মেয়ে পরীক্ষার হলে মোবাইল নিয়ে গেছে। নকল করার সময় সে ধরা পড়েছে। আমাকে/ আপনাকে স্কুলে ডেকেছে। মেয়েটি কেন মোবাইল নিয়ে হলে গেল, মোবাইল কেন দিয়েছেন? আপনি কেমন মা/বাবা? বাচ্চাকে এই শেখাচ্ছেন? এরকম অনেক তপ্ত বাণী বর্ষিত হয়েছে আমার/আপনার ওপর। এখন আমার/আপনার ভূমিকা কী হবে?
আমার লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যাবে। চোখ থেকে পানি পড়বে। মা হিসেবে/অভিভাবক হিসেবে নিজেকে অযোগ্য মনে হবে। কেন মেয়ের দিকে আরেকটু ভালো করে নজর দিলাম না? পরীক্ষার প্রিপারেশন নিতে আমি কেন সাহায্য করলাম না? হোম টিউটরকে বেতন তো ঠিকই দিই, সে ঠিকভাবে পড়াচ্ছে কিনা খেয়াল করলাম না কেন? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজব আমি। টিচার আমাকে ডেকে মেয়ের কৃতকর্মের জন্য বকাঝকা করেছে এজন্য অপমানিত বোধ করব ঠিক, কিন্তু টিচারকে দোষারোপ করব না। দোষ তো আমার। টিচারের দায়িত্ব টিচার ঠিকই পালন করেছে। আমি কি আমার দায়িত্বগুলো পালন করেছি?
তারপর মেয়েকে কাছে ডেকে, তার ভুলটা বোঝাবো। বকাঝকা করে এটা বোঝাবো না যে, তার কারণে আমার মাথা নিচু হয়েছে। বরং বোঝাবো যেটা হয়েছে সেটা ভুলে যেতে। যদি স্কুল থেকে টিসি দিয়েই দেয়, তাহলে অন্য স্কুলে ভর্তি করাবো। নতুন করে মেয়েকে গড়ে তোলার চেষ্টা করব।
মহসিন কলেজে পড়ার সময় আমার একজন ক্লাসমেট ছিল। দুষ্টুমি ও পড়ায় অমনোযোগী হওয়ার কারণে তাকে সেন্ট স্কলাসটিকা স্কুল থেকে টিসি দিয়ে বের করে দিয়েছিল। তারপর নতুন স্কুলে ভর্তি হয়ে এসএসসি তে গোল্ডেন এপ্লাস পায় সে। মহসিন কলেজে পড়াকালীন সময়ে সে যেমন চঞ্চল, ড্যাম কেয়ার ছিল তেমন পড়াশোনায় খুব ভালোও ছিল। এইচএসসি তেও গোল্ডেন এ প্লাস পায় সে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্সে চান্স পায়।
টিসি দিয়ে বের করে দেয়ার সময় স্কুলের টিচাররা তাকে ও তার অভিভাবককে নিশ্চয় মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেনি। কিন্তু ওটাই ওর জীবনের শেষ ছিল না। বরং সেখান থেকেই সে নতুন ভাবে শুরু করেছিল।
এখন আপনি ভাবুন, আপনার সাথেও এমন কিছু হলে আপনি কী করবেন?
অরিত্রির জন্য কষ্ট হচ্ছে খুব। মৃত্যুর আগে সে বারবার হয়তো এটাই ভাবছিল, তার কারণে তার বাবাকে অপমানিত হতে হয়েছে। আদরের মেয়েকে হারিয়ে ওর বাবার অবস্থা ভেবেও কষ্ট হচ্ছে। যে ক্ষতিটা তাদের হয়েছে তা কোনভাবেই পূরণীয় নয়।
তবে সব কিছু ছাপিয়ে আমার প্রচণ্ড আফসোস হচ্ছে। শোকের ছায়ায় আমরা আড়ালে ঢেকে দিচ্ছি সত্যটাকে। সে সত্যটা হচ্ছে এটা একটা মারাত্মক দূর্ঘটনা। এবং এতে ভিকারুন্নেছা স্কুলের টিচারের কোন দোষ নেই। অরিত্রির মৃত্যুর জন্য তিনি কোনভাবেই দায়ী হতে পারেন না।
বাচ্চাকে মানুষ করতে গেলে কঠিন মনোবলের হতে হবে। সন্তান ভুল করলে শুধরে দিতে হবে, অন্যায় করলে শাস্তি দিতে হবে। তবে পন্থাটা যাতে এমন না হয়, তাকে হতাশা আর আত্মগ্লানী ঘিরে ধরে, সে চিরতরে ভেঙে পড়ে, হারিয়ে যায়।
সন্তানদের প্রথম শিক্ষক তার বাবা-মা, তার পরিবার। পরিবার থেকেই নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিন। শিক্ষককে দোষারোপ করা বন্ধ করুন। আর যারা শিক্ষকের বিচার চাইছেন, আপনারা কি আসলেই জানেন শিক্ষক কী বলে অপমান করেছে? কী ভাষায় করেছে? একটা নিউজ ছড়ালেই কেন বিবেক বুদ্ধিহীণের মতো সবাই সেটার সাথে তাল মেলাই? কেন উচিত অনুচিত বাছ-বিচার করি না?
শোকাহত অরিত্রির পরিবারের পাশে আমরা দাঁড়াতে পারি, স্বান্তনা দিতে পারি। তবে আবেগের বশে সঠিককে ভুল, ভুলকে সঠিক বলতে পারি না। এটার ফলাফল কিন্তু আরও ভয়াবহ হতে পারে।
আর সকল শিক্ষকদের জন্যও দুটো কথা বলতে হয়। শিক্ষক হওয়ার আগে আপনারা প্রত্যেকেই মানুষ এবং নিজ নিজ সন্তানের পিতামাতা। তাই শাস্তি দেয়ার আগে, শিক্ষার্থীর স্থলে নিজের সন্তানকে ভাবুন। আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করলে ক্ষমা করাটাই কর্তব্য। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে গড়ে তোলার পবিত্র দায়িত্ব আপনারা কাঁধে নিয়েছেন। জাতি গঠনের দায়িত্বে যাঁরা আছেন তাঁদের দিকেই যদি আঙ্গুল তোলা হয়, তাহলে সে জাতি সামনে এগিয়ে যাবে কীভাবে?#Think_before_you_make_your_mind
সালসাবিলা নকি
৪ ডিসেম্বর ২০১৮