অন্যের অধিকারের প্রতি উদাসীনতা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা
পুরুষে পুরুষে দাবি ‘এই গৃহ আমার’/ অন্তরীক্ষে হাসে, মূল মালিকাণা যাঁর
মানুষের চাওয়া পাওয়া বড়ই আজব। ছোট বেলায় বড় হতে চায়; বড় হয়ে ছোট হতে চায়। প্রথম জীবনে টাকার পেছনে ছুটে সময় ও স্বাস্থ্য নষ্ট করে। আর জীবনের শেষভাগে এসে সেই টাকা দিয়েই আবার স্বাস্থ্য ভালো করার চেষ্টা করে কিন্তু ততক্ষনে সময়টা ফুরিয়ে যায়। জীবনের প্রথম ভাগে বন্ধু, সময় থাকে কিন্তু টাকা থাকে না। জীবনের মধ্যম ভাগে টাকা থাকে, বন্ধু থাকে কিন্তু সময় থাকে না। এই সময়ের আকালে বন্ধুদের মাঝে সময় ব্যয় করতে পারা এখন ভাগ্যের ব্যাপার। অনেক লোক দেখেছি জীবনের শেষ ভাগে সময়, টাকা দুটো থাকলেও বন্ধু নেই। কেও তাদের সময় দিতে রাজী নয়।
এভাবেই মানুষের জীবন কেটে যাচ্ছে, যার শেষ গন্তব্য মৃত্যু। সৃষ্টিকর্তা মানুষের মনকে এমনভাবে তৈরি করেছেন তাকে যদি একটি স্বর্নের উপত্যকা দেয়া হয়, তাহলে সে আরেকটি পেতে চাইবে। বিবেচনাবোধ হারিয়ে ফেলে মানুষ। মানুষের চাওয়া এমনই যে চাইতে চাইতে অন্যের অধিকার খর্ব হচ্ছে কিনা বিবেচনা করেনা। নিজের চাওয়া-পাওয়ার পরিধি বাড়াতে ভাইবোন, আত্মীয়, প্রতিবেশীদের হক তথা অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে কিনা তার দিকে ভ্রূক্ষেপও করেনা। বরং এর প্রতিবাদ করতে গেলে হেনস্থার মুখে পড়তে হয়; চাওয়া পাওয়ার খেসারত দিতে গিয়ে প্রাণ গেছে কত পরমআত্নীয়ের।
মজার ব্যাপার হলো মৃত্যুর ডাক না আসা পর্যন্ত মানুষ বুঝতেই পারেনা বা সেভাবে বিশ্বাস করেনা যে তার জীবন ক্ষণস্থায়ী- আর এজন্যই সে বুঝে বা না বুঝে পাপ করে; তাইতো মানুষ মাত্রই ভুল। আর সৃষ্টিকর্তা মানুষকেই শুধু এই সুযোগ দিয়েছেন, আরো সুযোগ দিয়েছেন ভুল বা পাপ করার পরও সঠিক পথে ফিরে আসার। কিন্তু সুযোগসন্ধানী মানুষ সব কিছু বুঝেও খারাপ কাজ করেই চলেছে আর যদি সেটাকে সঠিক বলে চালানোর চেষ্টা করে তবে তার শাস্তি তাকে অবশ্যই পেতে হবে; এই পৃথিবীতেই পেতে হবে; দিতে হবে তার সব দুঃসাহসের মুল্য। তাছাড়া পরকালের জবাবদিহিতার কথা ভুলে গেলে চলবেনা।
মেনে নিতে হবে এসব আমরা করি শুধুমাত্র দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রয়োজনে। আর ক্ষণস্থায়ী জীবন হলো সংক্ষিপ্ত একটা সফরমাত্র। জীবনসায়াহ্নে এসে মানুষ স্মরণ করবে জীবন ছিল একটি যাত্রাবিরতি। কিন্তু এ স্মরণ তার কি কাজে আসবে? এভাবেই কেটে যাচ্ছে দিন। চলে যাবে প্রতিটি প্রহর, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর। এটাই জীবন।
মানুষ ভবিষ্যত বলতে শুধু দুনিয়ার জীবনের অবশিষ্ট সময়টুকুই বোঝে। আর তা সুখী ও সমৃদ্ধ করার জন্য পরের অধিকারের কথা ভুলে যায়। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে বারবার বিভিন্নভাবে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, তার প্রকৃত জীবন হল আখেরাতের জীবন।
তোমরা সেই দিনকে ভয় কর, যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর কাছে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। এরপর প্রত্যেককেই তার কর্মের প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে দেওয়া হবে এবং তাদের প্রতি কোনো অবিচার করা হবে না।-সূরা বাকারা : ২৮১
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “দুনিয়াতে এমনভাবে থাক, তুমি যেন একজন প্রবাসী অথবা পথচারী মুসাফির”- বুখারী
ইসলাম সহ সকল ধর্মই মানুষকে অধিকার আদায়ের চেয়ে অধিকার প্রদানের বিষয়ে বেশি উৎসাহিত করেছে। বর্তমান সমাজের বড় একটি দুর্বলতা হচ্ছে, সমাজের প্রত্যেকেই নিজ নিজ অধিকার আদায়ের স্লোগান দেয়। কিন্তু অন্যদের যেসকল হক তার উপর রয়েছে তা আদায়ের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নির্বিকার। যখন সমাজের প্রতিটি মানুষ নিজের অধিকার আদায়ে ব্যস্ত থাকবে কিন্তু অন্যের অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে থাকবে অবহেলা, তখন সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা হবে তার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল যা বর্তমান পৃথিবীতে একেবারেই স্পষ্ট। সকল ধর্ম প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে গুরুত্বের সাথে অন্যের হক ও অধিকার আদায়ের অনুভূতি জাগ্রত করে।
ধর্ম কর্মের পাশাপাশি বর্তমান সমাজে আমরা রোটারী-লায়ন-সমবায়ের মাধ্যমেও জনসেবায় রত আছি। তা সত্ত্বেও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আজো আমরা পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ পরিবার-পরিজন-বন্ধুদের অধিকার আদায়ে সচেতন হলেও সক্ষম হইনি। এর মূল কারণ মসজিদ মন্দির বাড়ীঘর কর্মস্থল সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোননা কোনভাবে আমরা অনধিকার চর্চা করছি। অন্যের হক আদায়ে চেষ্টা করলেও আমরা ব্যর্থ।
আমাদের উচিৎ আমাদের উপর অন্যের যে হক রয়েছে তা ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির আশা, অসন্তুষ্টির ভয় এবং হাশরের মাঠে জবাবদিহিতার হাত থেকে বাঁচার জন্য’ ঠিক ঠিকভাবে আদায় করে দেয়া।
লেখক: বাঁশখালীর কৃতিসন্তান, বর্তমানে কানাডা প্রবাসী লেখক ও সামাজিক সংগঠক