২০২১ বইমেলাকে সামনে রেখে অনন্তকাল ধরে কাবার পথে গ্রন্থটি লিখেছেন বাঁশখালী সাধনপুর ইউনিয়নের কৃতিসন্তান জে এম ইশফাকুল হক। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক।
বইটির প্রকাশক- সালফি প্রকাশন। ঢাকায় কাটাবন জামে মসজিদ কমপ্লেক্সের মার্কেটের লাইব্রেরিগুলোতে আর চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় আযাদ বুকস,ফয়েজ বুকস, আর দোতালায় জিলানী লাইব্রেরী , হোসাইনিয়া লাইব্রেরীতে ও নোয়াখালী চৌমুহনীতে আলহেরা লাইব্রেরিতে পাওয়া যাচ্ছে।
বাঁশখালী টাইমসের পাঠকদের জন্য গ্রন্থ হতে একটা পর্ব উপস্থাপন করা হলো-
সাগর পাড়ের একটি গ্রাম
বদরখালী। সাগরপাড়ের একটি গ্রাম। পড়ন্ত বিকেল। চাষারা তখন কাজ সেরে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরছিল। উত্তর দিকে জেলেদের ঘরবাড়ি। সাগরপাড়ের দক্ষিণ দিকে চাষাদের কুঁড়েঘর গুলো। ভাটির টানে সমুদ্রে অনেকদূর পর্যন্ত চর ভেসে উঠেছে। সাগরের পাড় ঘেঁষে নিচে চরের শুকনো মাটিতে জেলেরা মাছধরার জাল বিছিয়ে জোড়া তালি দিচ্ছে। মাছ ধরার ইঞ্জিনবোটগুলো যেন আবার গভীর সমুদ্রে যাওয়ার প্রতীক্ষায় দিনক্ষণ গুণছে । কিছু ভাঙাচোরা নৌকাও এখানে ওখানে মেরামতের কাজ চলছে। হঠাৎ জীবনের দৃষ্টি আঁটকে গেল একটি নৌকার গলুই এর উপর। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, দাঁড় বেয়ে বেয়ে ক্লান্ত এক বুড়ো জেলে। অস্তগামী সূর্যের শেষ রশ্মি ও তার জীবন যেন আজ একাকার। হয়তোবা সে সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া অতীতের দিনগুলোতে ডুবে আছে। জীবনটা তো আসলে সমুদ্রের মতোই। এই সাগরের বুকের দিগন্তহীন অথৈ জলরাশির বিশাল তরঙ্গমালায় মানুষ মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখতে পায়। আবার কখনও নতুন জীবনের স্বপ্ন বুনে।
সমুদ্রে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভেজা কাদাবালুচর শেষে পশ্চিমে তরঙ্গায়িত নীলজলরাশি গোধূলির রক্তিম আভায় আধো আধো দেখা যাচ্ছে। ঢলে পড়া সূর্যের শেষ লাল রশ্মি দিগন্ত শেষে সমুদ্রের সুবিস্তৃত নীল এ জলরাশিকে রাঙিয়ে তুলেছে। জীবনের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, ভাটির টানে আদিগন্ত ভেসে উঠা সাগরের চরের কাদা পানিতে অনেক দূর হেঁটে যেতে। মাঝে মাঝে বিচিত্র রকমের শামুক, ঝিনুক। খালপাড়ের ছেলে মেয়েরা যে যা পারছে কুড়াচ্ছে। একটি গাংচিল সমুদ্রের দিকে কিছু দূর উড়ে গিয়ে ছোট একটি মাছ বা শামুক চঞ্চুতে নিয়ে দক্ষিণদিকে ফিরে গেল। সমুদ্র মানুষ ও অসংখ্য প্রাণীর রিজিক যোগায়।
“আর দু’টি সমুদ্র সমান নয়; একটি খুবই সুমিষ্ট ও সুপেয়, আরেকটি অত্যন্ত লবণাক্ত আর প্রত্যেকটি থেকে তোমরা তাজা গোশত খাও এবং আহরণ কর অলঙ্কার যা তোমরা পরিধান করে থাকো। আর তুমি তাতে দেখো নৌযান পানি চিরে চলাচল করে। যাতে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।” [সূরা আল-ফাতির, আয়াত: ১২]
একটু পরেই পশ্চিমের নীল দরিয়াকে রাঙ্গিয়ে তোলা সূর্য নীল দরিয়াতেই টুপ করে ডুবে গেলো। সাগর পাড় জুড়ে রাতের নিস্তব্ধতা নেমে এলো । ঝুপড়িটির কিছু দূরে কিছু নারিকেল গাছ, যার অধিকাংশই কিছু উঁচুতে গিয়ে বাঁকা হয়ে উপরের দিকে বেড়ে উঠেে গেছে।
ডোল কলমি ঘেরা ঝুপড়িটি দেখলেই বুঝা যায়, এটি সাগরের উজান ভাটিতে ঝড় ঝাপটার সাথে লড়াই করে করে কোন রকম দাঁড়িয়ে আছে। এই রোদপোড়া কুঁড়ে ঘরগুলো শতবছরের বঞ্চনা ও বেদনার স্বাক্ষী। রোদে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া পাল, ছেঁড়া জাল, সমুদ্রের তীরে শামুক ঝিনুক কুড়ানো পুরানো কাপড় পরা তাদের শিশুগুলো, নৌকার গলুই বা মাসতুল—এ-ই তো জেলেদের জীবন। উত্তাল সমুদ্রে কখনও কখনও ভেসে যায় তাদের ঝুপড়িগুলো। আবার নতুন করে বাঁধে ঘর। ভাঙ্গাগড়ার দোলাচলে এভাবেই কেটে যায় তাদের জীবন। সাগরের উজান ভাটির সাথে তাদের গভীর জানা শোনা। পিতৃপুরুষ থেকে পাওয়া সামান্য জমি ও সমুদ্রের ভিতরেই তাদের জীবন ও জীবিকা, সমুদ্রই তাদের নিয়তি।
সূর্যাস্ত শেষে দিগন্ত ছেয়ে সমুদ্র পাড়ের চর এলাকা জুড়ে রাতের আঁধার নেমে আসার কিছু পরেই কৃষ্ণপক্ষের মরা চাঁদের আলোয় দূরে সমুদ্রের নীল একটু একটু বুঝা যায় । বকর, আলী আর জীবন একটু দূরে নারিকেল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে গল্পে মেতে উঠে। সাগর ছোঁয়া স্নিগ্ধ বাতাস তাদের গা ছুঁয়ে যায়। ঝর্ঝর শব্দ তোলে নারিকেল গাছের পাতা দোলে। দক্ষিণে অনেক দূরে সাগরের মাঝে আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো একটু পর পর কি যেন ঝিলিক দিয়ে যায়। বকর বলে, ওটি হলো কুতুবদিয়ার বাতি ঘর। মাঝ দরিয়ায় কোন নাবিক যাতে পথ না হারায়, এই বাতি তাদের পথ দেখায়। ও –। ওরকম বাতি যতদিন মানুষের নাগালের মধ্যে আসেনি, দিক্ভ্রান্ত নাবিকেরা তখন কিভাবে পথ খোঁজে পেতো? তখন নাকি হাজার বছর ধরে ধূ ধূ মরুভূমিতে পথচলা কোন পথিক কিংবা মাঝদরিয়ায় পথহারা কোন নাবিক, আকাশে সারা রাত নির্ঘুম জেগে থাকা তারকাগুলো দেখে দেখে পথ চিনে নিত।
(ওয়া বিননাজমি হুম ইয়াহতাদুন।’)
এবং তারকা সমূহ, যেগুলো দ্বারা তারা পথ খোঁজে পায়।’ নাহল:১৬।
‘জলে স্থলের অন্ধকারে কে তোমাদেরকে পথ দেখান?’ নামল:৬৩।
রাতে জীবনেরা ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝরাতে ঘুম ভাঙে সমুদ্রের গর্জনে। জোয়ার আসায় ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে তীরে আছড়ে পড়ছে। জীবনের ভয় ভয় লাগে। সে আর ঘুমাতে পারে না।
এখন নাকি সে ভাবে, আমাদের জীবনটাও এক ধরণের সমুদ্রই। কখনো উত্তাল তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ, কখনও শান্ত সমাহিত। আর সেই সমুদ্রের উজান ভাটিতে আমরা নিরন্তর এগিয়ে চলেছি। পরবর্তীতে তার নিজের জীবন যখন বিভিন্ন উত্থান পতনে এগিয়ে যাচ্ছিল, সমুদ্র দেখার সেই রাতের স্মৃতি তার হৃদয়ে এসে বার বার ঢেউ তুলতো ।
সকালে আত্মীয়েরা তাদের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে আপ্যায়ন করান। জীবনরা যখন বিদায় নিয়ে ফিরে আসছিলো, পথে জোহরা ও নোমান চর থেকে শামুক কুড়িয়ে আনে। এই শামুকের সৌন্দর্য জীবনদেরকে শিহরিত করে। পৃথিবীর অঢেল ঐশ্বর্য থেকে বঞ্চিত , অবলা এসব শিশু কিশোরদেরকে মনে একটু হলেও সান্ত্বনা দিতে সমুদ্রের বেলাভূমিকে মহান রাব্বুলআলামীন হয়তো এসব শামুক ঝিনুক দিয়ে সাজিয়েছেন। এগুলোর সৌন্দর্য্যে তারা ভুলে থাকে অনাস্বাদিত পৃথিবীর কথা। ”উভয় দরিয়া থেকে মণি মুক্তা ও প্রবাল বের হয়ে আসে।’আর রহমান,২২।
তাদের উস্কু খুস্কু রুক্ষ চুলগুলোর দিকে জীবন তাকিয়ে দেখে। সমুদ্রের লবনের রঙ লেগে আছে তাদের চুলও ছেঁড়া ফ্রক কামিজ পরা শরীর জুড়ে।
অনেকদিন পর সে জানতে পারে, একান্নব্বইয়ের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে সমুদ্র তাদের গিলে ফেলে। হয়তো সমুদ্র তার সান্নিধ্যে বেড়ে উঠা এসব শিশু ও বুড়োকে পাগলের মত ভালবাসে বলেই কিছুদিন পর পর তাদের মতো অসহায় গরিব ও শিশুদের এভাবে গিলে ফেলে। প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায় তাদের এ বেদনাভরা জীবনের সযত্নে সাজানো স্বপ্নগুলো, হারিয়ে যায় তাদের না বলা কতো কথা। এখানেই থেমে যায় তাদের জীবন নদী।
জোহরাদের খবর কেউ আর রাখেনি। কেনই বা রাখবে। তারাতো সামান্য চাষাবাদ বা সমুদ্রে মাছ ধরে কোন রকম জীবন যাপন করা অখ্যাত, অপাংক্তেয় মানুষ।
ভবঘুরে জীবন শুধু এসব নিয়েই থাকে। সে প্রায়ই ভাবে, ওমরের মতো শাসক কি আজ আর পাওয়া যাবে? যিনি বলেছিলেন, ফোরাতের তীর পর্যন্ত যদি একটি কুকুরও না খেয়ে মরে, আমি ওমরকে কিয়ামতের দিন আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কবি ফররুখের কল্পনায়:
‘আজকে ওমর-পন্থী পৃথিবীর দিকে দিকে প্রয়োজন
পিঠে বোঝা নিয়ে পাড়ি দেবে যারা প্রান্তর প্রাণপণ,
উষর রাতের অনাবাদী মাঠে ফলাবে ফসল যারা,
দিক- দিগন্তে তাদের খুঁজিয়া ফিরিছে সর্বহারা।”
সে নাকি শুনেছিল, প্রিয় নবিজিও (স:) এসব গরীব দুঃখীদের কথাই ভাবতে ভাবতে নিরবে কেঁদে গেছেন সারাটি জীবন। পুরো আরব যখন তাঁর পদতলে, তখনও তিনি ঘুমাতেন খেজুর পাতার ছেঁড়া মাদুরে। কোন এক দুপুরে ওমর রা: তাঁর গৌরি বর্ণের পৃষ্ঠদেশে শোয়া থেকে উঠায় খেজুর পাতার ছাপ দেখে কেঁদে বলেছিলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ, মক্বার সে দু:খের দিন গুলোতো অতীত হয়ে গেছে। এখনতো মদিনার জীবন। আপনার জন্য তোষক নিয়ে আসি? ‘নবিজী স: বলেছিলেন, ‘ওমর,মা লি ওয়ালিদদুনয়া? ‘ওমর,আমার সাথে দুনিয়ার কি সম্পর্ক?’
জীবন, কতোকাল ধরে এভাবে আমার পাশাপাশি হাঁটে।।এসব ভাবতে ভাবতেই একসময় নিজেকে আবিষ্কার করলাম হোটেলের সামনে।